গদ্যের পোডিয়ামে উদয় শংকর মহান্তি

মা

পৃথিবীতে সমস্তজীবের শ্বাস,কান্না,দুঃখ,শোক,ব্যথা আছে।কিছু হাসি শুধু নির্দিষ্ট কারণে সীমাবদ্ধ থাকে।ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলি। যখন আমাদের গোয়াল ঘরে কালচে গরুটা বাঁধা থাকতো।তার গলার অলংকারে ঝুলে থাকতো ক্ষুদ্র ঘন্টা। সাদা ধবধবে ছোট্ট তার বাছুরছানাকে কাছে না পেলে সে হাম্বা হাম্বা করে খুঁটিতে দড়ির সঙ্গে গলার বাঁধনে যার পর নাই টান দিতো গোসাবকের গলায় ছোট্ট নুপুর।আমাদের ঘরময় নুপুর ঘন্টার অস্থিরতার টুং টাং কনসার্ট দেবালয়ের মূর্ছনার গীতবিতান হলেও সেই ব্যাকুলতার ধ্বনি ছিলো করুন আবেদনের মাতৃপ্রেম।
প্রত্যেক গোধূলিতে নিয়মিত বেতনক্রমে পিসেমশাই আসতেন দুধদুইতে।তিনি আসার আগের থেকে পাথরে বেজে উঠতো ঝংকার।আমার দেখা মাতৃজাত এবং তাঁদের বুকে সাজানো ছোটবড় পাথরের ভীষণ সৌন্দর্য। পিতৃসমাজ পাথর চরিত্র বহন করে সংসার ধর্মের বিশেষ জায়গা জুড়ে থাকেন। তাই মা কাকিমারা মাথায় ঘোমটা তুলে বাবাকে বলতেন.. “উনাকে আজ থেকে একটু আগে আসতে বললে ভালো হবে। কারণ গরুটা বড্ডো ছটপট করে,আমাদের বাছুরটাও কষ্ট পায়”। উত্তরে বাবা বলতেন “উনিতো সময় মতনই আসেন তোমরা এতো চিন্তা করোনা”। দূরে দাঁড়ানো ষাঁড়ের সঙ্গে বাবা পিসাদের বড্ডো মিলদেখতাম।
চ..য়ো… চ..য়ো.. সফেদ বৃষ্টি ফোঁটায় দহনের সুর আসতো গোয়ালঘর থেকে। পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম,জিভশরীরের প্রেম কিসুন্দর পিতৃসমাজকে কেমন দূরে দাঁড়করিয়ে রাখে সেই নন্দরাজার রাজপ্রাসাদে।যেখানে মাখন তোলা হয়, যেখানে স্বাত্তিকঘৃত তোলা থাকে সিন্গ্ধ অবসরের প্রেমে অনির্দিষ্ট কালের অর্ঘ্য হিসেবে।
পৃথিবীর সব মায়ের মমতা যেন এক সাথে খুঁটিতে শক্ত করে বাঁধা থাকে।আমরা তখন বাছুর ছানার মতো।ভাইবোনেরা মায়ের দুধ ছেড়ে গোয়ালঘরের থেকে বালতি করে বয়ে আনা মাতৃদুগ্ধে রুটি ডুবিয়ে একসাথে খেতে বসতাম রাত্রে।বাছুরটিও আমাদের থেকে আলাদা হয়ে ঘনঅন্ধকার রাত্রীর নিস্তব্ধতায় মাতৃ শিরায় শিরায় সঞ্চিত দুগ্ধরসে কন্ঠ ভিজিয়ে চোখ বন্ধকরতো আরেকটি সকলের জন্যে। মা,কাকিমা,জেঠিমারা ঈশ্বরনৈবেদ্য নিয়ে চলতো মন্দিরে আবেদন নিবেদনে পাটনীর মতো বলে আসতো “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”।
সেই ঝিঝি পোকার ডাক,সেই জোনাক আলো,সেই ঠান্ডা বাতাস,রাতের আকাশ মাদুরে শুয়ে থাকা চাঁদ,ঘুমিয়ে থাকা সমস্ত লড়াই।এই প্রহর তাই সাদা ফুল ফুটে উঠবার প্রাক্কালকে স্বাগত জানায়।তখন পৃথিবীতে হিংসার রেশ টানা ক্যানভাসে সাদা রঙের বিকাশ যেন নিষ্পাপ শান্তির কথা লিখে রাখে।শুভ্র সাজে সেজে ওঠেন স্বরস্বতী।ঐশ্বর্যের দেবী এগিয়ে আসেন পায়ে পায়ে।যেখানে সুন্দর নেই সেখানেই অলক্ষীর অস্তিত্ব।ঠিক তখনই যত রঙীন স্বপ্ন ঘুমিয়ে পড়ে। ডানাঘরের ছাউনির নিরাপত্তার আদরে মা পাখিরা ঘুমপাড়ায় তার ছানাদের। কিছু নিশাচর সংসার তাগিদে ঘোরেফেরে মাতৃত্ব নিয়ে।নিঝুম রাতের অনিদ্রার হাসপাতাল।বর্ণময় আলোর নীচে ঝুমোতে থাকা প্রহরী।রাত্রিনদীর জল মাতৃত্বে ভোরেওঠে।
রাতের বিছানায় তাল পাতার হাত পাখার মৃদু বাতাসে আমাদের মা।নিদ্রার বিছানায় ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকারের যেন স্বপ্নপূরণ। তবেই আমরা রূপকথার গল্পের স্বপ্নদেশে চলেযেতে পারতাম গাঢ় ঘুমসাঁতার দিতে দিতে। মাঝে মাঝে গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেলে, রাক্ষুসে দাঁতথেকে রক্ত চুইয়ে পড়লে,অথবা উঁচু পাহাড় ডিঙোবার সময় শূন্যে ভেসে পড়তে থাকলে মায়ের ঐশ্বরীক হাত চেপে ধরতো আমাদের।নিছক মাকে জড়িয়ে ধরে তার ঢালকোলে আশ্রয় নিয়ে নিরাপদ থাকতাম,তখন মা.. কে অপরিচিত চরিত্র বা বস্তুগুলি থেকে আলাদা মনে হতো।ভাবতাম মায়ের,ওদের মতো শক্তি নেই।কোনো রোমাঞ্চ নেই ,ওসবের মতো আশ্চর্য নয় আমার মা।আবার ক্লান্তি চেপে চেপে নবান্নে,ব্যাঞ্জনের থালাভর্তি খিদে আড়াল করে বসে থাকেন মা,ঠিক যেন শিশুর কপালে দেওয়া নজরকালো টিকা,খাদ্যের চর্বনে অতিরিক্ত শ্বাস মাথায়উঠে কাশিতে নামলেই মায়ের মন্ত্রবাতাসের ফুঁ । কিকরে যে এতো শক্ত মাথার খুলির ভেতরে প্রবেশ করে সবকিছু নিমেষে সারিয়ে তোলে বুঝিনা।বোঝে তারাই যাদের মা থেকেও নেই, অথবা মায়ের অভাবের ঘন কালো অন্ধকার।
রাত্রীকালীন জোৎস্না আর দিনের সূর্য যেন দুটি আলাদা সত্যা,পৃথক দুটি কুল।প্রত্যেক বাবাই এক একটি সূর্যের মতো চিরন্তন।প্রাণের আধার মা ঋণগ্রস্থ জোৎনাআলো।এদের যুগ্মজীবন ধারার নামই সৃষ্টি।সেই সৃষ্টির গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে আসা জীবকুলের কান্না থাকে,ব্যথা থাকে।শুধু চিন্তাস্রোতে প্রেম আর মর্যাদা আমাদের হাসতে শিখিয়েছে।মানুষই একমাত্র জীব যে হাসতে পারে। এই হাসির সুদর্শনস্রষ্টা মা। তিনি সন্তানের হাসি মিলিয়ে হেসেফেলেন।সুখে অসুখে শান্তিতৃপ্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারেনা মায়ের স্বভাব।তেমনি পিতা অনুভব করেন অপার মুগ্ধতার খুশি।তিনি সহজে হাসতে পারেন না মায়ের মতো।যিনি হাসতে পারেন তিনি মায়ের অভাবে সান্ত্বনা হয়ে ওঠেন বাৎসল্যপ্রেমে এবং কঠিন থেকে নরমের দিকে এগিয়ে চলেন অর্ধনারীশ্বরের প্রতিমায়। সেও এক মাতৃত্ব।
আমরা আবেগের সম্ভাষণে মাটি,দেশ, প্রকৃতিকে যখনি সম্বোধন করেছি মা ডাক দিয়ে।ঠিক তখনি মর্যাদা,অমর্যাদার প্রশ্ন উঠেছে মায়ের নরমে।প্রথম উচ্চারিত ক্ষুদ্রতম শব্দের অর্থ একটি প্রকান্ড সমূদ্রে ডুবে যাওযার মতো। আজকাল আকুল কাকু আমার মতো টেলিফোনে কথোপকথনে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তিনি হাসি মুখ ভালো বাসেন বলে আমাকে বলেছেন মনে রাখবি আমরাই শুধু হাসতে পারি। তিনিই প্রথম আমাকে প্রশ্ন করেছেন মায়ের দুধের ঋণ প্রসঙ্গে।আমাদের মন্থনে উঠেআসা লোকশিল্পীর দুগ্ধ ঋন স্বীকারের গীতিকথা যেন নিছকই আবেগের কারণ বলে মনে হয়। কারণ মা জন্মদাত্রী। প্রথমত পিতা মাতার বৈবাহিক প্রেমের অর্জিত স্বর্ণফসল সন্তান। এই সন্তান জন্মপূর্বে কোনোদিন আবেদন করেনি সে পৃথিবীর আলো দেখবে বলে। দাবী করেনি বিশুদ্ধ শ্বাস নেবার অধিকারের।সৃষ্টির নিয়ম,..বন্ধ্যাসংসার,এবং উত্তরাধিকার আলোকিত করবার জন্যে সন্তানের জন্ম।যখন প্রথম ভূমিষ্ঠ হয়ে কেঁদে ওঠে নুতন।মায়ের স্তন তার মুখে পুরে দিয়ে মা কখনোই সদ্যজাতকে শিখিয়ে দেননি দুধ খাবার কৌশল। তাই দুগ্ধের ভারে অস্থির মা করুনা করেন না।ব্রহ্মান্ডস্রষ্টাই মায়ের ভূমিকা নিয়ে থাকেন এবং শিশুকে মায়ের কোলে তুলে দিয়ে বলেন, আমিই মা,আমিই লালন,আমিই শিশু,আমি স্রষ্টা। মনে পড়ে তখন” খেলিছো এই বিশ্বলয়ে বিরাট শিশু,….. প্রলয়ও সৃষ্টি তব পুতুল খেলা”।
সেই বিধাতার প্রেম আজও আছে প্রকৃতির মেলে ধরা আধারে,সেই ফুল,ফল সেই শেকড় শ্যামা চরণে নিবেদিত হবে বলে রক্ত প্রণতির পুষ্পার্ঘ্য বিকশিত হয়।নদীচর ভরে ওঠে সাদাকাশ চাদরে। শিউলি ঝরে পড়ে,শিশিরে ভিজে যায় দূর্বা।দীঘি ভরা পদ্মের সহস্র চোখমেলা নীলআকাশ ভাসে, ঢাকে পড়ে কাঠি।পাড়ায় পাড়ায় নতুনের উৎসব মায়ের আগমন ছন্দে উমা আসেন বাপের বাড়ি। সেই পথেই মাতৃহারা সুমনা বাবার বাড়িতে নতুন শাড়ীর সুগন্ধে সেজে ওঠে বছরের পর বছরে।আরেকটি ছোট্ট দূর্গা বেড়ে ওঠে পাশাপাশি।থেকে থেকে তার নরম আঙ্গুল রাখে আমার শক্ত হাতে।
সে অঙ্গ দুলিয়ে নেচে যায় উঠোনে মাঝে মাঝে জানান দেয় বাবা…. আমার মা কোথায় গেল বাবা। সামান্য অলক্ষ্যে তার চাহিদা যেন বিলম্বিত মা ডাকের কঠিন অর্থে এসে দাঁড়ায়।
আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিদিনে বিসর্জনের বিস্বাদ লাগা যত বিপন্ন দুর্গা জন্মনেন শুধু অন্ধকার ভালোবেসে।তাঁদের হাতে কাস্তে,হাতুড়ি ঘর্মাক্ত কপাল।আর নাপাওয়া দামে কলম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে নিভৃতে বলে যায় মা…. মা …. মাগো শুনছো তুমি আমার দেশ।
আজ মাতৃদিবসে মেঘ করেছিলো পশ্চিমে,এখন সূর্য শেষ উঁকি দিচ্ছেন বেলাশেষের কবিতায়,একে একে সব শিশু ঘরে ফিরছে।আমাদের নবনির্মিত ঘরের একের পর এক প্রকোষ্ঠ পার করে আচমকা নেমে এলো আলো আমি দেখলাম সূর্য নেমে এসেছেন মাত্র পাঁচইঞ্চি পরিধির গর্তে অনেক গুলি গর্ত অতিক্রম করে এসেছে আধার। শুধু ক্ষেত্র যথার্থ আছে বলে। আধার নির্মল,পবিত্র। তার গতি পথ আমার মাতৃতুল্য সুবর্ণরেখার মতো বহমান। যদি ক্ষেত্র নরম হয়,পবিত্র হয়,স্থির হয় তবে সে উৎসে মিলবেই…….
উদযাপনের অনুষ্ঠান শুধু অতীব সত্যকে অনুশীলন করানোর প্রয়াস মাত্র। তাই মাতৃদিবস নামক একটি ঘটনাবহুল দিবস মাকে রঞ্জিত করে না।ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট অনুক্ষণ থাকেনা। প্রত্যেক দিবসে মায়ের আঙ্গিক সুমধুর অন্তরে মিলতে চায় শুধু।
যেমন আমার বিষণ্ণ দেশমা,তার অস্থির পৃথিবীমায়ের আঁচলছুঁয়ে আছে।তাও প্রত্যেকটি প্রাণীর ভেতরে হিংসাত্বক প্রতিযোগিতা বিদ্যমান,শুধু সন্তানদের জন্যে কোনো অশুভ প্রতিশোধ নেই গর্ভধারিনীর।যদি কোনো দৃষ্টান্ত সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায় তবে সে কলঙ্কমাত্র।
যারা গর্ভে ধারণ করেননি তারাও মা। তাঁরাও শক্তি শান্তির প্রতীক।এখন যারা মায়ের কোলে ফিরতে পারেনি।যারা মায়ের মুখ দেখার সুযোগ পাননি তাদের জন্যে বিজয়মাল্য প্রস্তুত করছে সময়। বীর পুত্র বরণ করবে বলে প্রেমময় অপেক্ষার প্রদীপ আলোতে উদ্ভাসিত মা। তার প্রজ্জলিত শিখার সামনে উপস্থিত হতে চাইলে শুধু অপেক্ষায় থাকবো। অপেক্ষা ভীষণ নরম। মায়ের মতো নির্মল এবং পবিত্র।তাই প্রণাম নয় শুধু চুম্বন আঁকি মায়ের আকাশে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।