আর পাঁচটা মেয়ের মত ফরিদপুরের স্বর্ণঘোষ গ্রামের মনোরমা যখন চোদ্দ বছর বয়সে পালং গ্রামে শ্বশুরঘর করতে যান, তখনো বোধহয় বোঝেন নি, যে বাপের বাড়ি, গ্রামের সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে আসতে হবে তাঁর পিতৃদত্ত নামটিও, হতে হবে লীলাবতী। নিজের ঘরের বেড়া আর চালের বাতায় আদরের নাম বিসর্জন দিতে দিতে এ কথাও হয়ত স্বপ্নেও ভাবেননি যে কয়বছরের মধ্যেই ইমিগ্রেশন খাতাতেও নিজের পরিচয়ের খানিকটা ছেড়ে আসতে হবে, স্বচ্ছলতা আর সুরক্ষার কিছুটাও। শুধু তাঁকে নয়, তাঁর মত অজস্র মানুষকে। আর তখন সে ঘটনাকে কবিতায় মেলে ধরার জন্য কোন জয় গোস্বামী ও ছিলেন না, এতটাই সাধারণ ছিল একজন স্বাধীনতা ও দেশভাগ দেখা গৃহবধূর জীবন। ইনি লীলাবতী দেবী, আমার ঠাম্মা।
জ্ঞান হওয়ার পর ঠাম্মাকে খুব অল্পই দেখেছি, বুঝতে পারা তো দূরের কথা। তখন স্মৃতিতে কেবলমাত্র একজন সত্তরোর্ধা ভীমরতিপ্রাপ্ত বৃদ্ধাই ছিলেন, যাঁর তখন দ্বিতীয় শৈশব। কথায় কথায় বকাবকি করতেন বাড়ির সবাইকে, শরীরের কষ্ট সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে এসেছিল। ফলে তাঁকে জানা বা বোঝা আমার পক্ষে বলা বাহুল্য তখন সম্ভব হয়নি। সে বোধ এসেছিল বহু বছর, এমনকি খাতায় কলমে সাবালকত্ব পাওয়ারও পরে। আসলে ঠাম্মা সম্পর্কে বেশিরভাগই শোনা অন্যদের মুখে,বাড়ির বড়দের, জেঠু-কাকু-পিসি বাবা মা, এদেরই মুখে। ফলে পরিণত বয়সে ঠাম্মা আমার সামনে এসেছে টুকরো টুকরো ছবি হয়ে, আর অজান্তেই তাদের দিয়ে তৈরি করেছি আমার নিজস্ব কোলাজ।সেখানে একজন এমন মানুষকে দেখতে পাই, তাকে সাধারণ বলতে বলতেও ঠিক বলা যায় না। তাই আজ স্মৃতিচারণে বসে সেসব ছবিকেই স্পষ্ট করার পালা।
প্রথম ছবিতে চোখে পড়ে এক অল্পবয়সী গৃহবধূকে, যে তার প্রথম জীবনে অভাবের সঙ্গে ঠিক পরিচিত ছিল না। দেশভাগ তাকে চেনালো চরম দারিদ্র্য,অপরিচিত পরিবেশ, নিজের চেনা জীবন থেকে উৎখাত হওয়ার যন্ত্রণা। হয়তো পূর্বজন্মের সৌভাগ্যে কাঁটাতারের আঘাত তাঁর বা তাঁর পরিবারের শরীরে পড়েনি, কিন্তু মনের ওপর তার প্রভাব নেহাত কম ছিল না। দেশভাগের ঠিক এক বছর আগে ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বামীর কর্মস্হলে(বাঁশবেড়িয়া)এসে আর ফরিদপুর ফিরতে পারেননি। বরং জীবন তখন শিখিয়েছিল অনেক কঠিন অঙ্ক,কিভাবে স্বামীর সামান্য রোজগারে প্রতিপালন করতে হবে একটি সাতজনের পরিবার, পালং এর বড় কোঠাবাড়ির বদলে কোন্নগরে ছোট্ট একটি বাড়িতে আনতে হবে সুখী গার্হস্থ্যের স্বাদ। এর মধ্যেই দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই, যাতে ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত আর প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভালো থাকতে পারে।
দ্বিতীয় ছবিতে একজন বাঙাল বাড়ির গৃহিনী বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছেন। ওপারে থাকতে যার নানারকম রান্নার প্রতি আগ্রহের কথা জেনে ভোজনরসিক স্বামী ব্যবস্হা করেছিলেন ময়রা আর হালুইকরদের কাছে স্ত্রীর প্রাইভেট টিউশনের, এপারে এসে তাঁকে শিখতে হল কি করে সামান্য উপকরণেও স্বাদে আহ্লাদে সাজিয়ে দিতে হয় ভাতের থালা। তাঁর হেঁশেলে এপার ওপার দুই বাংলার স্বাদই ছিল সমানতালে, সঙ্গে ভোলেননি রসগোল্লা, সন্দেশ, পান্তুয়া, খাজা, পিঠে পায়েস। পুত্রবধূদের,মেয়েদের শিখিয়েছেন যত্ন করে, আর হ্যাঁ, ছেলেদেরও।
পরের ছবিটা এক মধ্যবয়সী মায়ের যিনি নিজে মিডল স্কুল পাশ হলেও শিক্ষার মূল্য সবচেয়ে বেশি বুঝেছিলেন। হারিকেনের আলোতে তাঁর তত্ত্বাবধানে চলত ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, স্বামী থাকতেন বাইরের কাজকর্মে। নিজেরো বইএর প্রতি আগ্রহ একচুলও কমেনি, ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবই থেকে শুরু করে, তারা একে একে প্রতিষ্ঠিত হয়ে চাকরি পাওয়ার পর মেজছেলের অফিস লাইব্রেরি থেকে আসা বিদেশি থ্রিলার, বিশেষ করে হ্যাডলি চেজ এর বঙ্গানুবাদ, সবেতেই ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ।
পরের ছবিটি বউদের জবানিতে উঠে আসা এক শাশুড়ির চিত্র যিনি তাঁর ঘরের সামনের চৌকিতে বসে দোক্তা চিবোতে চিবোতে(বিধবা হওয়ার পর পান জর্দা ছেড়ে দিয়েছিলেন) অনর্গল বাঙাল ভাষায় বকাবকি করে নিয়ন্ত্রণ করতেন সম্পূর্ণ সংসার। ছেলেরা, বউমারা তাঁর দাপটে বেশ তটস্থ থাকতেন। শাসন ছিল পুরোমাত্রায়, মঙ্গলকামনা ছিল আরো বেশি। ফরিদপুরের সংসারের পুজো পার্বণ, উৎসব অনুষ্ঠান,লোক খাওয়ানো অনেকটাই ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন এসময়ে। শুধু বাড়ির লোক বা আত্মীয় স্বজন নয় তাঁর উৎসবে আনন্দে শরিক হত সমস্ত পাড়া।পাড়ার মহিলামহলের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও তাদের কূটকচালিতে প্রভাবিত হতেন না খুব একটা। উদারতা ছিল স্বভাবে, আর সময়ের থেকে হয়তো একটু এগিয়েই ছিলেন। এই কারণেই মেয়েদের পাশাপাশি বড় পুত্রবধূকেও অনুমতি দিয়েছিলেন বিয়ের পর চাকরি করার, পরবর্তী প্রজন্মে পুত্রসন্তান না থাকায় লোকের নির্বংশ হওয়ার ভয়দেখানোকে স্রেফ হেসে উড়িয়ে নাতনিদের আদরের ডাকনাম রাখেন(পোষাকি নাম উর্মি, ঊশ্রী, অর্পিতা) সোনামণি, হীরামণি, মুক্তামণি আর তাঁর প্রশ্রয়েই সম্ভব হয় বড় নাতনির নাচ শেখা। ইন্ধন যোগাবার মানুষের অভাব ছিল না, কিন্তু তাদের উপেক্ষা করার উদারতা ঠাম্মার কিছু কম ছিল না। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মায়ের মুখে প্রায়ই শুনেছি। আমার কাকিমা যখন বউ হয়ে বাড়িতে আসেন তখন কিছু অত্যুৎসাহী মানুষ মন্তব্য করেছিলেন,”যাই বলুন দিদি, আপনার এই বউই সুন্দর(পড়ুন ফর্সা) আগের দু’জন তো কালো!” ঠাম্মার জবাব তৈরিই ছিল,” হ, কিন্তু এরেও আমি পছন্দ কর্যা আনসি, ওদেরও আমিই পছন্দ কর্যা আনসি। কি কইতে চাও, আমার পছন্দ খারাপ?” এই জন্যই ঠাম্মার তিন পুত্রবধূর একজনও নিজেদের সারা জীবন শাশুড়ির নিন্দা না করেই কাটিয়ে দিলেন, তাতে অবশ্য তাঁরা দুঃখিত কিনা সে প্রশ্ন করে বুড়ো বয়সে ঝাড় খাওয়ার সাহস আমার নেই।
লেখা প্রায় শেষের মুখে, হঠাৎ একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সে ছবিতে কোন মানুষ নেই, একটা খালি ঘর। ১৯৯২ সালে ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর শ্রাদ্ধশান্তি মিটলে পরিষ্কার করা হচ্ছে। তখন আমার ছ’বছর বয়স। তাই মৃত্যু দেখলেও বোঝার ক্ষমতা বিশেষ ছিল না। সেজন্যই পঞ্চমীর দিন ঠাম্মা চলে গেলেও আমার জেদে কোরা কাপড় পরে পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে নিয়ে গিয়েছিল বাবা, শ্রাদ্ধও একটা উৎসবের বেশি কিছু মনে হয়নি। সেভাবেই পরিষ্কার করার সময় ঠাম্মার ব্যবহৃত জিনিসের বিলি ব্যবস্হা নেহাত কৌতুহলেই দেখা। তখনই হঠাৎ চোখ পড়েছিল শতচ্ছিন্ন, লাল শালু দিয়ে মোড়া কাশীদাসী মহাভারতের দিকে। ছবি দেখার আগ্রহে সেদিন হাতে তুলে নিয়েও বুঝিনি যে বইটি ছিল এক স্বর্গবাসী ঠাম্মার তার হীরামণি নাতনির জন্য রেখে যাওয়া একটুকরো উত্তরাধিকার। আজও সেই মহাভারত গুছিয়ে রেখেছি, সঙ্গে একরাশ কৃতজ্ঞতা।