হৈচৈ যুক্তি-তক্কো – তে সুপ্রিয় চক্রবর্তী

গল্প, যুক্তি, তক্কো

বিভিন্ন মহলে বিশেষ বিশেষ আলোচনা আর দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের পরে সরকার স্কুল-কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যবস্থা করলো। সুখবর, ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারবে, শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, কতটা তারা প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে সেটা আমাদের অতীত দেখলেই বোঝা যায়, কারণ ভবিষৎ আমাদের অতীতকে অতিবাহিত করে. স্কুল খোলার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের পূর্ব অভিমতকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সাধুবাদ জানাই, কারণ সরকার একটি কথা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলো যে কোনোভাবেই পরবর্তী প্রজন্মকে অতিমারীর হাতে সমর্পন করা যাবে না। কিন্তু হয়তো কিছুটা রাজনৈতিক চাপের কারণে সরকার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।

স্কুল খোলাকে আমি সমর্থন করি, কিন্তু স্কুল খোলার পিছনে যে আলোচনা কিছুদিন যাবৎ শুনেছি সেগুলো আমার মাথায় অন্তত ঢোকেনি। যেমন ধরুন, স্কুল-কলেজ না খুললে শিশু এবং বাড়ন্ত বাচ্চাদের মনের বিকাশ সম্ভব না। তাহলে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথের মনের বিকাশ হয়নি, কারণ তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন বলে আমার জানা নেই। তিনি সংকীর্ণ মনের ছিলেন – এই উক্তি কোনো বাঙালি করলে তার মনের বিকাশ নিয়ে আমাদের হাজারো প্রশ্ন করতে হয়। দ্বিতীয় যুক্তি – ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে না গেলে তাদের খেলাধুলা হবে না, এক কথায় তারা মাঠে যেতে পারবে না, তাদের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। মনে রাখা দরকার সচিন তেন্ডুলকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করেননি, এমনকি সুনীল গাভাস্কার, মহেন্দ্র সিং ধোনি, কপিল দেব, কেউ তথাকথিত উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেননি। সুতরাং, তাদের শারীরিক বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। করে দেখুন, কতগুলো কাউন্টারযুক্তির শিকার আপনাকে হতে হয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে স্কুলে আমরা খেলতে যাইনা, প্রধানত পুঁথিগত শিক্ষা অর্জন করতে যাই। স্কুলে, বিশেষ করে সরকারি স্কুলে ফিজিক্যাল এডুকেশন বলে একটি ক্লাস হয়, যেখানে শিক্ষক এসে আমাদের বন্ধ স্কুলঘরে খেলা শেখান, তবে বেসরকারি স্কুলের ব্যাপার আলাদা, সেখানে স্পোর্টস টিচার, আর্ট টিচার আলাদা আলাদা থাকেন।

তৃতীয় যুক্তি – শপিং মল, সিনেমাহল, মদের দোকান এবং রেস্টুরেন্ট খোলা থাকলে স্কুল খোলার কি সমস্যা। ঠিক যুক্তি, কিন্তু এই যুক্তি তখনই গ্রহণ করা যায় যখন সিনেমা দেখতে গেলে আমাদের রোজের এটেন্ডেন্স দিতে হবে। ধরুন যারা প্রতিদিন বাড়ি ফিরে স্ট্রেস কাটানোর নামে একটি সুসজ্জিত গ্লাস নিয়ে বসেন তাদের বলতে হবে তারা যেন রোজ নিয়ম করে অন্তত আট ঘন্টা মদ্যপান করেন এবং প্রতি গ্লাস হাতে নেওয়ার আগে একবার করে ‘ইয়েস ম্যাম বা ইয়াস স্যার’ বলেন। অথবা, আপনি রোজ শপিংমল বা সিনেমা দেখতে গিয়ে একবার করে নিজের এটেন্ডেন্স দেবেন, এবং বছরের শেষে আপনাদের মূল্যায়ন করবেন আপনার শিক্ষক, প্রয়োজনে গৃহশিক্ষক রাখতে পারেন পুরো সিনেমা বুঝতে অসুবিধে হলে।

চতুর্থ যুক্তি – স্কুলে না গেলে ছাত্ররা মিশতে পারবে না, তাদের সামগ্রিক মানসিক গঠন ব্যাহত হবে। এই যুক্তিটি মন্দ নয়, কিন্তু একটি জিনিস বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে যে ছাত্ররা কি শুধু স্কুলেই কথা বলতে পারে? স্কুল আর সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? যদি থাকে, তাহলে বলতে হয় স্কুলে ছাত্ররা প্রধানত শিক্ষা গ্রহণের জন্য যায়, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার জন্য নয়। একটু বেরিয়ে দেখুন, স্কুল বন্ধ থাকাকালীন ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় সব থেকে বেশি ছিল রাস্তায়। বিশ্বাস না হলে, স্কুল খোলার জন্য তাদের কাতর আর্তনাদের মিছিলগুলো লক্ষ্য করুন, এবং মিছিলের শেষে পাশের দোকান গুলোয় একবার নজর রাখুন। তবে সেই মিছিলে যদি সব ছাত্র থাকে তবে আলাদা, না হলে ক্ষমা করবেন, কারণ মিছিলগুলো ছিল ছাত্রসমাজের, তাই বুঝতে ভুল হতে পারে।

অসুবিধেটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোর। টেকনোলজি আমাদের ভবিষৎ, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, সবার সামর্থ নেই ল্যাপটপ কিনে অনলাইন ক্লাস করার। কিন্তু সেটা সরকারের ব্যর্থতা, ছাত্রদের নয়। দ্বিতীয় প্রশ্ন – সরকার ট্যাব দিয়েছে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে, কিন্তু তারা সেটি পড়ার কাজে ব্যবহার করছে না। এটি অভিবাবকদের ব্যর্থতা, সরকারের নয়। তৃতীয়ত, আমাদের যুব সমাজ এখনো এতটা ‘টেকনোলজিক্যালি অ্যাডভান্সড’ নয়। এই কারণেই তাদের বেশি করে এই শিক্ষা দেওয়া উচিৎ, কারণ তারা ব্যবহার করতে করতে এটি আয়ত্ত করতে পারবে। চতুর্থ প্রশ্ন – আমাদের স্কুল – কলেজে এখনো সেইরকম পরিকাঠামো নেই। বেশ ভালো যুক্তি, কিন্তু আমাদের পরিকাঠামো নেই বলে ছাত্রদের উপর দোষারোপ করে লাভ নেই। এই সমস্যার সমাধান এক মাসে করা যায়। যেমন ধরুন, যে সকল ছাত্র-ছাত্রীরা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, তাদের হাতে একটি প্রজেক্ট দিয়ে তাদের টিচারদের মেন্টর করে দিলে, একমাসের মধ্যে দেখবেন রাজ্যের সব স্কুল-কলেজে LMS বা লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরী হয়ে গেছে।

কোরোনার কথা বলে সময় নষ্ট করবো না, শুধু যুবসমাজের কাছে একটা কথা বলতে পারি, স্কুলে যাও, আরো বড় হও, শিক্ষা অর্জন করো, চাকরির আশায় ডিগ্রি অর্জন কোরো না, কারণ আগেই বলেছি আমাদের অতীত দেখলেই বোঝা যায়, ভবিষৎ আমাদের অতীতকে অতিবাহিত করে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।