ছোটদের জন্যে বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প – ১১)

নিষিদ্ধ সব গান – সিনেমা

বছর শেষ আর নতুন বছর শুরুর ঠিক মাঝখানে দু’দশক আগের কথা লিখতে বসলেও বোধহয়, একত্রিশে ডিসেম্বর বা পয়লা জানুয়ারির পার্টি মুডটা কোথাও না কোথাও থেকে যায়। মানছি এ বছরটা ভালো কাটেনি, মানে যথেষ্ট খারাপ কেটেছে, আগামী বছরের শুরুতেই ঐ বজ্জাত ভাইরাসটা নতুন চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে, তাও এই দুটো দিন আশার, উৎসবের। “এ বছরটা ঠিক আগের বছরের থেকে ভালো কাটবে” এই আশাটুকু না থাকলেও এ দুঃসময়ে মানুষ যায় কোথায়? তাই এখন একটু গান বাজুক লাউডস্পিকারে, উদ্দাম নাচ হোক, আনন্দ করুক সবাই। আর আমি বরং নব্বইয়ের দশকের নাচ গান আর সিনেমার দুনিয়া থেকে সবাইকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।
সে ছিল ছোটদের জন্য রীতিমতো সংকটের সময়, পান থেকে চুন খসলেই শাসন। শুধু বাবা মা, জেঠু কাকু মানে বাড়ির লোকরা নয়, পাড়ার কাকু জেঠিমা দাদা দিদি পিসি সব্বার‌ই শাসন করার অধিকার ছিল। সেই শাসনের আড়ালে লুকানো স্নেহ বুঝেছি বড় হয়ে, সে প্রসঙ্গ এখানে নয়, বরং শাসনের কারণগুলোই অভিনব। গরমের দুপুরে বা বৃষ্টির মধ্যে বাইরে বেরোনো, দেশলাই নিয়ে খেলা করা, টনসিল ফোলা গলায় টক কুল খাওয়া এসব কারণ তো ছিলই, তবে সবচেয়ে গর্হিত অপরাধ ছিল কমবয়সীদের সিগারেট বিড়ি খাওয়া আর ছোটদের হিন্দি গান শোনা আর হিন্দি সিনেমা দেখা। তখন সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালি পরিবারের বড়দের কিছু প্রচলিত ধারণা ছিল, একটু বুঝিয়ে বলছি— বাংলা সবকিছুই ভালো(ছোটব‌উ বড়ব‌উ হলেও), তারপর ঠাকুর দেবতা থাকলে তো কথাই নেই(সৌজন্যে বাবা তারকনাথ), হিন্দিতে যেগুলোকে পুরোনো দিনের সিনেমা বলে সেগুলোও ভালো, নতুন যা, সব জোরদার অপসংস্কৃতি। স্বাভাবিকভাবেই সাদাকালো যুগের ফ্যান বড়রা আশির দশক পর্যন্ত হিন্দি সিনেমা ক্ষমাঘেন্না করে দেখে নিলেও নব্বইয়ের গান বা সিনেমা ছিল তাদের দু চক্ষের বিষ। আর বাড়ির ছোটরা যদি সে সব সিনেমা দেখে বা গান গায় তাহলে তো হয়ে গেল! সংস্কৃতি বিপন্ন। অবিশ‍্যি সব বাড়ির নিয়ম পুরোপুরি এক ছিল না, কোথাও কিঞ্চিৎ ঢিলেঢালা, কোথাও বাড়তি কড়াকড়ি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বাড়িটি ছিল দ্বিতীয় গোষ্ঠীর। ফলে শাহরুখ, অক্ষয়কুমার, আমির খান তো দূরস্হান, আশির দশকের মিঠুন আর ঋষি/অনিল কাপুরও আমাদের বাড়ি ব্রাত্য ছিলেন। তবে বাবার প্রশ্রয়ে সত্তরের সিনেমা একটু আধটু চলত টিভিতে। শনিবার দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বাপ-বেটির জয়েন্ট ভেঞ্চার এ ‘শোলে’, ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘কালিয়া’, ‘আখরি রাস্তা’, ‘সত্তে পে সত্তা’, ‘দিওয়ার’। মাঝে মাঝে দিদি আর বড়মাও যোগ দিত। তাই মা এর কড়া পাহারার মধ‍্যেও বলিউড সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকছিল। নব্বইয়ের গান সিনেমার রাস্তাও পরিষ্কার হচ্ছিল আস্তে আস্তে।
বাকি কাজটা হয়েছিল পাড়ায় খেলতে গিয়ে। আগেই বলেছি সব বাড়িতে হিন্দি গান সিনেমা নিয়ে কড়াকড়ি সমান নয়। তাই যখনই ছোটদের হুটোপুটি না করে শান্ত রাখতে হত, বড়রা তাদের বসে বসে গানের লড়াই(আন্তাক্ষরি) খেলতে বলে বড়রাই খাল কেটে কুমির নিয়ে আসতেন। তার ফল‌ও হয়েছিল বেশ তাড়াতাড়ি। বাকিদের মত আমরাও শিখে গেলাম, ‘ব’ দিয়ে গান হবে ‘বহোৎ প‍্যার করতে হয় তুমকো সনম’, ন দিয়ে ‘নজর কে সামনে জিগর কে পাস’ আর স দিয়ে ‘সেক্সী সেক্সী মুঝে লোগ বোলে’। শেষের টা গাইতে হত বড়দের লুকিয়ে, ন‌ইলে বকুনি ছাড়াও দু-চার ঘা পিঠে পড়ার আশঙ্কা ও ছিল। কিছু প্যারডিও ছিল যেমন, ‘দেখা হ‍্যায় পহেলি বার, সাজন কি আঁখো মে প‍্যার, ডিম পাঁউরুটি, ডিম পাঁউরুটি’ বা ‘তু তু তু তু তু তারা, লাঠি দিয়ে গরু তাড়া’। এসবে খুব একটা পাত্তা না দিলেও বেশ কিছু গানের লিরিক শুনলেই বড়রা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। তাই মাঝে মাঝে বন্ধ ঘরে মা চেষ্টা করতেন সুনীতি ক্লাস নেওয়ার, যাতে মেয়ের মন ‘চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত’ বা ‘চোলি কে পিছে’ র থেকে সরানো যায়, বসানো যায় রবি ঠাকুর, নজরুল, অতুলপ্রসাদে। সেসব শিখতে আপত্তি না থাকলেও ভবি ভোলার নয়। ফলে সুরুচি সংঘ ডাহা ফেল,তাই হাজার আপত্তি সত্ত্বেও দুরকম‌ই চলত। তার সঙ্গে চলত লুকিয়ে চুরিয়ে ‘রঙ্গোলি’, ‘চিত্রহার’, ‘সুপারহিট মুকাবলা’, ‘অল দ‍্য বেস্ট’ দেখা। এ জলতরঙ্গ রোধিবে কে!
নব্বইয়ের গানের মত নব্বইয়ের সিনেমার প্রতিও ছিল অদ্ভুত আকর্ষণ। আসলে আমরা যেরকম সাধারণ, সাদামাটা, জীবন কাটাতাম, নব্বইয়ের সিনেমা গুলোও ছিল অনেকটা তাই। তখন নায়ক নায়িকাদের আমাদের মতোই অনেকটা দেখতে ছিল, ঝাঁকরা এমনি শ‍্যাম্পু করা চুল, মুখে ব্রণর দাগ, কালো রং, শরীরে চর্বির ভাঁজ, চড়া বিয়েবাড়ির মত মেক‌আপ, ঝলমলে জামাকাপড়। আমাদের মত তাদের ড্রেসিং সেন্স‌ও ছিল ভয়ানক। কিন্তু মানিয়ে যেত। বরফের পাহাড়ে হালকা শিফন শাড়ি পরা শ্রীদেবীর পাশে মোটাসোটা শরীরে ততোধিক মোটা আর র‌ংচঙে পুল‌ওভার পরা ঋষি কাপুর। টাব্বুর লাল ঘাঘরা সবুজ চোলির পাশে হলুদ জ‍্যাকেট পরা অজয় দেবগন, আমির খানের ফাঁপানো চুলের থেকে ছোট সাইজের টুপি, সলমন খানের ঢলঢলে কোটে ব্রোচ লাগানো, সব মানিয়ে যেত। চোখ ওতেই অভ‍্যস্ত ছিল, পারফেকশনের অভাবে কেউ কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতো না। বরং দেখলে মন ভালো হয়ে যেত যখন কলেজছাত্র নায়ক একাই পাঁচজন গুন্ডাকে মেরে পাট করে দিত, জুহি চাওলার মত মিষ্টি কোন নায়িকা বাড়ি থেকে পালিয়ে লুকিয়ে পড়ত আমির খানের মত মিষ্টি নায়কের বাড়ি, ক‍্যাবলা স‌ঈফ আলির কমেডি দৃশ্য গোমড়াথেরিয়াম পুলিশ অফিসার অক্ষয়কুমার এর সাথে, আর অনেক দূরে সরষে ক্ষেতের মাঝে দুহাত বাড়িয়ে ‘সিমরান’কে ডাকত কোন ‘রাজ’। হ্যাঁ কিছু দৃশ্য বড়ই অসুবিধাজনক ছিল, বিশেষ করে ভিলেনের হাতে কোন নারী চরিত্রের হেনস্হার, কিন্তু তাদের খুব খারাপ লোক বলেই জানতাম, আর এটা ভেবেও আশ্বস্ত হতাম যে শেষে এরা হিরোর হাতে ঠিক মারা যাবে। এই সিনেমাগুলোই ছিল কঠিন বাস্তবের থেকে অনেকটা দূরে, আমরাও খানিকটা সময় বিনোদনেই বাঁচতাম। আসলে জীবনটা যে ঠিক সিনেমা নয়, বাস্তবে যে সব সমস্যার এভাবে সমাধান হয় না, নায়ক নায়িকা বিয়ে করলেই যে হ্যাপি এন্ডিং হয় না, সেসব বুঝেছি অনেক পরে। কিন্তু ঐ রঙিন দুনিয়ায় থেকেও, বিশ্বাস করুন, তেমন কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয় নি।
এসব নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, আরো ভালো করে লিখেছেন। তবে আমি সেটুকুই লিখি, যেটুকু বেঁচেছি। ঠিক সেভাবেই যেভাবে হঠাৎ এক সিনিয়র সহকর্মীর ফেসবুক পোস্টে দেখলাম তাঁর স্ত্রী আর ছেলে বছরশেষ উদযাপন করছেন এক বিখ্যাত সত্তরের দশকের গানের সঙ্গে নেচে। নব্বই নিয়েও আমাদের ভাবনা ঠিক এরকমই। অরিজিৎ সিং অনেক বেশি প্রতিভাবান, কিন্তু কুমার শানু, উদিৎ নারায়ণ,শুনতে আজো ইচ্ছে করে। ভেতরটা রিনরিন করে ওঠে আশিকির টাইটেল সং এর আগে গীটার টুকু শুনলেই। আজও আন্তাক্ষরিতে ম দিয়ে গাই “মেরে খোয়াবো মে যো আয়ে”, অ্যাংরি ইয়ং ম‍্যান নায়কের ক্রুদ্ধ চোখজোড়া এখনো আকর্ষণ করে। আসলে এই সব ছোটবেলায় ‘নিষিদ্ধ’ গান সিনেমা এখনো বিশ্বাস করতে শেখায় যে সব সমস্যা মেটানোর জন্য একদিন “করণ অর্জুন আয়েঙ্গে”, বিশ্বাস করায় সোলমেট এর অস্তিত্বে, হ্যাপি এন্ডিং এ(নয়ত পিকচার আভি বাকি হ‍্যায় মেরে দোস্ত), ক্ষমতা রাখে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। সেই ছোটবেলায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।