ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ২৪)

আলাপ

ফিরে আসি বেগম আখতারের কথায়। ১৯১৪ সালে লক্ষ্ণৌয়ের কাছে ফৈজাবাদে আখতারী বাঈয়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন উকিল, নাম আসগর হুসেন। মায়ের নাম মুস্তারি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বাবা তাঁর দ্বিতীয়া পত্নী মুস্তারিকে ত্যাগ করেন কারণ তাঁর কোন ছেলে হয়নি। দুটি কন্যা। মুস্তারি তাঁর দুই কন্যা নিয়ে লক্ষ্ণৌ চলে আসেন। সেখানে মূলতঃ গান গেয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন। ছোট্ট আখতারির মিষ্টি গলা শুনে আখতারির কাকা তাঁকে গান শেখাতে আগ্রহ দেখান। পাটনার সারেঙ্গী বাদক ইমদাদ খানের কাছে তাঁর শিক্ষা শুরু হয়। শেখেন পাতিয়ালা ঘরানার আতা মহম্মদ খানের কাছেও। তবে ঠুংরীর মূল তালিম মায়ের কাছে লক্ষ্ণৌ ঘরানায়, অর্থাৎ গানের সঙ্গে অভিনয় এবং দেহভঙ্গিমা ছিলো গানের অঙ্গ। এর কিছুদিন পর লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় চলে আসেন আখতারীর মা এবং তাঁরা দুই বোন। কলকাতায় তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা চলতে থাকে মহম্মদ খান, লাহোরের আবদুল ওয়াহিদ খান এবং ঝান্ডে খানের কাছে। বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ওস্তাদ হয়ে ওঠেন বেগম আখতার। ঠুংরী গাইতে শুরু করেন একেবারে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঢঙয়ে। নানা মিশ্র রাগের ছোঁয়া, সুরের বৈচিত্র, মুড়কি, হরকৎ তাঁর গানকে অনন্য করে তোলে। গলা দিয়ে, সুর দিয়েই ভাবের প্রকাশ ঘটাতেন।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে আসরে গাইতে শুরু করেন আখতারী বাঈ। তিনিই প্রথম মহিলা শিল্পী যিনি রাজা বাদশার সভা ছেড়ে প্রথম থেকেই জনতার মেহফিলে উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। বিখ্যাত হতে শুরু করে তাঁর গাওয়া গজল, ঠুংরী, দাদরা গানগুলি। ক্রমে তিনি “মালিকা-এ-গজল” উপাধি লাভ করেন। মেগাফোন থেকে বেরোয় তাঁর প্রথম রেকর্ড।
সুন্দর চেহারা এবং অসাধারণ কন্ঠের জন্য ত্রিশের দশকের সিনেমায় ডাক পান তিনি। তখন প্লে-ব্যাক ছিলো না। নিজের গানগুলি নিজেই গাইতেন আখতারী বাঈ। “এক দিন কা বাদশা”, “নল দময়ন্তী” প্রভৃতি সিনেমায় অভিনয় ও গান করতে লাগলেন তিনি। কিন্তু শুধু মাত্র শুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চায় থাকতে চাইতেন বলে কয়েকটি সিনেমা করার পর, সিনেমার ডাক উপেক্ষা করে লক্ষ্ণৌ ফিরে যান তিনি। পরে চল্লিশের দশকে বিখ্যাত পরিচালক মহবুব খান তাঁকে আবার “রোটি” সিনেমায় অভিনয়ের জন্য মুম্বইতে ডেকে পাঠান। সেই সিনেমায় প্রায় চার পাঁচটি গজল গান তিনি। কিন্তু মহবুব খানের সঙ্গে কিছু মতবিরোধের কারণে সিনেমাটি থেকে দু তিনটি গান বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। আবার লক্ষ্ণৌ ফিরে আসেন আখতারী বাঈ। সেখানে ইশতিয়াক আহমেদ আব্বাসি বলে এক উকিলের সঙ্গে তাঁর নিকাহ হয় এবং নিকাহের পরে মহফিলে সঙ্গীত পরিবেশন বন্ধ করে দেন তাঁর স্বামী। অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়েন বেগম আখতার এবং কঠিন অসুখে পড়েন। ডাক্তার বুঝতে পারেন যে তাঁর অসুখটি মানসিক এবং গান না গাইতে পারলে তিনি বাঁচবেন না।
প্রায় পাঁচ বছর পর প্রায় জোর করে আবার সঙ্গীতের আসরে ফিরে আসেন তিনি। প্রথম আসরে গাওয়ার পর এক অদ্ভুত মুক্তির আনন্দে কেঁদে ফেলেন। এরপর আর কারো কথা না শুনে একের পর এক আসরে গাইতে থাকেন ও রেকর্ড করতে থাকেন গান। বেশীরভাগই মেগাফোন থেকে। আমৃত্যু সঙ্গীত পরিবেশন করে চলেন এই শিল্পী। তাঁর শেষ আসর ছিলো তাঁর এক বন্ধুর ডাকে গুজরাটে। আসরে গাইতে গাইতে তাঁর মনে হয় তাঁর গলা যেন কিছুতেই একটি পর্দায় ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না। জোর করে গলা লাগাতে গিয়ে প্রবল কাশির সাথে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও কয়েকদিন পর ১৯৭৪ সালে মারা যান এই অমর শিল্পী। তিনি সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী, পদ্মশ্রী ও মৃত্যুর পর পদ্মভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত এক অনন্য শিল্পী যার গানগুলি আজও সমান জনপ্রিয় এবং বিভিন্ন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে আজও সমানভাবে গাওয়া হয়।
সবশেষে একবিংশ শতাব্দীতে এসে ঠুংরীর রানী গিরিজা দেবীর কথা। সানাইসম্রাট ভারতরত্ন বিসমিল্লা খানকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয় যে তিনি কেন বেনারসেই জীবনের শেষদিন অবধি থেকে গেলেন? তিনি তো কলকাতা, মুম্বাইয়ের মতো বড়ো শহর বা বিদেশে গিয়ে বসবাস করতে পারতেন আরো অনেক বড়ো বড়ো শিল্পীর মতো। গঙ্গার তীরে তাঁর প্রিয় মন্দিরে বসে দুরদর্শনে এক সাক্ষাতকারে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন “উঁহা বাবা বিশ্বনাথজী হ্যায়, মা গঙ্গা হ্যায় ঔর গিরিজা হ্যায়। ইয়ে তিনোঁকো ছোড়কে ম্যায় কাহাঁ যাউঁ?”  বেনারস ঘরানার ঠুংরীর শেষ বড়ো নাম ছিলেন গিরিজা দেবী।
১৯২৯ সালে বেনারসে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবা রামদেও রাই ছিলেন স্থানীয় ভূমিহার জমিদার এবং তাঁর মা সূর্যমুখী দেবী দেবদাসী গোত্রীয় ছিলেন। খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর বাবা তাঁকে গাইতে উৎসাহ দিতেন। তাঁর সামনে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়তেন এবং তাঁকে নানা সুর শোনাতেন। ছয় বছর বয়স থেকে তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার শুরু। মাত্র দশ বছর বয়সে জব্বলপুরে কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিনি। সারেঙ্গীর পন্ডিত সরযু প্রসাদ মিশ্র এবং সেনিয়া ঘরানার শ্রীচাঁদ মিশ্রের কাছে বেনারসেই তাঁর প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা। বেনারসে তখন বাড়িতে বাড়িতে সঙ্গীতের আসর বা মেহফিল বসতো। সেখানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন গিরিজা। এমনই এক আসরে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ব্যাবসায়ী মধুসূদন জৈনের। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁকে বিবাহ করেন গিরিজা দেবী। তাঁর একটি কন্যা হয়। গিরিজা দেবীর প্রথম বড়ো পরিবেশনা এলাহাবাদ রেডিওতে ১৯৪৯ সালে। প্রথম খ্যাতি লাভ করেন ১৯৫২ সালে রেডিও সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন করে। ঠুংরীকে একবিংশ শতাব্দীতে তিনি যেভাবে জনপ্রিয় করেছেন তেমন আর কেউ করতে পারেনি। লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর ভান্ডার ছিলো অফুরন্ত। পূরব অঙ্গের ঠুংরীর সঙ্গে সঙ্গে তিনি দাদরা, টপ্পা, চৈতী, কাজরী, হোরি, সাবন ইত্যাদি নানারকম লোক-অঙ্গের মিষ্টি গান যা সহজেই লোকের মন কাড়তো তা পরিবেশন করতেন। তবায়েফ বা বাঈজীরা যে ধরণের কথা দিয়ে ঠুংরী গাইতেন তাকে সম্পূর্ণ পরিশুদ্ধ করেন গিরিজা দেবী। সুন্দর কথা দিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন যা দেহাতী মানুষের জীবন থেকে উঠে আসা অথবা রাধা কৃষ্ণের প্রেম, বিরহ, লীলা দিয়ে গাঁথা।
একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তাঁর মৃত্যুর পর পূরব অঙ্গের ঠুংরীর কী হবে। তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন ঝাঁসির রানী মারা যাওয়ার পর কি সব নারীরা জওহর ব্রত পালন করেছিলেন? কাজেই কেউ না কেউ ঠিক উঠে আসবেন। তাঁর মৃত্যুর পর কী হবে জিজ্ঞাসা না করে তিনি বেঁচে থাকতে তাঁর কাছ থেকে তিনি যে সব চিজ(বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীতের কায়দা) শিখেছেন তা তাঁর ছাত্রছাত্রীরা যেন শিখে নেয়।
গিরিজা দেবীকে সমাদরে শিক্ষক হিসাবে কলকাতা সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমীতে ডেকে নেন রবি কিচলু মহাশয়। সেখানে প্রচুর ছাত্রছাত্রীকে এই অনন্য সঙ্গীত জীবনের শেষদিন অবধি শিক্ষা দিয়েছেন গিরিজা দেবী।
আমি তাঁর গান বেশ কয়েকবার শুনি ডোভার লেনে। সম্পূর্ণ সাদা কেশরাশি খোঁপা করা। পরণে সুন্দর সাদার ওপর নানা রঙের পাড়ওয়ালা খাস বেনারসী শাড়ী, মুখে পান, কপালে চন্দনের ফোঁটা ও সেই সঙ্গে মিষ্টি হাসিটি নিয়ে স্টেজে এসে বসতেন। প্রথমে ঈষত মোটা মন্দ্র কন্ঠে একটি বিশুদ্ধ খেয়াল পরিবেশন করতেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কন্ঠটি ছিলো অবিকৃত। খেয়ালের পর মিষ্টি হেসে বলতেন “অব ক্যা শুনাউঁ? অভি তো জারা কা মৌসম হ্যায়, ইসকে বাদ আয়েগা ফাগুন ঔর হোরি, তো এক হোরি শুনাতে হ্যায় “, বলেই ধরতেন “উড়ত আবির গুলাল লালি ছাই হ্যায়” অথবা গাইতেন চৈতী “চৈত মাসে চুনরী রাঙ্গাইবে হো রামা পিয়া ঘর আই হে”। অনুষ্ঠান থেকে বেরোতাম একটা ঘোরের মধ্যে। গানগুলি যেন মণিমুক্তার মতো হৃদয়ে খচিত থাকতো। দূরদর্শনে তাঁর একটি অনুষ্ঠান প্রায় সবাই দেখেছেন, অত্যন্ত বিখ্যাত হয়েছিলো বিরজু মহারাজ ও গিরিজা দেবীর সেই অনুষ্ঠান। এই দুজন ছিলেন ভাই বোনের মতো। বিরজু মহারাজেরও তখন অনেক বয়স। শুধু মাটিতে বসে অসাধারণ চোখের ভঙ্গী, হাত ও দেহের ভঙ্গীতে বিরজু মহারাজ যেভাবে গিরিজা দেবীর ঠুংরী “ঘিরি আঈ হ্যায় কারি বদরিয়া, রাধে বিনা লাগে না মোরা জিয়া”কে জীবন্ত করে তুলেছিলেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি তখন যেন স্বয়ং কৃষ্ণ কানহাইয়া! অনুষ্ঠান শেষে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন বেনারস ঘরানার দুই স্তম্ভ, এই দুই অমর শিল্পী!
গিরিজা দেবী অসংখ্য সম্মানে ভূষিত। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ এবং সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমীর সর্বোচ্চ পুরস্কার পান। ২৪ অক্টোবর ২০১৭ সালে গিরিজা দেবীর মৃত্যু যেন লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে এক যুগের অবসান।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।