।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় তপশ্রী পাল

যেখানে দেখিবে ছাই
আজকাল প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিগুলোকে কর্পোরেট হাউসরা নানাধরণের কাজের জন্য ব্যবহার করছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো নতুন যারা জয়েন করবে তাদের রেফারেন্স চেক। আগে এগুলো তেমন প্রচলিত ছিলো না। কোয়ালিফিকেশন, এক্সপেরিয়েন্স দেখে এবং ইন্টারভিউ করে স্বচ্ছন্দে নিয়ে নেওয়া যেতো কর্মীদের। ওপরের লেভেলের জন্য বড়ো জোর মার্কেট রেপুটেশন দেখে নেওয়া হতো। কিন্তু এখন জীবন অনেক জটিল হয়ে গেছে। কে যে কোথায় কী পাকিয়ে রেখেছে, তা শুধু ইন্টারভিউতে মালুম করা দুঃসাধ্য। কারো সার্টিফিকেট জালি হতে পারে, কারো এক্সপেরিয়েন্সে, যে কোম্পানীর কথা বলা হচ্ছে সেখানে হয়তো সে ছিলই না। মানুষ দিন দিন অসাধু হয়ে পড়ছে। তাই থরো রেফারেন্স চেক খুব জরুরী আর তা করতে পারে একমাত্র প্রোফেশনালরা। তাই তাদের কাছেই এ কাজ আউটসোর্স করে কর্পোরেট হাউসগুলো।
এই ধরণের রেফারেন্স চেকের কাজ প্রচুর আসছে এখন “জিভাগোর” কাছে । জিভাগোর হেড অনিকেত মল্লিক অনেক বাড়িয়েছেন তাঁর লোকসংখ্যা। দুটি নতুন ব্রাঞ্চও খুলেছেন। দক্ষিণ কলকাতায় আনন্দপুরে একটি, রাজারহাট নিউ টাউনে একটি। তাঁর দমদমের অফিস থেকে আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না।
রেফারেন্স চেকের কাজ সবচেয়ে বেশী আসে আই টি কোম্পানীগুলো থেকে। ওরাই আজকাল সবচেয়ে বেশী লোক নেয় কি না, আর জালিটাও ওখানেই বেশী হয়! অনিকেতের রেফারেন্স চেক বিভাগের ছেলেরা ওস্তাদ হয়ে উঠেছে ট্রেনিং পেয়ে। ওরাই কাজের চাপ সামলে নেয়। কিন্তু কালকের কেসটা ঘাবড়ে দিয়েছে স্বয়ং অনিকেত মল্লিককেই।
ভারতের প্রথম শ্রেণীর একটি রিটেল চেনে চিফ পিপল ম্যানেজার নেওয়া হবে। তিনি কলকাতা, দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর, মুম্বইতে কোম্পানীর সব ম্যানপাওয়ার হেডদের মাথার ওপর বসবেন ব্যাঙ্গালোর হেড অফিসে। রিটেল মানেই প্রচুর ম্যানপাওয়ার! নানা শ্রেণীর ম্যানপাওয়ার। প্রচুর লোক ঢোকে আবার ছেড়েও দেয়। এইচ আর তাই খুব ইম্পরট্যান্ট এই সব কোম্পানীতে আর ইনি তো একেবারে সবার মাথার ওপর, সুতরাং বড়োসড়ো পোজিশনের জন্য নেওয়া হচ্ছে এঁকে। কোম্পানী ফাইনাল করেছে বোধায়ন বসুকে। সিইও স্বয়ং ব্যাঙ্গালোর থেকে অনিকেতকে ফোন করে অনুরোধ করেছেন বোধায়নের রেফারেন্স চেক যেন সে পারসোনালি করে।
প্রায় দুমাস আগে কাজটা পেয়েছেন অনিকেত। হাই প্রোফাইল লোকের অনেক এক্সপেরিয়েন্স। ঘেঁটে দেখতে সময়ও বেশী লাগে। তবে লাক ভালো যে এর আগে বোধায়ন কলকাতারই দুটি বিশাল আন্তর্জাতিক আই টি কোম্পানীর এইচ আর হেড ছিলেন। তাঁর কোয়ালিফিকেশন দারুন! আই আই টি, আই আই এম! সেখানে হাত ছোঁয়ানোর জায়গা নেই। কাজও করেছেন এমন সব কোম্পানীতে যে কিছু বলার নেই! কিন্তু প্রথমেই যেটা নিয়ে একটু খুঁত খুঁত লাগছিলো অনিকেতের তা হলো এতোদিনের আই টি কোম্পানীর এক্সপেরিয়েন্স ছেড়ে হঠাত রিটেলে জয়েন করছেন কেন বোধায়ন। তিনি তো ব্যাঙ্গালোরে কোন আই টি কোম্পানীতেই জয়েন করতে পারতেন! হঠাত অন্য জগতে, অন্য শহরে এই বয়সে পদার্পণ কেন? মাইনে তো যেখানে ছিলেন সেখানেও প্রচুর পাচ্ছিলেন!
খোঁজ নিয়েছেন অনিকেত। বোধায়ন নিউ টাউনে বিশাল ফ্ল্যাটে থাকেন। এ ছাড়াও তাঁর দক্ষিণ কলকাতায় পৈতৃক বাড়ি আছে। তাঁর স্ত্রীও কলকাতায় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর এইচ আর হেড! খবর নিয়ে জেনেছেন বোধায়নের প্রেমের বিয়ে। একসাথেই পড়াশুনা করতেন তাঁর স্ত্রী আই আই এমে। সেখানেই প্রেম ও বিবাহ। এক ছেলে এক মেয়ে। দুজনেই আপাততঃ বিদেশে পাঠরত। এমন সেটল্ড লাইফ ছেড়ে, ফ্ল্যাট ছেড়ে, বৌকে কলকাতায় ছেড়ে হঠাত এমন ঝাঁপ দেওয়ার কারণ কী হতে পারে।
রেফারেন্স চেকের নিয়ম হলো একেবারে লেটেস্ট কোম্পানী থেকে নিয়ে পিছিয়ে যেতে হয় আগের আগের কোম্পানীগুলোতে, তারপর কোয়ালিফিকেশন চেক করতে হয়, মার্কেট রেপুটেশন চেক করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রথমেই অনিকেত লাস্ট কোম্পানী গ্লোবালসফটে খোঁজ নিয়েছেন। সাধারণতঃ একটি কোম্পানীতে চান্স পেলে তবে লোকে আগের কোম্পানীতে রিজাইন করে। কিন্তু জানা গেলো প্রায় মাস তিনেক আগেই বোধায়ন গ্লোবালসফট ছেড়েছেন। সেখানে ছিলেন বছর পাঁচেক। কেন ছাড়লেন? সাধারণত নানা কোম্পানীর এইচ আরই এই সব খবর দিয়ে থাকে রেফারেন্স চেকের জন্য। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়েও বিশেষ কোন কারণ জানা গেলো না। শুধু বেটার ক্যারিয়ারের জন্যই নাকি ছেড়েছেন! তাও মেনে নিয়েছিলেন অনিকেত। কিন্তু তাঁর মনের খুঁতখুঁত ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছিলো না।
তাই এরপর খোঁজ নিতে গেছিলেন সুপার টেকনোলজি সলিউশনে। এটি বিশাল কোম্পানী। এখানে বোধায়ন প্রায় দশ বছর কাজ করেছেন! তাঁর হাত ধরেই সুপার টেকনোলজি কলকাতায় স্টার্ট আপ থেকে আজ প্রায় দশ হাজার লোকের কোম্পানী! একে গড়ে তোলায় বোধায়নের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারে নি মার্কেটে। তা হলে এমন কোম্পানীই বা বোধায়ন ছাড়লেন কেন? এখানে সিনিয়ার পোজিশন থেকে কেউ প্রায় রিজাইন করেই না! নাঃ, আবারও শোনা গেলো বেটার ক্যারিয়ারের জন্যই। কিন্তু গ্লোবালসফট তো এর চেয়ে ছোট কোম্পানী। তাহলে?
কিন্তু অনিকেতের মনে একবার খুঁতখুঁতানি ঢুকলে তিনি তার শেষ দেখে ছাড়েন। প্রায় দুমাস বাদে গত কালই এই দুটো কেনরই উত্তর খুঁড়ে বার করেছেন বোধায়ন। এখনো কাজ চলছে তাঁর। আশা করা যায় আর দিন পনেরোর মধ্যে সব কিছু জানিয়ে দিতে পারবেন সিইও মশাইকে।
২
গ্লোবালসফটের সুন্দরী এইচ আর ম্যানেজার সিমিতার সঙ্গে ডিনারে গেছিলেন অনিকেত গত সপ্তাহের শেষে। কী করে ভাব হলো সিমিতার সঙ্গে সেটা অনিকেতের ট্রেড সিক্রেট! তবে সিমিতা যে দামী বিদেশী মদ খেতে খুব ভালোবাসে সেটা জেনে নিয়েছিলেন অনিকেত। অতএব ডিনার ও পানের জন্য একটি পাঁচতারা হোটেলের বারে বসার কথা বলতেই সুন্দরী সানন্দে রাজী। এ কথা সে কথার ফাঁকে বোধায়নের প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন অনিকেত। ততক্ষণে হুইস্কির প্রভাবে সিমিতার মুখ লাল। শার্টের বুকের একটা বোতাম খুলে দিয়েছে গরম লাগছে বলে। মাখনের বলের মতো বক্ষস্থল ঈষৎ দৃশ্যমান। একটু ঝুঁকে পড়ে সিমিতা বললো
“বোধায়ন একটি স্কাউন্ড্রেল ছিলো! ফ্লার্টিংটাকে ও একটা আর্টে পরিণত করেছিলো!”
“তাই বুঝি?” অনিকেত বেশী কিছু না বলে সিমিতাকে বলতে দিয়েছিলো।
“হ্যাঁ, প্রথমে আমরা ভাবতাম মেয়ে দেখলে একটু দুর্বল হয়ে পড়া – এমন পুরুষ কর্পোরেটে দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। তেমনি বোধায়নও – কিন্তু –“
“কিন্তু কী ম্যাডাম?” অনিকেত ধরতাই দিলেন।
“বোধায়ন তো কাজের দিকে দারুণ ছিল, তাই সিইও, ভিপি সবাই ওকে খুব পছন্দ করতেন। কয়েক মাসেই অন্য কোম্পানী থেকে বেশ ভালো ভালো ছেলে ভাঙ্গিয়ে এনেছিলো বোধায়ণ! ইউনিভার্সিটি থেকে ভালো ফ্রেশার রিক্রুট করতেও ও ছিলো ওস্তাদ! আমরা অবাক হয়ে যেতাম। আর ছেলেমেয়েরাও বোধায়ণ স্যার বলতে অজ্ঞান! হয়তো আমরা একটা ছেলেকে কিছুতেই বিদেশে পাঠাতে পারছি না, বোধায়ণ তাকে ডেকে কী যে যাদু করতো, সে সঙ্গে সঙ্গে রাজী!”
কথাবার্তা অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে অনিকেত বললেন “তাহলে উনি ছাড়লেন কেন ম্যাডাম?”
অনেক ক্ষণ চুপ করে থেকে সিমিতা বললো “ডেস্টিনি!”
অনিকেত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন। সিমিতা বলতে লাগলো “মহিলা সিনিয়ার ম্যানেজারদের দেখলেও ও সবসময় ‘তোমায় আজ দারুণ লাগছে!’ ‘তোমার দুলটা তো ভারী সুন্দর!’ এ সব না বলে ছাড়তো না, আর বাচ্চা মেয়েদের তো কথাই নেই! কিন্তু সেদিন ও সব লিমিট ছাড়িয়ে গেছিলো!”
“কোনদিন?”
“সেদিন ছিলো আমাদের গ্লোবালসফটের ফাউন্ডেশন ডে! বিদেশ থেকে কিছু বড়ো ক্লায়েন্টও এসেছিলো। সবার অনারে বড়ো পার্টি রেখেছিলেন সিইও একটা ক্লাবে। সবে লোকজন জমছে – বলরুমে সিনিয়ার মেম্বাররা সিইওর আসেপাশে দাঁড়িয়ে ড্রিঙ্ক উপভোগ করছে। ভিপি মিসেস তানেজা একটা সাদা চিকনের অপূর্ব কুর্তা পরে এসেছিলেন। চিকনের কুর্তাটি একটু পাতলা। গলায় একটা মোটা মুক্তার হারে দারুণ লাগছিলো পাঁচ ফুট সাতের মিসেস তানেজাকে! আমরা সবাই অ্যাডমায়ার করছিলাম ওনার ড্রেস সেন্স! বোধায়ণ ওনার একেবারে পাশেই দাঁড়িয়েছিলো। প্রায় ওনার কানের কাছে মুখ নিয়ে কী সব বলছিলো! হঠাত আমরা গল্প করতে করতে দেখি উনি তীব্র বেগে বেরিয়ে গেলেন কাউকে কিছু না বলে আর বোধায়ণ পিছন পিছন! আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি – খানিক পরে বোধায়ণ একা ফিরে এলো। ঘাড় ঝুলে পড়েছে, মুখ কালো!” সেদিন মিসেস তানেজা আর ফিরে এলেন না। সিইও যখন জিজ্ঞাসা করলেন, তখন বোধায়ণ বললো “ওনার শরীর খারাপ লাগায় উনি বাড়ি চলে গেছেন। বোধায়ণকে বলে গেছেন। তারপর পার্টি জমে উঠলো, কারোর আর ওনার কথা মনে রইলো না।“
“কী হয়েছিলো?” তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে অনিকেত।
“পরে অফিসে ক্লোসড রুমে মিসেস তানেজা আমাদের কয়েকজনকে ডিসক্লোস করেন যে বোধায়ণ ওনাকে বলেছিলো ‘আপনার সাদা লুক থ্রু ড্রেসটা দারুণ! আপনার বাস্ট লাইন খুব সুন্দর বোঝা যাচ্ছে! কিন্তু বগলের কাছে একটু সেলাই খুলে গেছে ম্যাডাম! ওড়নাটা একটু জড়িয়ে নিন!’”
“তারপর!”
“তারপর আর কী ? মিসেস তানেজা বলেছিলেন যে এই অসম্মানের বদলা তিনি নেবেন। যাদের সঙ্গে বোধায়ণ ফ্লার্ট করতো সব মেয়ের কাছ থেকে রিটন নিয়ে আমাদের লেডিস সেফটি গ্রুপ মিট করে বোধায়ণকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং আমাকেই সিইওর কাছে সেই রিপোর্ট নিয়ে গিয়ে বোধায়ণকে রিজাইন করতে বলতে রিকোয়েস্ট করতে হয়!”
“বোধায়ণ কিছু বলেনি?”
“সিইও এসব ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। তিনি এতোটাই কড়া ভাবে ওকে বলেছিলেন যে ও চুপ করে মেনে নিয়েছিলো। খালি একটা রিকোয়েস্ট করেছিলো যে ও মিসেস তানেজার কাছে ফরমালি ক্ষমা চাইবে এবং তার বদলে ওর রেপুটেশনের কথা মনে রেখে ওর রেকর্ডে কোথাও যেন এই ঘটনা লেখা না হয়!”
“আই সি!” এর বেশী আর কিছু বলেননি অনিকেত। তাঁর মোবাইলের ভয়েস রেকর্ডার অন ছিলো এতোক্ষণ। এবার বন্ধ করলেন। তবু খটকা বেজে রইলো। গ্লোবালসফট তো রেকর্ডে কোথাও রাখেনি এই ঘটনা। তাহলেও কেন বোধায়ণকে এই ইন্ডাস্ট্রি ও শহর ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে? নাঃ, আরো পিছিয়ে যেতে হবে। চলে যেতে হবে সুপার টেকনোলজি সলিউশনে, যেখানে বোধায়ণ দশ বছর ছিলেন।