|| মানচিত্র আর কাঁটাতার, হৃদয় মাঝে একাকার || বিশেষ সংখ্যায় পার্থ সারথি চক্রবর্তী

স্বপ্নভঙ্গ 

জয়ন্ত মজুমদার টাউন কলেজে ইতিহাস পড়ান। আর দু’বছর চাকরি ।ছাত্র-ছাত্রী মহলে দারুন সুনাম।তাদের পেছনেই জীবনটা পাত করেছেন । স্ত্রীও শিক্ষিকা ।এক ছেলে এম.আই.টি প্রাক্তনী। এখন পাকাপাকিভাবে মার্কিন মুলুকে ডেরা।ছাত্র পড়িয়ে স্বামী- স্ত্রী দু’জনেরই দিন কাটে।
জয়ন্তবাবুর বাপ-ঠাকুর্দা বরাবরই বাগবাজারের বাসিন্দা ।বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার ।বাবার মুখে বরাবর শুনেছেন তাঁর বাবার কথা অর্থাৎ ঠাকুর্দার কথা ।
জনার্দন মজুমদার ছিলেন সেকালের জাঁদরেল হেডমাস্টার।এতটাই যে ছাত্ররা তো বটেই, শোনা যায় বাঘে-হরিণেও এক ঘাটে জল খেত তার ভয়ে । যেমন সৎ, তেমনি জেদী ও একবগ্গা । একবার এক ব্রিটিশ বিদ্যালয় পরিদর্শক তাঁর স্কুলে পরিদর্শন করতে এসে বেগড়বাই করেছিল! তাকে নাকি শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাইয়ে ছেড়েছিলেন । এ’সব বাবার কাছে শোনা ।এহেন লোকটা নাকি ভারতের স্বাধীনতার সময় একদম মুষড়ে পড়েছিলেন ।ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের খুশীও নাকি বেশ খানিকটা ম্লান হয়ে গিয়েছিল ।আসলে বাগবাজার এলাকাতে তার প্রচুর বন্ধুরা ছিল, যারা দেশভাগের সময় ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছিল ।যাদের সাথে আশৈশব বড় হয়ে ওঠা, ৪৫ বছর বয়সে তাদের ছেড়ে চলে যাওয়াটা কিছুতেই মানতে পারেন নি। ভেঙে পড়েছিলেন অনেকটা । একইরকমভাবে , তাঁর অনেক আত্মীয় স্বজনদের ওপার বাংলা ছেড়ে চলে আসতে হয়। স্বাধীনতা লাভ ও দেশভাগ এই অম্ল-মধুর, এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া জনার্দন মজুমদারকে মানসিকভাবে অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছিল ।
শেষের দিকে সমস্ত স্মৃতি জনার্দন লিখে রাখতেন ডায়েরিতে।বাবার কাছ থেকে সেই ডায়েরিটা পেয়েছে জয়ন্তবাবু ।

ডায়েরির পাতা থেকে-
এই শতকে বাঙালির জীবনকে তছনছ করে দেওয়া একটা ঘটনা ‘ দেশভাগ ‘। এক কলঙ্কজনক অধ্যায় । ২০০ বছর ধরে চলা ব্রিটিশ শাসন ভারতকে সার্বভৌমত্ব দিয়ে যায় বাধ্য হয়ে ।কিন্তু যাবার সময়ও তারা কফিনে শেষ পেরেকটাও পুঁতে দিয়ে যায় ।পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হয় ।এতে আরো বেশী করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলা ও পাঞ্জাব । দ্বিখন্ডিত হয় । বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ভেঙে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য (ভারত) ও পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ(পাকিস্তান)গঠিত হয় ।পাঞ্জাব প্রদেশও ভাগ হয়ে পাঞ্জাব প্রদেশ(পাকিস্তান)ও পাঞ্জাব রাজ্য ( ভারত) গঠিত হয় ।১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের ‘বঙ্গভঙ্গ’ র মধ্যে দিয়েই তারা তাদের অভিসন্ধি প্রকাশ করেছিল। স্বাধীনতার সময় তাই দেশভাগকে ‘ পার্টিশন ‘ না বলে ‘ ফ্র্যাগমেন্টেশন ‘ বলা উচিত ।কেননা টুকরো টুকরো করা হয় এই ভূখণ্ডকে। সারা বিশ্বকে শাসন করা ব্রিটিশরা যে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ এর ঠিকাদার !

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ব্রিটিশরাজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে, ভারত থেকে তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে নেবে।আন্তর্জাতিক রাজনীতির মেরুকরণ এবং তার সাথে ভারতজুড়ে ব্যাপক আন্দোলন তাদের এমনটা ভাবতে বাধ্য করেছিল।১৯৪৫ র ডিসেম্বরেই ভাইসরয় ওয়াভেল ক্ষমতা হস্তান্তরের ইঙ্গিত দিয়ে দেন।তিন মাসের মধ্যেই ভারতে আসে কেবিনেট মিশন।তাদের প্রস্তাবেই ছিল ভারত বিরোধী বীজ। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ অনড় অবস্থান নেওয়াতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগস্ট কলকাতার বুকে যে দাঙ্গার সূত্রপাত হয়, তার আগুন ছড়িয়ে পড়ে ধিকিধিকি ।চেনা মুখগুলো অচেনা হতে শুরু করে । বিশ্বাসের ভিত নড়ে যায় । প্রভাব গিয়ে পড়ে নোয়াখালী এবং বিহার, উত্তরপ্রদেশে।
আমরা বিলক্ষণ বুঝেছিলাম,১৯৪৬ র অক্টোবরে গঠিত জোড়াতালির সরকার চলবে না ।১৯৪৭ র শুরুতে ব্রিটিশরা অন্য রকম ভাবতে শুরু করে ।ভাইসরয় হয়ে আসেন মাউন্টব্যাটেন। তিনি বুঝতে পারেন যে দ্রুত ব্যাবস্থা না নিলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে । সিদ্ধান্ত নেন, তিন মাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।এক বছর ধরে চলতে থাকা জাতিদাঙ্গা-হত্যা-লুন্ঠন-নির্যাতন মিলিয়ে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করে এই দেশ। বাংলা ও পাঞ্জাব হয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত । বাংলার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া হলো ।শুধু ভৌগোলিক কারণেই নয়, স্বাধীনতা আন্দোলনে এই দুই প্রদেশের মানুষের নেতৃত্বদানও ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট ছিল ।

দেশভাগ যেন স্বাধীনতার আনন্দকে মাটি করে দিয়েছিল ।এতে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকাকে আতসকাঁচের নীচে নিয়ে আসা উচিত । এই দুর্বল, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ইংরেজদের সুবিধা করে দিয়েছিল, চিরতরে ভারত ছাড়ার আগে চিরস্থায়ী বিভেদের বীজ বপন করে দিতে । ‘দেশভাগ ‘ কি দিল? বিভক্ত ভারত না স্বাধীনতা? নাকি দু’টোই!
আমার চোখে তখন ঘুম উবে গেছে ।চারদিক থেকে শুধু খারাপ খবর। মানুষের মিছিল করে নিজ ভূমি ত্যাগ ।লোটা-কম্বল বগলদাবা করে শুরু নতুন যাত্রা । কেউ জানে না কোথায় মিলবে নিরাপদ আশ্রয় ।কিভাবে হবে খাদ্যের জোগাড় । সময় যেন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে সবাইকে! যে স্বপ্ন সযত্নে -লালিত, তাই আজ ভুপতিত! রাতের অন্ধকারে হেঁটে, ট্রেন বোঝাই করে অজানা নিরূদ্দেশ যাত্রা । সুযোগ বুঝে শ্বাপদেরা নখ ও দাঁতে শান দিচ্ছে ।মানুষ বুঝতে শুরু করে, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি এবার ছাড়তে হবে । জন্ম হয় এক নতুন শ্রেণী-উদ্বাস্তু । এ যেন আমার বুকটাকে দু’ভাগ করে দেওয়া ।হৃদয়ের স্পন্দন তো আছে, কিন্তু কোন ছন্দ নেই । কত আগুন, কত ধোঁয়া, কত ছাই ………! এর মধ্যেও কিছু মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছেন। শিবির করছেন, লোকের খাদ্যের যোগানের চেষ্টা করছেন । মানুষের মনে বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করার আমরণ প্রয়াস চালাচ্ছেন । হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল , তবুও।

পড়তে পড়তে জয়ন্তর গলা ধরে আসে। ঠাকুর্দার ডায়েরি ছাড়াও বিভিন্ন লেখায় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন পূর্ব পাকিস্তান থেকেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেদের ভিটে ছেড়ে আসার অবর্ণনীয় কষ্টের কথা! কি বেদনাদায়ক ও করুণ সেসব কাহিনী ।সাহিত্য ও শিল্পক্ষেত্রেও এর প্রভাব অনস্বীকার্য ।দেশভাগের ২০ বছর পর ‘ জোতির্ময়ী দেবী’র উপন্যাস ‘ এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা ‘ প্রকাশিত হয় । সংস্কৃতির জগতে যে বিশাল গহ্বর সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভরাট হতেও বহু কাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল।

২০০ বছরের ব্রিটিশরাজ শেষ করে দেশকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে হাজার-হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী যে অবলীলায় তাদের প্রাণের আহুতি দেন, তার মূল্যে এই দ্বিখন্ডিত স্বাধীনতা! তাদের রক্ত, ঘাম, জীবনের বলিদানকে অনেকাংশে ম্লান করে দেয় এই ‘দেশভাগ ‘। জয়ন্তবাবু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ভাবেন, যিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন ।

জয়ন্তবাবু যেন কোথায় হারিয়ে যেতে থাকেন ……..।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।