T3 || রবি আলোয় একাই ১০০ || সংখ্যায় তপশ্রী পাল

রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন

পঁচিশে বৈশাখের সকালে হৈ হৈ পড়ে গেছে শান্তিনিকেতনে! উত্তরায়ণে সকালবেলা রবি ঠাকুরকে একটি নতুন ল্যাপটপ সামনে নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে! তাঁকে প্রথম দেখে মিউসিয়ামের একজন কর্মী! প্রথমে সে ভেবেছিল চোখের ভুল! পরে দেখা গেল সত্যিই দোতলায় তাঁর লেখার টেবিলের সামনে একটু ঝুঁকে সেই পরিচিত ভঙ্গীতে বসে আছেন রবি ঠাকুর। তাঁর মুখে গভীর চিন্তা ও বিস্ময়ের ছাপ! আশ্রমের গেটে হাজার হাজার লোক জমে গেছে! সাংবাদিকরা পৌঁছে গেছেন! আছেন বিশ্বভারতীর শিক্ষক ও ছাত্ররা! সাধারণ মানুষ, মায় সাঁওতাল ছেলেরা পর্যন্ত জড়ো হয়েছে তাঁদের প্রাণের মানুষটিকে একবার দেখার জন্য! বাধ্য হয়ে পুলিশে খবর দিতে হয়েছে। পুলিশ এসে গেট সিল করে দিয়েছে। মানুষজনের মনে অদম্য কৌতুহল, কিন্তু কেউই চায় না কবিগুরু বিরক্ত বা উত্যক্ত হন। তাই সবাই ফিরে গেছে আপাততঃ। তিনি যদি সত্যিই ফিরে এসে থাকেন তবে কিছু তো ঘোষণা হবেই। তখন সঠিক জানা যাবে।
যে কর্মী তাঁকে প্রথম দেখে, সে দোতলায় এসে লক্ষ্য করে যে কবি এক মনে ল্যাপটপে কী একটা লিখে চলেছেন আর ল্যাপটপের পাশে রাখা আছে একটি প্রিন্টারও! দুপুর নাগাদ কবি টেবিলে রাখা ঘন্টাটি বাজালেন। এক কর্মী ছুটে এল। তিনি তার হাতে দুটি কাগজ দিয়ে বললেন সে দুটি পোস্ট করে একটি ঠিকানায় পাঠাতে। ঠিকানাটি কলকাতার। সেটি এরকম –
রবিপ্রেমিক ভূতচর্চা সমিতি
প্রযত্নে ঋত্বিক মজুমদার
১ বিমল বসু লেন
কলকাতা – ১৪

খানিক পরে দুপুরবেলা কবিগুরু কী খাবেন সেই খোঁজ নিতে এসে কর্মীরা দেখল, কোথায় কে? কবিগুরুর চেয়ার যেমনকার তেমন পড়ে আছে। তিনি কোথাও নেই! তবে কি তিনি শুধু ঐ চিঠিটি লিখতেই এসেছিলেন? পড়ে আছে সেই ল্যাপটপ এবং প্রিন্টারও! গোটা শান্তিনিকেতন এবং গোটা কলকাতায় কেউ বুঝতে পারলেন না এই রহস্য! কিন্তু তার দিনকয়েক পর বিখ্যাত দৈনিক কাগজ “নতুন ভোরের” দপ্তরে এলেন এলোমেলো বড় বড় চুল দাড়ি, বড় বড় চোখ, ফরসা, ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত এক ব্যাক্তি। বললেন “আমার নাম ঋত্বিক মজুমদার। আমি কবিগুরুর একটি চিঠি পেয়েছি!” সবাই তো তাঁকে পাগল ঠাউরে প্রায় তাড়িয়ে দেয়! কিন্তু তারপর সবাই ভাবল কদিন পূর্বে কবিগুরুর হঠাত আগমনের সঙ্গে এবং চিঠি পাঠানোর রহস্যের সঙ্গে লোকটির যোগ থাকতে পারে!

অবশেষে যা জানা গেল তা এরকম। ঋত্বিক ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা প্রবল রবীন্দ্রভক্ত। রবীন্দ্রনাথের সব রচনা তাঁরা গুলে খেয়েছেন। শয়নে স্বপনে তাঁদের আদর্শ রবি। অন্ধ ভক্তি থেকে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয় যে যদি কোনভাবে রবীন্দ্রনাথকে আবার ফিরে পাওয়া যায়, অন্ততঃ একদিনের জন্য! তাঁরা সবাই আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। হঠাত তাঁদের মনে হয় যে যদি প্ল্যানচেট করে রবি ঠাকুরকে একবার ডাকা যায়! তাহলে কত কী জানা যায় তাঁর কাছ থেকে! একজনের মাথা থেকে বুদ্ধি বেরোয় যে কবিগুরু যদি প্ল্যানচেটে সাড়া দিয়ে নেমে আসেন, তাহলে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হবে যে তিনি আজকের দিনে জন্ম নিলে এবং তাঁর কাছে যদি ল্যাপটপ এবং প্রিন্টার থাকত তাহলে তাঁর লেখায় কি তিনি তা ব্যবহার করতেন? অবশেষে এক অমাবস্যার রাতে তাঁরা এক শক্তিশালী মিডিয়ামকে নিয়ে প্ল্যানচেট করেন এবং বহু চেষ্টার পর রবীন্দ্রনাথের আত্মা তাঁদের সঙ্গে কথা বলে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত আধুনিকমনস্ক একজন মানুষ। তিনি তাদের প্রস্তাবে অত্যন্ত উৎসাহিত হন এবং একটি ল্যাপটপ ও প্রিন্টার শান্তিনিকেতনে তাঁর লেখার ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেন। এরপর সেই চিঠিটি কবিগুরু লেখেন।

প্রিয়বরেষু ঋত্বিক,

তোমরা আমাকে ও আমার লেখাকে যারপরনাই ভালবাসো এবং বহুদিন পরে আমাকে জাগাইয়া তুলিয়াছ ও আহবান করিয়াছ এতে আমি অতিশয় প্রীত হইয়াছি। নহিলে এখন বঙ্গবাসী আমার সকল লেখা, গান ইত্যাদি চর্বিতচর্বণ করিয়া ফেলিতেছে এবং সেগুলি তাহাদের যে ভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করিয়া খ্যাতি অর্জন করিতেছে, কিন্তু আমি কেমন আছি সে খোঁজ লইবার প্রয়োজন বোধ করে নাই।
তোমরা জান আমি হৃদয়ে চিরনবীন এবং নূতনকে সর্বদা আপন করিয়া লইতে ভালবাসি। তাই তোমাদের অভূতপূর্ব প্রস্তাব পাইয়া আমার প্রভূত আহ্লাদ হইয়াছিল! আমি অবগত আছি যে বর্তমানে প্রযুক্তি বহুগুণ অগ্রসর হইয়াছে এবং একবিংশ শতাব্দীতে কম্পিউটার নামক একটি যন্ত্র আসিয়া সর্বকার্যে বিপ্লব লইয়া আসিয়াছে! এ যেন এক যন্ত্রমানব যাহার মস্তিষ্ক মানব অপেক্ষা বহু কোটি গুণ সত্ত্বর কাজ করে এবং মানবের কাজ সে লক্ষগুণ সহজ করিয়া দেয়! ইহার সকল গুণ পরখ করিতে হইলে আমাকে সত্যই ধরাধামে আবার জন্ম লইতে হইবে হয়ত অন্য কোন রূপে। কিন্তু তাহা হইলে তো আমি তোমাদিগের রবি ঠাকুর থাকিব না এবং এই পুনর্জন্ম আমার হাতেও নাই। তাই তোমাদের যে প্রশ্ন, অর্থাৎ আমি আজ থাকিলে এবং আমার সম্মুখে একটি কম্পিউটার থাকিলে আমার লেখার কীরূপ পরিবর্তন হইত তাহারই সামান্য উত্তর দিবার চেষ্টা করিব। তোমরা জানই আমি যে কোন জিনিস সহজেই শিখিয়া লই। তাই এই যন্ত্রটি চালাইতেও আমাকে বিশেষ বেগ পাইতে হয় নাই।
আজ সকালে এই চিঠিটি লিখিতে তোমা প্রদত্ত ক্ষুদ্র যন্ত্রটি যাহার ইংরাজী নাম ল্যাপটপ, (আমি তাহার নামকরণ করিয়াছি “কোলের বাছা”) সামনে বসিলাম এবং কীবোর্ডে টাইপ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, প্রথমেই মনে পড়িল আমাদের যুগেও টাইপরাইটার বলিয়া একটি যন্ত্র আসিয়াছিল এবং বহুল ব্যবহৃত হইতেছিল। এই কীবোর্ডের সহিত তাহার বড়ই মিল! সঙ্গে তোমরা অভ্র বলিয়া বাংলায় লিখিবার একটি প্রকরণও দিয়াছিলে! তাই কাজ সহজ হইয়াছিল। কিন্তু লিখি আর সংশোধন করি, যখন যেখানে প্রয়োজন! কাটাকাটি করিবার কোনরূপ বালাই নাই! ইচ্ছা হইলে সম্পূর্ণ উড়াইয়া দিয়া নতুন করিয়া লিখি! কোন কাগজ ক্ষয় নাই, হাতে এক ফোঁটা মসীলিপ্ত হইবার আশংকা নাই! কিন্তু তবু ঋত্বিক আমাকে বলিতেই হইল যে আমি আজ বাঁচিয়া থাকিলে এই যন্ত্র ব্যবহার করিতাম না। এইবার তাহার কারণগুলি বলি।

তোমরা জানো আমি লিখিতে লিখিতে কাটাকাটি হইলে সেগুলির উপর কাল কালি দিয়া ফুল লতা পাতা বানাইয়া এক নতুন ধরণের শিল্প সৃষ্টি করিতে ভালবাসি! আমার বইয়ের পান্ডুলিপিতে এই শিল্প সর্বত্র। এ আমার পান্ডুলিপির এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ! ভুল হইতেই তো ঠিকের জন্ম। ভুল বলিয়াই কি তাহাদের নিঃশেষে মুছিয়া ফেলিতে হইবে? কিন্তু এই যন্ত্রে লিখিলে এই শিল্প চিরতরে মুছিয়া যাইবে! আমি তাহা চাই না।
দ্বিতীয়তঃ আমার হস্তলিপি! এই হস্তলিপি আমার পরিচয় বহন করে! রাবীন্দ্রিক হস্তলিপি কতজন অনুকরণ ও অনুসরণ করে তোমরা জানো? লেখা এই হস্তলিপি আমি অনেক অধ্যাবসায়ে তৈয়ারী করিয়াছি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে। ইহাকে আমি বিসর্জন দিতে পারিব না। ছাপা অক্ষর বড় নৈর্ব্যাক্তিক! সে কারো আপন হইবে না কখনো! তাহার হৃদয় নাই, অনুভূতি নাই, সে কবির কান্না, হাসির দোলে দোলায়িত হয় না!
সর্বশেষ হইল গতি! যত অভ্যাস তত কীবোর্ডে টাইপ করিবার গতি বাড়িবে! তত আমি লিখিতে পারিব! ইহা বড়ই লোভনীয়! আমি যে পরিমাণ সাহিত্য সৃষ্টি করিয়াছি, তাহার দশগুণ হয়ত সৃষ্টি করিতে পারিব যদি যন্ত্র ব্যবহার করি! কিন্তু পরিমাণই কি লিখিবার মাপকাঠি? বর্তমানে যাহারা লিখিতেছে তাহারা কয়জন অমরত্ব পাইতেছে? পাইতেছে না, তাহার কারণ তাহারা বৎসরে বৎসরে দশটি করিয়া গ্রন্থ প্রকাশ হয়ত করিতেছে, কিন্তু তাহার অন্দরে কী সারবত্তা আছে, পাঠকের তাহা কেমন লাগিতেছে, সেদিকে ফিরিয়া তাকাইবার তাহাদের অবসর নাই। সাহিত্যের মূল কথা হইল তাহার গুণমান! সেটি পাইবার জন্য আমি একটি লেখনী কাটিয়া কাটিয়া সম্মার্জনা করিয়া করিয়া এক বৎসর কাল কাটাইতে পারি। আবার কোন সময় হয়তো এক রাত্রেও একটি অপূর্ব কবিতা আমার কলমে উঠিয়া আসিল! ইহা সম্পূর্ণ তাঁহার দান! যন্ত্রের সাধ্য কী ইহা নিয়ন্ত্রণ করে? এই লইয়া একদা আইনস্টাইনের সহিত আমার ব্যাপক মত পার্থক্য হইয়াছিল তোমাদের স্মরণে থাকিতে পারে।
তোমরা কহিবে যন্ত্রমানবের মস্তিষ্কে সবই জমাইয়া রাখা যায়! কোন লেখনী হারাইবার সম্ভাবনা নাই! ইহা এক বিরাট সুবিধা! কিন্তু আমি কহিব “যা হারিয়ে যায়, তা আগলে বসে রইব কত আর”! হারানো যাহার ভবিতব্য তাহাকে হারাইতে দাও। কত গুনীজন হারাইয়া যায় কালের অতলে, লেখনী তো সে তুলনায় ক্ষুদ্র!

আশা করি আমি আমার মত প্রকাশ করিতে পারিয়াছি। তবে তোমাদিগকে আশীর্বাদ করি যে তোমরা প্রযুক্তির এই আশীর্বাদ আপন করিয়া লইয়া ইহার ভাল গুণগুলি ব্যবহার কর। কিন্তু এই বৃদ্ধকে তাহার মতই থাকিতে দাও। এই বলিয়া আজ বিদায় লই –
“আমায় থাকতে দে না
আপন মনে আমায় থাকতে দে
আমায় থাকতে দে না”

ইতি
তোমাদিগের
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।