ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ১২)

আলাপ

এবার সেই বিখ্যাত কিরানা ঘরানার কথা, যার পরতে পরতে স্বরের শুদ্ধতা ও পবিত্রতা, বিখ্যাত শিল্পীর ভীড় এবং যে ঘরানার কোণে কোণে লুকিয়ে আছে আশ্চর্য সব গল্প! উত্তরপ্রদেশের সাহারাণপুরের কাছে একটি ছোট্ট শহর কিরানা বা কৈরানা। সেটিই এই বিখ্যাত ঘরানার জন্মস্থান। ঘরানার ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে বসলে পৌঁছে যেতে হয় সেই তেরোশো শতাব্দীতে। সেই সময়ের এক ধ্রুপদিয়া গোপাল নায়েক, যিনি আদতে হিন্দু হলেও পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন মূলত সুফি সঙ্গীতের টানে। পরে তিনি মুসমমানী খেয়াল গায়নের স্টাইল আত্মীকরণ করেন এবং কিরানা ঘরানার জন্ম দেন। এঁরই বংশধর হলেন গুলাম আলি, গুলাম মৌলানা এবং বীণকার উস্তাদ বন্দে আলি খান।
উস্তাদ বন্দে আলি খানের পুত্র ছিলেন কালে খান এবং তাঁর দুই পুত্র আব্দুল করিম খান ও আব্দুল ওয়াহিদ খান। আব্দুল করিম খানই ঘরানাটিকে অতি বিখ্যাত করেন। তাঁর জন্ম হয় ১৮৭২ সালে।
আব্দুল করিম খানই সেই শিল্পী যার বিশাল পাগড়ী কোট আচকান পরিহিত বিশাল গুম্ফ সম্বলিত চেহারা গ্রামোফোনের রেকর্ডের ওপরে দেখে ছোটবেলায় বেশ ভয় পেয়েছিলাম এবং ভেবেছিলাম খুব জাঁদরেল গলা হবে তাঁর! কিন্তু রেকর্ড বাজতেই দেখি অতি সরু, প্রায় মেয়েলী গলার আওয়াজ তাঁর! সেই শিশু বয়সে ভালো লাগেনি অমন চেহারার সঙ্গে সেই আওয়াজের অমিল! কিন্তু পরে বড় হয়ে বুঝেছি সেই গায়নের রস! কী সুমিষ্ট মেলোডিয়াস আওয়াজ! তিন সপ্তকবিহারী অনায়াস গলা, স্বরের শুদ্ধতা এবং বিদ্যুতের মতো তান!
যাই হোক আব্দুল করিম খানের শিক্ষা শুরু হয় তাঁর দাদু বন্দে আলি খান এবং পিতা কালে খানের কাছে। প্রথমে বেশ কিছুদিন তিনি সারেঙ্গীবাদক হিসাবে শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং সারেঙ্গী বাজান। কিন্তু সঙ্গতকার শিল্পীদের সম্মান না থাকায় তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতে উদ্যোগী হন। তিনি কিরানা ঘরানার বৈশিষ্টগুলি অর্থাৎ স্বরের বিশুদ্ধতা, অতি ধীরে সুমিষ্ট স্বরে স্বরবিস্তার করে বিলম্বিত গায়ন, আবেগসম্পন্ন পুকার ইত্যাদিকে তো এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে গেলেনই তাঁর অতি সুরেলা ত্রিসপ্তকবিহারী অনায়াস কন্ঠসঞ্চালনে, সঙ্গে যোগ করলেন অদ্ভুত দক্ষতায় সরগম তান বা বোলতান। প্রধাণত কর্ণাটকী সঙ্গীত থেকে তিনি এই স্টাইলটি নিয়েছিলেন। কিন্তু সে তো পরের কথা। খুব কম বয়সেই তাঁর সম্পর্কিত ভাই আব্দুল ওয়াহিদ খানের বোন গফুরান বেগমের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু এরপর আর খুব বেশীদিন আব্দুল করিম খান কিরানায় থাকেননি। একটু বড় হতেই তাঁর অপূর্ব গলা এবং সঙ্গীতের কথা গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাজার দরবারে তাঁর ডাক পড়তে থাকে। এরকমই একটি লম্বা যাত্রায় তিনি ঘুরতে ঘুরতে বরোদার রাজা গাইকোয়াড়দের দরবারে গিয়ে পড়েন। রাজা তাঁর সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সভাগায়ক করেন এবং তাঁকে দীর্ঘদিন থেকে যেতে অনুরোধ করেন। বাধ্য হয়ে আব্দুল করিম খান বরোদায় বসবাস শুরু করেন।
একদিন তিনি ভোরবেলায় যখন ললিত রাগে আপনমনে রিওয়াজ করছেন, তখন হঠাত চোখ খুলে দেখেন পাতলা পর্দার আড়ালে একটি সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে! সে যেন গান শুনে চিত্রার্পিত! আব্দুল করিম খান ভাবলেন এ কোন মানবী হতে পারে না। তবে কি কোন হুরী নাকি কোন মূর্তি? তিনি হঠাত গান বন্ধ করে দিতেই চমক ভাঙ্গে সেই নারীর এবং তিনি দৌড়ে পালিয়ে যান। এরপর প্রায় প্রতিদিনই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। একদিন কৌতুহল বশে আব্দুল করিম তাঁকে ডাকলেন। মেয়েটি ধীরে ধীরে সামনে এসে বসলো । গালদুটি লজ্জায় লাল। আব্দুল করিম তাঁকে পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন সে বরোদার রানীর সম্পর্কিত বোন এবং রাজসভার বিশিষ্ট মন্ত্রী সর্দার মারুতি রাও মানের কন্যা তারাবাঈ! যে মেয়ে সঙ্গীতে এমন মুগ্ধ, সে নিশ্চই নিজেও গান গায়! আব্দুল করিম খানের অনুরোধে তারাবাঈ একদিন শোনান তাঁর গায়ন! অপূর্ব মিষ্টি গলা! অচিরেই গভীর প্রেমে পড়েন দুজন। কিন্তু সেই যুগে এক মুসলমান গায়কের সঙ্গে হিন্দু রাজপরিবারের কন্যার বিবাহ ছিলো চরম গর্হিত অপরাধ এবং কোনভাবেই কেউ তাতে সম্মত হবে না তা তাঁরা বুঝতেই পেরেছিলেন। এই সময় তারাবাঈয়ের মা মারা যান এবং তাঁর পিতা অতিরিক্ত পানাসক্ত হয়ে পড়েন। তিনি তারাবাঈকে নানাভাবে অত্যাচার করতেও শুরু করেন আব্দুল করিমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা সন্দেহ করে। তারাবাঈ তখন মন্ত্রমুগ্ধ আব্দুল করিমের সুরের যাদুতে, অপর দিকে তাঁর পক্ষে পিতার সঙ্গে বসবাস অসহ্য হয়ে পড়ে। একদিন সমাজ সংসার তুচ্ছ হয়ে গেলো তাঁর কাছে। তিনি আব্দুল করিমকে বলেন তাঁকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। প্রায় শেষরাতে সবার চোখের আড়ালে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করলেন দুজন, ট্রেনে করে পালিয়ে গেলেন বরোদা থেকে। নিকাহ করে বাসা বাঁধলেন প্রথমে কোলাপুরে এবং তারপর মীরাজ হয়ে মুম্বইতে। বরোদার রাজা যথেষ্ট উদারপন্থী ছিলেন এবং প্রেমিকযুগলকে এর পরেও কোন শাস্তি দেননি।
মুম্বইতে বসবাস শুরু করার পরই আব্দুল করিম খান মাইসোরের ওয়াদলেয়ার রাজাদের থেকে নিমন্ত্রণ পান এবং মাইসোরের সভায় সঙ্গীত পরিবেশন করতে যান। রাজা তাঁর সঙ্গীতে মুগ্ধ হন এবং এরপর নিয়মিত তাঁর সভায় আব্দুল করিম খানের যাতায়াত চলতে থাকে। রাজার সভায় ভূগন্ধর্ব নামে পরিচিত উস্তাদ রেহমত খানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং কর্ণাটকী স্টাইলে শ্রুতির ব্যবহার এবং বিচিত্র সরগম তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি নিজের সঙ্গীতে এইগুলি নিয়ে আসেন ও অসাধারণ বুননে সরগম তান করতে শুরু করেন। তাঁর অপূর্ব সুললিত মেলোডিয়াস গলা, ত্রিসপ্তকবিহারী গায়ন, বিশুদ্ধ স্বরে বিস্তারের সঙ্গে এই সরগম তান তাঁকে এক অসাধারণ খেয়াল গায়ক হিসাবে পরিচিত করে। তিনি কয়েকটি রাগ বেছে নেন, যেগুলি তাঁর এই স্টাইলে সবচেয়ে বেশী খাপ খেতো, যেমন পুরিয়া, মারোয়া, কল্যান, মালকৌশ, ললিত, টোড়ি, আশাবরী ইত্যাদি। কোন সভায় তাঁর তানপুরা বাঁধা বিখ্যাত হয়ে যায় সেই সময়। তিনি তানপুরাতে অনেক সময় নিয়ে একেবারে নিখুত স্বর বাঁধতেন। ষড়জ ছাড়াও, একটি তানপুরা পঞ্চমে এবং একটিতে নিষাদে বাঁধতেন, যাতে সম্পূর্ণ সপ্তকের সুর চারিদিকে ছেয়ে থাকে। তিনি বিলম্বিতে অতি ধীরে রাগবিস্তার শুরু করতেন এবং কথিত ছিলো তাঁর স্বরসংস্থান এতোই শুদ্ধ ছিলো যে তানপুরা বেসুরো হতে পারে কিন্তু তিনি হবেন না। এরপর তিনসপ্তকে রাগ বড়হত শেষে ঐ বিচিত্র সরগম তানকারী! এই নিয়েই গড়ে ওঠে কিরানা ঘরানার সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট।
তারাবাঈয়ের সঙ্গে আব্দুল করিম খানের পাঁচটি সন্তান হয়। তাঁরা একটি তিনতলা হাভেলীতে বসবাস করতে শুরু করেন এবং এরই একতলায় ছিলো তাঁদের সঙ্গীত শিক্ষা নিকেতন “আর্য সঙ্গীত বিদ্যালয়”। সেখানে গরীব অথচ প্রতিভা আছে এমন ছাত্রছাত্রীদের বিনা খরচে সঙ্গীত শিক্ষা দিতেন উস্তাদজী। সেই সময়ে আব্দুল করিম খানের বিখ্যাত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন সওয়াই গন্ধর্ব, বাসবরাজ রাজগুরু, বালকৃষ্ণবুয়া ইত্যাদি।
তারাবাঈ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে এবং সঙ্গীত বিদ্যালয় সামলাতে ব্যস্ত থাকতেন আর আব্দুল করিম গোটা ভারতবর্ষ ঘুরে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। খুব কম সময়েই বাড়ি থাকতে পারতেন। এতে তারাবাঈয়ের ওপর খুব চাপ পড়তো। টাকা পয়সাও ঠিকমতো পেতেন না অথচ সংসারের সব এবং এতোগুলি ছাত্রছাত্রীর খরচ তাকেই সামলাতে হতো। তাঁকে সাহায্য করতেন আব্দুল ওয়াহিদ খান। আব্দুল করিম চাইতেন যে তাঁর সন্তানেরা যেন সঙ্গীতজ্ঞই হয়। তিনি তাঁদের ভালোবাসতেন এবং বৈঠকে বড়ো ছেলেকে গাইবার সুযোগও করে দিতেন। তিনি এও চাইতেন যে তাঁরা যেন পুরোপুরি মুসলিম ঘরানায় মানুষ হয়। তারাবাঈয়ের পক্ষে ছেলেমেয়েদের এভাবে মানুষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অবশেষে আব্দুল করিম খান নেশাসক্ত হতে শুরু করেন। তারাবাঈ সন্দেহ করেন যে তিনি অন্য কোন নারীর প্রতি আসক্তও ছিলেন এই সময়। এইসব নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ ক্রমে বেড়ে ওঠে ও একদিন বাইশ বছরের বিবাহিত জীবন পিছনে ফেলে রেখে তারাবাঈ মানে পাঁচ সন্তান নিয়ে গৃহত্যাগ করেন ও বরোদায় ফিরে যান। আব্দুল করিম খানের বয়স তখন ঊনপঞ্চাশ। তিনি চরম আঘাত পান। এরপর তাঁর সঙ্গীতে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা, ধ্যানময়তা ও তীব্রতা আসে। তিনি সঙ্গীতের মধ্য দিয়েই দুঃখকে জয় করেন। উস্তাদজী এই সময় ১৯২০ সালে মুম্বাইয়ের হাভেলী ছেড়ে মীরাজে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন।
তারাবাঈ মানে তাঁকে ত্যাগ করার পর সব পুত্রকন্যার ইসলামী নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নামেই তাঁদের পরিচিতি ঘটান। তিনি একাহাতে দারিদ্র সহ্য করে সন্তানদের মানুষ করেন। পাঁচ সন্তানের নাম হয় পুত্র সুরেশবাবু মানে, কৃষ্ণরাও মানে, কন্যা হীরাবাঈ বরোদেকর, কমলাবাঈ বরোদেকর এবং সরস্বতী রানে। সুরেশবাবুর কন্ঠস্বর ও গায়কী ছিলো তাঁর পিতার মতোই। কিন্তু পিতাকে ত্যাগ করার যন্ত্রনা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনিও নেশাসক্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁর সঙ্গীত জীবন সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি। কিন্তু হীরাবাঈ বরোদেকর সঙ্গীতকে আপন করে নিয়েছিলেন এবং কিরানা ঘরানার গায়কীকে এক নতুন শিখরে পৌঁছে দেন। তিনিই প্রথম মহিলা যার আসর মানুষ টিকিট কেটে শুনতে যেতো সেই সময়ে। তিনি নাটকের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সুরেশ বাবুকেও কয়েকটি নাটকে অভিনয় ও গান করান। হীরাবাঈ অল ইন্ডিয়া রেডিওর টপ গ্রেড শিল্পী হন। সরস্বতী রানেও খেয়াল গায়িকা হিসাবে বিখ্যাত হন।
আব্দুল করিম খানের জীবনের শেষের দিকে গ্রামোফোন রেকর্ড আসতে শুরু করে এবং ৭৮ আর পি এম রেকর্ডে উস্তাদ আব্দুল করিম খান তাঁর বিখ্যাত রাগগুলি রেকর্ড করতে শুরু করেন। তাই তো আমরা শুনতে পাই কিরানা ঘরানার স্টাইলে অপূর্ব বসন্ত, মারোয়া, পুর্বী এবং ললিত উস্তাদজীর কন্ঠে। আব্দুল করিম খানই প্রথম তাঁর স্টেজ প্রোগ্রামে খেয়ালের পর ঠুংরী, ভজন ও মারাঠী গান শোনাতে শুরু করেন। তাঁর ঠুংরীর বৈশিষ্ট ছিলো, তা পূরব অঙ্গের ঠুংরী বা বেনারস ঘরানার ঠুংরীর থেকে একেবারে অন্যরকম ছিলো। আবার পাঞ্জাবী ঠুংরীর সঙ্গেও তার মিল ছিলো না। তাঁর ঠুংরীর বাড়হত ছিলো ধীর লয়ে, সুরের বিচিত্র জাল বুনে এবং হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটকী স্টাইলের মিশ্রণে। খান সাহেবের কিছু ঠুংরী প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়, যেমন ঝিঁঝোটি রাগে “পিয়া বিন নাহি আওত চৈন”।
১৯৩৭ সালে পন্ডিচেরী যাওয়ার পথে স্টেশনেই উস্তাদজী প্রচন্ড বুকের ব্যাথায় আক্রান্ত হন এবং সজ্ঞানে সঙ্গীত শুনতে শুনতেই প্রাণত্যাগ করেন। শেষ হয় কিরানা ঘরানার সম্রাট উস্তাদ আব্দুল করিম খানের জীবনকাহিনী।
কিন্তু কিরানা ঘরানার কথা তো শুধু আব্দুল করিম খানের সঙ্গে শেষ হয় না। অনেক ঐতিহ্য এই ঘরানার। অনেক বিখ্যাত শিল্পীর উঠে এসেছেন এই ঘরানা থেকে। তাই এরপর লিখবো তেমনি ভারত বিখ্যাত এই ঘরানার আরো এক শিল্পীর কথা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।