জন-জনি জনার্দন সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ৩২)

কখন তোমার আসবে টেলিফোন

পর্ব – ৩২

সাদাকালো ছবির সেই নস্ট্যালজিয়া মনে পড়ে? ‘পিয়া নে গয়া রেঙ্গুন/ উঁহা সে কিয়া টেলিফুন/ তেরা ইয়াদ সতাতে হ্যায়।’ তেমনি ‘জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে/ তেরি আঁখো কে দিয়ে’ কিংবা ‘রিমিঝিমি গিরে শাওন’- এইসব চরম রোম্যান্টিক গানের মুখ্য চরিত্রে কে ছিল বলুন তো? একটা কালো গোবদা টেলিফোন। কি অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স! এর ওপর দিয়ে কত বিরহ, কত অশ্রুপাত, কত নিষিদ্ধ দুপুর, কত বৃষ্টিমুখর সন্ধে, কত গোপন রাত্রি বয়ে গেছে, তবু এই গৃহফোনটি তার গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই সুলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখেছে কী এক জাদুতে।
শুধু কি প্রেম? ছেঁদো গৃহবিবাদ থেকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, সমস্ত লাফড়ার মূলে এই যন্তরটি। সামনাসামনি কথা বলে যে সমস্যা দুমিনিটে সমাধা হয়ে যায়, ফোনে ফিসফিসিয়ে, ইনিয়েবিনিয়ে বলা সেই একই কথা কি ভীষণ অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে পারে!ফোন যে মন পড়তে পারে না। তাতেই এত বিপত্তি।নিয়মিত সিরিয়াল দেখেন যাঁরা, তাঁদের নিশ্চয় বলে দিতে হবে না, কুচক্রী কাকিমনি, ছোটিবুয়া, রাঙ্গামাসিরা এই ফোন মাত্র সম্বল করে ঘরে ঘরে কি অনর্থ ঘটিয়ে চলেছেন। ‘সাত পাকে বাঁধা’ সিনেমায় মেয়ের তাৎক্ষণিক খবরাখবর নেবার জন্যে তার বাড়ি টেলিফোন বসিয়ে ছায়া দেবী তো মেয়ের সংসারটাই ভেঙে দিলেন। যেকোন কথা তক্ষুনি জানতে হবে ও জানাতে হবে, প্রযুক্তির এই সুবিধেটুকু বড় বড় ক্ষেত্রে যতটা কাজের, ব্যক্তি পরিসরে ততটাই অকাজের, যদি ব্যবহার না জানা থাকে। এর থেকে ঢের ভালো ছিল ‘যাও পাখি বল তারে/ সে যেন ভোলে না মোরে’ কিংবা ‘কবুতর যা যা যা, পহেলি পেয়ার কি পহেলি চিটঠি সাজন কো দে আ’ তাতে আর কিছু না হোক, আসাধারণ কিছু বিরহের গান আর কবিতা পেয়েছি। 
‘লিখিনু যে লিপিখানি প্রিয়তমারে’ থেকে শুরু করে ‘চিঠি লিখে যাই চিঠি তো হয় না শেষ’ ছুঁয়ে ‘কী লিখি তোমায় প্রিয়তম’ কিংবা ‘ম্যায় মেরি সনম কো খত লিখি’ বা ‘চিটঠি আয়ি হ্যায় আয়ি হ্যায়’  
সেই চিঠিই বোধহয় শ্রেষ্ঠ চিঠি, যার জবাব দেওয়ার দায় নেই।
‘এ চিঠির নেই জবাব দেওয়ার দায়
আপাতত এটা দেরাজে দিলাম রেখে
পারো যদি এসো শব্দবিহীন পায়
চোখ টিপে ধরো হঠাৎ পেছন থেকে’
(নিমন্ত্রণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এই যে দুটি কথার মধ্যের ফাঁক বা স্পেসটুকু, প্রযুক্তি সেটুকুও আসবাব দিয়ে ভরাতে চায়, সেটাই বোধহয় বিপদ। এপারে মুখর হল কেকা ওই, ওপারে তাহলে আর কুহুর নীরব থাকার জো নেই। তাকেও কথার পিঠে কথা জুগিয়ে যেতে হবে। তবে এক একজনকে ফোন করলে আপনার আর কথা বলার চাপ নিতে হবে না, তিনি একাই বকে যাবেন, আপনার কান ব্যথা করবে, মাথা ভোঁ ভোঁ করবে, তিনি তখন দয়া করে বলবেন, ‘রাখি তাহলে, তুই তো কোন কথাই বললি না , খালি হুঁ আর হাঁ’ (মশাই স্কোপ পেলে তো?), ভয়ানক অসামাজিক হয়ে যাচ্ছিস, রাখি তাহলে, এই দেখ, ভুলে যাচ্ছিলাম, আসল কথাটাই তো বলিনি’
আপনার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করবে, সেই আসল কথাটা শোনার আগেই। আপনি মনে করতে পারেন, পঁয়তাল্লিশ মিনিট কথা বলার পরেও আসল কথাটা কেন বলা হল না?  এ অনেকটা জমিদারবাড়ির যাত্রার মতো কেস। জমিদাররা চার ভাই। ঠাকুরদালানে যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। চারজনের টিকির দেখা নেই। তাঁরা কোথায় না কোথায় তরল মার্গে বিচরণ করছেন। যাত্রা খানিকটা এগিয়ে গেছে, সেইসময় বড় ভাই এলেন এবং বললেন ‘কী এত বড় কথা, আমি নেই, যাত্রা শুরু হয়ে গেছে, আবার ফিরে ফিরতি শুরু হোক!’
এইভাবে এক এক প্রহরে এক একজন আসেন আর বলেন ‘আবার প্রথম থেকে শুরু হোক’ এই ফোনটাও সেইভাবে বারবার প্রথম থেকে শুরু হবে, আসল কথাটাই যে বলা হয়নি, কিছুক্ষণ পরে আপনি অনুভব করবেন আপনি এক অনন্ত লুপে পড়ে গেছেন, যার থেকে আপনার কোন পরিত্রাণ নেই!
ইয়ে মানে, মা ফোন করলে আমার এইরকম অভিজ্ঞতাই হত।মহিলা সম্ভবত জীবনে প্রেসি লেখেননি, কেবলই ভাব সম্প্রসারণ করে গেছেন। 
তাঁর হড়কা বানের মতো বাক্যের তোড়ে ভেসে যেতে যেতে হঠাৎ আমি কুটোর মতো কিছু আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করতাম।
‘মা, কে যেন কলিং বেল বাজাচ্ছে, যাই?’
‘খুলে দিয়ে আয় না, আমি ধরে আছি’
‘মা ভাত ফুটে এল’ 
‘এখন বসানোই বা কেন বাপু, যা নামিয়ে আয়, আমি ধরে আছি’
‘মা আমি একটু লিখতে বসি? একটা দারুণ প্লট এসেছে, যদি হারিয়ে যায়?’
‘কী প্লট বল তো? শোন না, আমাদের কলের মিস্ত্রি, পটা, আজকাল কবিতা লিখছে, আমি বললাম রেখে যাও, দিদি এসে দেখে দেবে’
‘দেব মা। এখন রাখি?’
‘আরে আসল কথাটাই তো বলা হয়নি’
বিশ্বাস করুন, সেই আসল কথাটা কোনদিন জানতে পারিনি। আর এ সমস্ত শুরু হয়, যখন নব্বই দশকের গোড়ায় আমার মায়া মফস্বলের বাড়িতে টেলিফোন আসে। আমাদের পাড়ায় সেই প্রথম টেলিফোন। সবকিছুতে প্রথম হওয়া যে মোটেই ভালো নয়, তা অচিরেই টের পাওয়া গেল।  
আমাদের ফোন আসার আগে পাড়ার লোকের সারা বাংলায় যোগাযোগ করার এবং কুশল জানবার যে এত আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব আছে, এত ছেলেমেয়ে যে স্কুল কামাই করে,  ফোনে পড়া জেনে নিতে চায়, এবং সবচেয়ে বড় কথা, এই আপাত নীরস পাড়াটির মধ্যে যে এত প্রেম আছে, তা জানা ছিল না। দেখা গেল যে সারাদিন প্রতি মুহূর্তেই কেউ না কেউ তার খুব দরকারি ফোন করার জন্যে আসছে।আর আমরা এত বছর পাশাপাশি থেকেও যা জানতে পারিনি, তাই জানিয়ে দিচ্ছে এই যন্তরটি, একটা নিরীহ চেহারার গৃহফোন। সেটা হচ্ছে পড়শির হাঁড়ির খবর। শাশুড়ি- বৌয়ের কোন্দল, ভাইয়ে ভাইয়ে মামলা, ঝাল ঝাল পরকীয়া –কিছুই জানতে বাকি থাকে না। আর এও জেনে যাই, তিনটে বাড়ির পর মিত্তিরদের ছোট মেয়ে যাকে মামাতো ভাই বলে পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট কথা বলল, সে আসলে তার তিন নম্বর প্রেমিক। আফসার আমেদের একটি অসাধারণ উপন্যাস আছে, অশ্রুমঙ্গল বলে। একটি প্রত্যন্ত গ্রামে একটি ফোন এসে খুলে দিয়েছে বহু বছরের চাপা পড়া কথা, অশ্রুর স্রোত। দেশের দূরদূরান্তে থাকা আত্মীয়স্বজনকে তারা নতুন করে আবিষ্কার করেছে। আমাদের বাড়ি ফোন এসেও প্রায় সেরকম ব্যাপার হল। ফোনের বিল ওঠাটুকু বাদ দিলে এ একেবারে ডেলি সোপের মতো চিত্তাকর্ষক। কিন্তু পিকচার আভি বাকি হ্যায় দোস্ত। শুধু ফোন করতে আসাটুকু না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু ফোন এলে ডেকে দেওয়া, কিংবা কিছু জেনে আসা, কিংবা আরও ভয়ানক, মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে দেওয়া।আমি নিজেই দুবার মৃত্যুর খবর পৌঁছতে গেছি। একবার তো আমারই বন্ধু ছমাসের মেয়ে রেখে আগুনে পুড়ে মারা গেল, সেই খবর অনেক রাতে এসে পৌঁছল আমাদের ফোনে আর দিতে গেলাম আমিই। পরে জানা গেল সেটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত খুন।
মৃত্যু থাক, জীবনের কথায় ফিরি। একেবারে বানিয়ে বলছি না, পাঁচটা বাড়ি পরে, জনৈক ব্রাহ্মণসন্তান বৈদিক শ্রেণির ব্রাহ্মণকন্যার খোঁজে যৌবন পার করে পাণিগ্রহণ করেছেন, পাত্রীও তথৈবচ। ধরা যাক তাঁর নাম শীলা। এক নিদাঘের দুপুরে সেই শীলার বোন ফোন করে খুব মিস্টি গলায় বললেন ‘এই শুনুন না, আপনাদের পাড়ায় শীলা আছে না, না, না ডেকে দিতে হবে না,আপনি শুধু গিয়ে জেনে আসুন, সামনের সপ্তায় পল্টুর বিয়েতে ও নীল বালুচরীটা পরে আসছে কিনা,’ এর উত্তরে খেঁকিয়ে উঠে বলতে নেই ‘কেন ভাই, এই গরমে টাকফাটা রোদে আমি খামোখা এটা জানতে যাব কেন? শীলা নীল বালুচরী পরুক, বা লাল শিফন পরে শ্রীদেবীর মতো বৃষ্টিতে নাচুক কিংবা নামমাত্র পোশাকে শীলা কি জওয়ানি করুক, তাতে পল্টুর বিয়ে আটকাবে নাকি?’ ছিঃ এরকম বলতে নেই। ফোন এলে ডেকে দেওয়া একটা সামাজিক কর্তব্য, আমি অতএব ঘামতে ঘামতে শীলাবউদির বাড়ি গিয়ে জিগ্যেস করি, শীলাবউদি এর উত্তরে বলেন ‘তুমি ভাই আগে জেনে এসো, ও কী পরছে? হলুদ তাঞ্চোই না গোলাপি কাতান? আমি সেই হিসেবে শাড়ি বাছব’ বিশ্বাস করুন, এক বর্ণ বাড়িয়ে বলছি না, আবার ফিরে আসি, রঙ জানি, আবার গিয়ে বলি। আসলে তখন তো আমার বিন্দু খাটুয়া আর নিত্য শার বিজনেস টেকনিকটা জানা ছিল না। অনেকবছর পরে রঞ্জিতা বলে একটি মেয়ে এসেছিল সুন্দরবন থেকে আমার মেয়ের দেখাশোনার জন্যে। তার গ্রামের গল্প। সে গ্রামে পাশাপাশি দুটি ভূষিমালের দোকান। বিন্দু খাটুয়া আর নিত্য শা। বিন্দু খাটুয়া দোকানে একটা ফোন আনল। লোকে শুধু পয়সা দিয়ে ফোন করতে পারে তাই না, বাইরে থেকে ফোন এলে তাদের ডেকে দেওয়াও হয়।দোকানে ফাইফরমাশ খাটা ছেলেটি দৌড়য় লোকজনকে ডেকে দিতে ‘ও চাচী তোমার ছেলে ফোন করেছে বম্বে থেকে, ও জেঠা তোমার মেয়ে ফোন করেছে আসানসোল থেকে’ স্বভাবতই বিন্দু খাটুয়ার দোকানে বিক্রিবাটা বেশি হতে লাগল। তাই দেখে নিত্য শাও দোকানে ফোন আনল শুধু তাই না, সে দোকানের মাথায় একটা মাইক টাঙাল লোকজনকে ডাকার জন্যে। হ্যালো বিষ্টু সাঁতরা, হ্যালো ক্ষ্যান্তমনি হালদার, ফোন, ফোন, শিগগির এসো। লোকজন রান্না রেখে, খেতের কাজ রেখে ছুটে আসত ফোন ধরতে আর নিত্য শার ব্যবসাও ফুলেফেঁপে উঠল।
 আমাদের বাড়িতে যখন ফোন আসে এরকম কোন উদ্ভাবনী কৌশল যদি জানা থাকত, হায়! তাহলে আমাকে জীবনের পরম লগন শীলাবউদির শাড়ির রঙ জেনে কিংবা দীপুদের কুকুরের উকুন মারা ওষুধ টুকে নষ্ট করতে হত না। তখন কি ছাই জানি, এই ডেকে দেওয়া রোগেরও অব্যর্থ দাওয়াই আছে? সে জেনেছি বহু পরে এক বন্ধুর মুখে। তখনো মোবাইল রাজত্ব শুরু হয়নি। বন্ধুটি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করত। তারা যখন লাঞ্চ আওয়ারে একটু জমিয়ে লাঞ্চ করতে বসত, বসও বাইরে কোন রেস্তোরায় লাঞ্চ করতে গেছেন, সেই সময় রাজ্যের ফোন আসত। একদিন এরকম ওরা খাচ্ছে, আর ফোন বাজল ‘মি মিত্তল আছেন? একটু ডেকে দেবেন?’
বন্ধুটি অম্লানবদনে বলল ‘মি মিত্তল তো একটু বেরিয়েছেন’
‘কোথায় গেছেন বলতে পারেন?’
‘উনি আমাদের জন্যে টিফিন আনতে গেছেন’
‘মানে? উনি তো এই কোম্পানির মালিক। আপনাদের জন্যে টিফিন, মানে!!!’
‘আসলে উনি আমাদের খুব ভালবাসেন কিনা’
সেই ভদ্রলোকের ফোন আর আসেনি, কিন্তু অন্য লোকও তো আছে। আবার একদিন লাঞ্চ আওয়ারে ‘মি মিত্তলকে একটু দেবেন?’
খুব গম্ভীর গলায় আমার বন্ধুটি ‘আপনি, আপনিই কি একটু আগে ওঁকে ফোন করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু কথা বাকি ছিল তো তাই’
‘কী বলেছিলেন আপনি ওঁকে?’
‘আমি মানে,’
‘আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই উনি বুক চেপে বসে পড়লেন। দুমিনিটের মধ্যে সব শেষ। আমরা এখন শ্মশানে যাচ্ছি। কী বলেছিলেন বলুন তো?’
বলা বাহুল্য এই ফোনটাও আর কোনদিন আসেনি।    

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।