বর্ষাকাল শেষ হয়েছে। মাটি শুকিয়ে এলো প্রায়। প্রচুর বৃষ্টি হলেও এখানে মাটি জল ধরে রাখতে পারে না। ফলে ঝুরঝুরে মাটি হাল্কা ডেলা পাকাবার বৃথা চেষ্টায় মেতেছে। মুরুগানের কাঠের পায়ের চাপ কি রক্তমাংসের পায়ের থেকে বেশি? মাঝেমাঝে গোল বাঁধে এই নিয়ে ওর মনে। একবার ডান পা তুলে ওজন বোঝার চেষ্টা করে, একবার বাঁ পা। আর এই খেয়াল যখনই চাপে ওর মাথায়, তখনই অবধারিত ভাবে দুই পায়ের ওজনের কমবেশি বড় বেশি করে অনুভব করতে থাকে মুরুগান। বিদ্যাও হাল ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিন। আর বোঝাবার চেষ্টা সে করে না। যখনই ও মুরুগানকে দুই পা নিয়ে দুহাতে ওজন করার ভঙ্গিতে দেখে, বুঝে যায়—প্রায় দিন সাতেক চলবে এরকম। এই খেয়ালি, ক্ষ্যাপাকে নিয়ে চলতে চলতে এক একসময়ে বিদ্যা ভাবে, ও যদি মুরুগানের আগে চোখ বোজে, কী হবে এই পাগলের? কে সামলাবে ওকে? বুঝিয়ে সুঝিয়ে কে শান্ত করবে ওই লোকটাকে। দূরে মিলিয়ে যাওয়া মুরুগানকে দেখতে দেখতে চোখে জল আসে বিদ্যার। সারা রাস্তা পায়ের ওজন মাপতে মাপতে হাঁটবে ও। গম্ভীর থাকবে এখন। যেমন গলা ছেড়ে গান করতে করতে পথ চলে, এখন সেই সময় নয়। অথচ তুল্যমূল্য যা হতে পারে, বা পারত, সেই দিকে কখনই মুরুগানের মন যায় না। এই যে ফার্ম চলছে, আগের থেকে ঢিমেতালে চলছে, রোজগার কমছে, সেদিকে ওর কোন খেয়ালই নেই। গত বছরের তুলনায় এ বছরে ফলন কমেছে। বীজের মানও পড়েছে। আকারে ছোট আর বেশ কিছু পোকায় ধ্বংস। এইসব খেয়াল রাখতে মুরুগান একসময়ে কোন ভুল করত না। এখন কেমন যেন গয়ংগচ্ছ ভাব এসেছে ওর। চলছে, এই যেন যথেষ্ট। প্রোডাকশন, কস্টিং, লেবার চার্জ, মার্কেটিং, সবই যেন ঢিলেঢালা। কর্মচারীদের যা মনোভাব হয় সাধারণত, কোনরকমে কাজ উদ্ধার করেই তারা টাকা হাতে পেয়ে যাচ্ছে যখন, তখন আর মনোযোগ দেবার বাড়তি ইচ্ছে তাদের থাকবে না, এই স্বাভাবিক।
একবার এসব কথা পেড়েছিল বিদ্যা। সেদিন মুরুগান বলেছিল, ‘আর কত টাকা চাই তোর? কী করবি এত টাকা নিয়ে? একটা বাড়তি কাজের লোকও তো রাখিস না প্রাণে ধরে…কী করবি আর টাকা টাকা করে?’ বিদ্যা বোঝাবার চেষ্টা করেছিল ওকে। ‘আহা টাকাই কী সব নাকি? এই যে ব্যবসা মার খাচ্ছে, মান পড়তির দিকে, এতে তোমার ফার্মের বদনাম হচ্ছে না? অন্য ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে আমাদের মার্কেট নিয়ে নেবে না?’ উত্তরে মুরুগান হেসেছিল তার স্বভাব অনুযায়ী হাহা করে। হাসির দমক সামলে ফের বলে উঠেছিল, ‘তুই তো দেখছি আমার থেকেও বড় ব্যবসাদার হয়ে উঠেছিস! ঠিক আছে, আজ থেকে তুই সব সামলা। আমি জানি তোর থেকে এ লাইনে যোগ্য কেউ নেই’। বিদ্যা আর কথা বাড়ায়নি। উঠে চলে গেছিল রাগ করে। মুরুগানও বেরিয়ে গেছিল ঘর থেকে। পরে একসময়ে ও বলেছিল বিদ্যাকে, ‘দেখ, সত্যি বলছি! আমি তোকে জানি, ভরসা করি। আমার আর ভালো লাগছে না এই কফি বাগান। তুইই বরং দেখাশুনো কর। আমার থেকে লোকে তোকে অনেক বেশি মানবে’। বিদ্যা অবশ্য ওই ক্ষ্যাপার কথায় কোন গুরুত্বই দেয়নি। যদিও পরবর্তী কালে বারবার মুরুগানকে ব্যবসায় মন দিতে বলেছে। কিন্তু মুরুগানের সেই এক গোঁ। ‘ভাল্লাগছে না রে!’ কিছুদিন অভিমান করে মুরুগানের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছিল বিদ্যা। তাতে পরিস্থিতি বরং আরও ঘোরালো হয়ে উঠেছিল। মান ভাঙানোর চেষ্টা কোনদিনও করেনি মুরুগান, সেদিনও করেনি। উল্টে মনের কষ্টে আরও চুপ হয়ে গেছিল। একসময়ে বাধ্য হয়ে ও নিজেই গুমরে থাকা পাগলটার সঙ্গে আবার কথাবার্তা বলা শুরু করেছিল স্বাভাবিক ভাবে। মুরুগানও এক নিমেষে ফিরে পেয়েছিল তার প্রাণশক্তি।
এই তো কিছুদিন আগে ওদের সবথেকে বড় কাস্টমার সমস্ত অর্ডার ক্যানসেল করে দিল। রীতিমতো রাগারাগি, অশান্তি করে ওদের অ্যাডভান্স ফিরিয়ে নিয়ে গেল। খবরটা শুনে খুব ভেঙে পড়েছিল বিদ্যা। কিন্তু মুরুগান বেশ হেসে হেসে নিশ্চিন্তে এই খবর দিয়েছিল বিদ্যাকে। যেন, অর্ডার বাতিল হয়েছে বলে সে খুশি! প্রচণ্ড রেগে বিদ্যা সেদিন বলেছিল, ‘তাহলে ব্যবসাপত্তর গুটিয়ে ফেল! আর কী হবে এই মরা কফিবাগানে পড়ে থেকে? তারপর যেদিকে দুচোখ যায় বেরিয়ে পড় নাহয়! এতই যখন বৈরাগ্য…এই কফিবাগান বিক্রি করে দাও, নয়ত কাউকে দিয়ে দাও। আমি চোখের সামনে তিলতিল করে গড়ে ওঠা খামারকে ধ্বংস হতে দেখতে পারছি না আর! সহ্য করতে পারছি না, বিশ্বাস কর তুমি! নয়ত আমাকে মুক্তি দাও। আমি চলে যাই এখান থেকে’। এরপর বিদ্যা রাগে, দুঃখে, কান্নায় ভেঙে পড়েছিল হুড়মুড় করে। কোথা থেকে যেন পাহাড় ভাঙার শব্দ আসছিল ঠিক সেই সময়ে। এইরকম পরিস্থিতিতে মুরুগানও কিছু বলতে পারেনি। স্তব্ধ হয়ে বসেছিল পাথরের মতো। কিছুক্ষণ আগের রিল্যাক্স ভাবভঙ্গি উধাও হয়ে গিয়ে সে যেন অন্য মানুষে পরিণত হয়েছে।
পরে ঠাণ্ডা মাথায় অনেক ভেবেছে বিদ্যা। এই লোককে অভাব, অভিযোগ, অনুযোগ জানিয়ে লাভ নেই। যা করছে করুক। জোর করে ওকে কফি খেতের দিকে মন ফেরানো যাবে না। মুরুগানের সঙ্গে এই বিষয়ে আর কোন কথাই আলোচনা করবে না বিদ্যা আজ থেকে। তার চেয়ে বরং কুগানকে কাজে লাগাতে হবে এই কাজে। ঠেলে ঠেলে ওকে দিয়ে বরং কিছু করানো যেতে পারে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। বিদ্যা আর দেরি করেনি। কুগান আজকাল এমনিতেই অনেক শুধরে গেছে। তারও বয়স হল কম না। বিয়ে থা করল না বলে, কাজ বা সংসারের ওপর খুব বেধি মমতা বা দায়বোধ কাজ করে না তার। তবে সেই অ্যাডিকসন কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু একজন প্রায় চল্লিশ বছর বয়সী পুরুষের থেকে যতখানি দায়িত্ববোধ বা পরিণত বুদ্ধি আশা করা যায়, তার অর্ধেকও কুগানের নেই বা নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও কুগান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বিদ্যার।