কেমিক্যাল বিভ্রাট
বাপের বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রায় দিনকার মতোই বাস থেকে নামলেন জবালা। আজ তাঁদের বাসটা একই রুটের অন্য একটা বাসের সঙ্গে রেষারেষি করতে গিয়ে এত স্পিড নিয়ে ফেলেছিল যে, ঠিক সময়ে ব্রেক কষেও স্টপেজে দাঁড়াতে পারেনি। স্টপেজ ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। তাও কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তার মধ্যেই পা-দানি থেকে উনি কোনও রকমে তড়িঘড়ি রাস্তায় পা রাখতেই ফের রুদ্ধশ্বাসে ছুট লাগিয়েছিল বাসটা। তাই কন্ডাকটরকে দু’কথা শোনানোর ইচ্ছে থাকলেও কোনও উপায় ছিল না। যে দিক দিয়ে বাসটা এসেছিল, পেছন ফিরে সে দিকেই হাঁটা শুরু করেছিলেন জবালা। আজ তাঁকে একটু বেশিই হাঁটতে হবে।
ক’পা হাঁটতেই রোজকার মতো চোখ পড়ল ছাউনি দেওয়া ঝাঁ-চকচকে বাস-স্টপেজটা। ভেতরে পুরো দেওয়াল জুড়ে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছবি। পাশে বড় বড় করে লেখা— দাঁড়াও পথিক বর জন্ম তব যদি বঙ্গে…
যেতে যেতে এই দু’লাইনের বেশি ওঁর কোনও দিনই পড়া হয়ে ওঠে না। কিছু দিন আগেই স্থানীয় বিধায়কের এলাকা উন্নয়নের তহবিল থেকে এটা বানানো হয়েছে। এখনও এক্কেবারে নতুন। তবে ভেতরে কবির নাম যত বড় করে লেখা, তার চেয়েও বড় বড় হরফে সেই বিধায়কের নাম এই স্টপেজের মাথায় মেটেল দিয়ে ফলাও করে লেখা।
এই বাস-স্টপেজের গায়েই ভ্যান-রিকশার ওপরে ডাই করে রাখা ডাবগুলির দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলেন তিনি। এত নিটোল, গোলগাল, উজ্জ্বল সবুজ তরতাজা ডাব তিনি বহু দিন দেখেননি। দেখে মনে হল কেউ বুঝি সদ্য রং করে রেখেছে।
এখন শুধু শাক-সব্জি, খাবারদাবারেই নয়, মশলাপাতিতেও রং মেশানো হচ্ছে। রং করা হচ্ছে ফুলেও। খানিক পরেই সাদাটে ভাব ফিকে হয়ে কেমন লালচে-লালচে হয়ে যায়। তাই দোকানিরা রজনীগন্ধার বড় বড় মালা একটু পরে পরেই নীল রঙে চুবিয়ে খদ্দেরদের জন্য সাজিয়ে রাখেন। ওই রং দেখেই খদ্দেরদের মনে হয়, ফুলগুলো বুঝি এক্ষুনি গাছ থেকে তুলে আনা।
কানকো দেখে অনেকে মাছ কেনেন বলে নাকি আজকাল মাছ-বিক্রেতারাও বড় বড় মাছের কানকোতে এক ধরনের লাল রং লাগিয়ে রাখেন। আসলে গন্ধ বা স্বাদ তো অনেক পরের ব্যাপার। চোখ টানার প্রথম ধাপই হল— রং।
তাই পাত্র বা পাত্রী দেখতে গেলেও বাবা-মায়েরা প্রথমেই দেখেন, যাকে দেখতে গেছেন তার গায়ের রং কেমন। স্কুলের গেটের সামনে কিংবা যে কোনও মেলায় বরফ-জল কেনার সময় বাচ্চারাও দেখিয়ে দেয় কোন রংটা তার চাই। কিশোর-কিশোরীরাও বিশেষ কোথাও যাবার দিন নিজের সব চেয়ে প্রিয় রঙের পোশাকই পরতে ভালবাসে। জন্মদিনে বা ভাইফোঁটায় কিংবা এমনিই কাউকে কোনও জামাপ্যান্টের পিস অথবা কোনও শাড়ি উপহার দেওয়ার সময় সবাইকেই মাথায় রাখতে হয় কোন রংটা তাকে মানাবে কিংবা কোন রংটা তার প্রিয়। তার ওপর যাচাই করে দেখতে হয় সেই রংটা পাকা না কাঁচা। তাই যাঁরা একটু সচেতন কিংবা যাঁদের একটু অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরাই কেবল রং দেখে বুঝতে পারেন, কোন অলঙ্কারে কতটা খাদ মেশানো আছে।
রং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। তাই জ্যোতিষীরা ভাগ্য ফেরানোর জন্য কাকে কোন রংটা সুট করবে, সেই মতো ভিন্ন ভিন্ন লোককে ভিন্ন ভিন্ন রঙের পাথর পরার জন্য পরামর্শ দেন। যে কোনও আঁকাই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এই রঙের গুণেই। মাথার চুল সাদা হয়ে গেলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় সকলেই কলপ করেন চুলে। নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্যই ঠোঁটে রং লাগায় বহু মেয়ে। রঙের বাহার আছে বলেই মানুষ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ময়ূরের পেখমের দিকে। আবার এই রংই অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে প্রশাসনিক দফতর থেকে মাঝে মাঝেই হানা দেয় বাজার-হাটে। খুঁজে বার করার চেষ্টা করে কোনও বিক্রেতা আনাজপত্রে রং করে বিক্রি করছে কি না।
তা হলে কি আজকাল ডাবওয়ালারাও ক্রেতাদের নজর কাড়ার জন্য ডাবগুলিকে সবুজ রঙে ডোবাচ্ছে! সে নয় ডোবাল। কিন্তু ডাবগুলোর চেহারা এত নিটোল-নিখুঁত হল কী করে!
ক’দিন আগেই তাঁর বাবা ‘ক্যানসার-ফ্রি’ হয়ে গেছেন। কিন্তু তার পর থেকেই হঠাৎ শুরু হয়েছে অন্য একটা সমস্যা। শরীরে জোর পাচ্ছেন না। ঘরের মধ্যে দু’পা হাঁটলেই মনে হচ্ছে, আর পারা যাচ্ছে না, এ বার একটু না বসলেই নয়। মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। সব কিছু কেমন যেন ভুলে যাচ্ছেন। মুখ ধুতে যাওয়ার আগে চশমাটা যে কোথায় রেখে গেছেন, ওয়াশ-রুম থেকে বেরিয়ে সেটা আর কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। খাওয়ার ঠিক আগেই যে ওযুধটা খাওয়ার কথা, প্রথম গ্রাস মুখে নিয়েই মনে করার চেষ্টা করছেন তিনি আদৌ ওষুধটা খেয়েছেন তো! একই প্রশ্ন চার বার করার পরেও এক ঘণ্টার মধ্যেই ফের সেই একই প্রশ্ন পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, এমনকী অষ্টম বারও করে বসছেন বউয়ের কাছে।
অথচ পাঁচ বছর আগে কী ঘটেছিল, দশ বছর আগে তাঁর সামনে কে কাকে কী বলেছিল অথবা কুড়ি বছর আগে ঘটা অত্যন্ত ছোটখাটো অবাঞ্ছিত ব্যাপারও তিনি অবলীলায় বলে যাচ্ছেন।