আন্তর্জাতিক || পাক্ষিক পত্রপুট || এ তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

শুধু আবেগ বা হুজুগ নয়, চাই ভালোবাসা ও চর্চা

মাত্র কয়েক দশক আগেও পরিবারে কোন শুভকাজের নিমন্ত্রণ পত্রের বয়ানটি ছিল এইরকম- মহাশয়, যথাবিহিত সম্মান পুরঃসর নিবেদনমেতৎ, অত্রস্থলের শুভ বারতা এই যে…। এখনকার কোন নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে সময়ের দাবিতে সেই ভাষা এখন অচল। এখন নিজের মুখের কথাগুলিই শিক্ষা ও রুচি অনুযায়ী সাজিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে ছাপা হয় নিমন্ত্রণ পত্র। তাও শুধু বাংলাতেই নয়, থাকে ইংরাজি ভাষাতেও। অবাঙ্গালি আত্মীয় বন্ধুদের জন্য। এটাও তো আগে ভাবা যেতনা।

এইভাবে অনেকটাই পাল্টে গেছে বাংলা ভাষা। লিখিত ভাষার সঙ্গে মুখের ভাষাও। পালটে যাচ্ছে উচ্চারণের স্টাইল। পরিবর্তন তো একদিনে হয়নি। হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। একসময় তা আজকের ভাষার রূপ নিয়েছে। আবার আজকের ভাষাও ভাঙছে। সবার অলক্ষ্যে জন্ম নিচ্ছে কিছু নতুন শব্দ, হারিয়ে যাচ্ছে কিছু প্রচলিত শব্দও। প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে বিচ্ছেদের বদলে এখন ‘বয়ফ্রেন্ড’ ‘গার্ল-ফ্রেন্ডের’ মধ্যে ‘ব্রেক আপ’ হয়ে যায়। আবার নতুন ‘রিলেশনশিপ’ তৈরি হতেও সময় নেয়না। ডিজিটাল যুগ, ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডশিপ, এসবের আগে বাঙ্গালিকে কখনও ছবি বা অন্য কোন মেটেরিয়াল আপলোড/ডাউনলোড করতে হয়নি। এখন হয়। তাই এরকম অনেক নতুন শব্দ এসে যাচ্ছে বাংলায়। প্রচলিত কিছু বাংলা শব্দ নীরবে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে অন্য প্রতিশব্দকে, যেগুলি বলতে আর শুনতে বেশি পছন্দ করছে এখনকার প্রজন্ম। হয়তো তাতে ঘটনা বা পরিস্থিতির অভিঘাতটা খুব সহজে বোঝানো যায়, কিম্বা বাংলার বদলে অন্য প্রতিশব্দটি বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে। সেকারণেই হয়তো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এরকম শব্দের ব্যবহার। পরে একসময় এটিই হয়ে যায় স্বীকৃত ও প্রচলিত ভাষা। তখন আর চেনার উপায় থাকেনা যে একসময় সেটি ছিল অনাহূত। চিরকালই হয়ে এসেছে এই সংমিশ্রণ। রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন “বাংলাভাষা পরিচয়” প্রবন্ধে যে দশম শতকের বাংলাকে বিংশ শতকের বাঙালি আপন ভাষা বলে চিনতে পারবে কি না সন্দেহ।

তাহলে যে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, আলোচনা হয় – বাংলা ভাষা বেআব্রু হয়ে পড়ছে, গোল্লায় যাচ্ছে বাঙালি কৃষ্টি সংস্কৃতি? বিশেষ করে এখন ফেব্রুয়ারিতে তা আরো বেশি আলোচিত। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কি এবং কতটাই বা সর্বনাশ হতে যাচ্ছে সেসব নিয়ে চর্চা হয় অনেক বেশি। সেটাই হয়তো কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু এইখানে স্পষ্ট হয়ে যায় একটা বিভাজন রেখা। পাল্লাটা বোধ হয় কোনদিকেই কম নয়। একটু ছুঁয়ে দেখা যেতে পারে।

প্রথমে অভিযোগের দিকটা। কথাবার্তার মধ্যে অনাবশ্যক ইংরাজি এবং হিন্দির ব্যবহারে একটা জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম হচ্ছে। বাংলা ভাষা কলুষিত হচ্ছে। কেন, বাঙালি হয়ে শুদ্ধ বাংলায় কি কথা বলা যায়না? এফ এম রেডিওর কোন কোন আর জে এমন কিছু বিকৃত উচ্চারণ করেন আর এত বেশি হিন্দি ইংরাজির মিশেল থাকে সে ভাষায় যে তাকে বাংলা ভাষা বলে চিনতেই কষ্ট হয়। কথা বলার ধরণটাই পালটে যাচ্ছে তাতে। জায়গা ছাড়তে ছাড়তে বাংলা ভাষা একেবারে কোণঠাসা। বিজ্ঞাপনে বিলবোর্ডে বাংলা প্রায় নেই. সাইনবোর্ড বেশিরভাগই ইংরাজিতে। এভাবে চললে বাংলাভাষাটাই একদিন হারিয়ে যাবে মনে করেন কেউ কেউ।

যারা এতোটা সন্দিহান নন, তাঁদের মতে এতটা হতাশ হবার কারণ নেই। বাংলা ভাষা এত দুর্বল নয় যে কিছু ইংরাজি বা হিন্দি শব্দ এসে মিশলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পরিবর্তনই ধর্ম। জীবনের সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে ভাষাও। সেটাই নিয়ম। চিরকাল ধরেই তো চলে এসেছে এই প্রক্রিয়া। আর্বি ফার্সি উর্দু হিন্দি ইংরাজি থেকে কত অজস্র শব্দ বাংলায় ঢুকে একসময় সেগুলিও বাংলা হয়ে গেছে। নিজেকে সমৃদ্ধ ও গতিশীল করার জন্য বাংলা ভাষা এসব শব্দকে এমনভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছে যে এখন মনে হয়না যে সেইসব শব্দগুলি বাংলা নয়। অতিরিক্ত পরিশ্রমে ‘হয়রান’ হয়ে গেলে বা প্রতিযোগিতা থেকে প্রিয় দল ‘বিদায়’ নিলে যখন মন খারাপ হয়ে যায় তখন কেউ ভাবিনা যে ‘হয়রান’ হওয়া বা ‘বিদায় নেওয়া শব্দগুলি আসলে বাংলা নয়। কেউই মাথা ঘামায়না সে নিয়ে কারণ শব্দগুলি খুব আপন হয়ে গেছে। আসলে যেখানে যে শব্দটি ব্যবহার করলে অর্থটি পরিপূর্ণ হয়, মনের ভাবটি সুন্দর করে প্রকাশ করা যায়, সেখানে সেই শব্দটিই ঠিক এসে যায়, একসময় ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তাই বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারও সচেতনভাবে বাংলা সিনেমার নাম দেন ‘ইন্টারভিউ’, ‘কোরাস’, ‘খারিজ’ ইত্যাদি। এগুলি ছাড়া অন্য বাংলা প্রতিশব্দ দিয়ে ঠিক ‘ইমপ্যাক্ট’ টা আনা যেতনা। যেমন ‘রোম্যান্টিক’ কে রোম্যান্টিক ছাড়া আর অন্য কোন শব্দ দিয়েই ঠিক বোঝানো যায়না। ‘ফাইট কোণি ফাইট’ না বললে সেই জোরটা কিছুতেই আনা সম্ভব হতনা।

আসলে দীর্ঘদিনের চর্চায় যেসব শব্দ মানুষের মুখের ভাষায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে, মানুষ যেগুলিকে আপন করে নিচ্ছেন সেখানে তো সমস্যা থাকার কথা নয়। ভাষা তো নদীর মতো। তাকে গতিশীল আর শ্রুতিমধুর রাখতে নিত্যনতুন শব্দের যোগান রাখতে হয়। ইংরাজি শব্দভাণ্ডারেও তো অনেক নতুন শব্দের সংযোজন হচ্ছে। নতুন শব্দকে জায়গা করে দেওয়ার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই, বরং তাতে ভাষার ঐশ্বর্য বৃদ্ধি হয়। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনকে মেনে নিতে না পারলে, নতুন শব্দকে গ্রহণ করতে না পারলে সে হবে এক অচলায়তন। তখনই হবে ভাষার অপমৃত্যু। পৃথিবীর সমস্ত ভাষাই পরিবর্তনকে মেনে নিয়েছে, নতুনকে জায়গা দিয়েছে। তাছাড়া শুধু বাংলার মাধ্যমে সার্বিক জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রটি এখনও তৈরি নয়।

শেষ পর্যন্ত যা প্রয়োজন তা হল ভাষার প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা। বাংলাভাষা যদি বিলুপ্তির পথেই যাচ্ছে, তাকে আটকানোর জন্য শুধু আবেগ আর হুজুগ যথেষ্ট নয়। শুধু মিছিল আর স্লোগানের কর্মসূচীও খুব বেশি দূর যেতে পারবে কিনা বলা মুশকিল। বাংলার সঠিক চর্চাটা দরকার। যারা চর্চা করছেন, বাংলাকে সত্যিকারের ভালবাসছেন তাঁদের উপেক্ষা নয়। সভা সমিতিতে বাংলার পক্ষে ফাটাফাটি বক্তৃতা আর ব্যক্তিগত আচরণে আর জীবন যাপনে বিদেশী স্টাইল, এই স্ববিরোধটা পালটানো দরকার। এই সময় মা বাবারা সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে না পড়িয়ে পারবেন না। কিন্তু ইংরাজি পড়েও বাংলা ভালো করে শেখা যায়, বরং আরও ভালো করে শেখা যায়। ‘বাংলাটা ঠিক আসেনা’ এটা গর্বের কথা নয় বরং একটা দীনতা, এই বোধটা আনতে হবে। আর দরকার সেই শিক্ষানীতি ও অর্থনীতি যা ভাষার ভিতকে আরও মজবুত করবে। অন্য ভাষার সঠিক শব্দকে প্রয়োজনে গ্রহণ করেও আগ্রাসনকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করবে।

প্রবাসীরা কিন্তু চেষ্টা করেন এই চর্চাটা জারি রাখতে। তা নিশ্চয় ভালোবাসা থেকে। বিদেশে কয়েকবার দেখেছি এরকম। ঘরোয়া আড্ডায় হোক বা পুজো পার্বণে, মাঝে মাঝেই বাঙালিরা মিলিত হয় একসঙ্গে। নিজেদের তৈরি বাঙালি রান্না নিয়ে এসে খাওয়া দাওয়া হয়, আড্ডা চলে, গানবাজনা হয়। বেশির ভাগই বাংলা গান। তখন মনে হয়েছে, এই যে এদের অনেকেই পড়ে এসেছে সাধারণ বাংলা মিডিয়াম স্কুলে, চর্চা করে এসেছে বাংলা ভাষার, কিন্তু তাতে তাদের বিদেশের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের সঙ্গে গবেষণা করা বা অধ্যাপনা করায় তো কোনো সমস্যা হয়নি! এর জন্য দেশে থাকাকালীন তাদের কথায় কথায় ইংরাজি বলতে হয়নি। এখন সুদূর বিদেশে থেকেও তারা মাঝে মাঝে একত্র হয়ে আসলে একাত্ম হতে চায় পিছনে পড়ে থাকা গোটা বাংলার সঙ্গে। আড্ডায় গল্পে গানে যেন একটু ছুঁয়ে দেখতে চায় সেই নিজের ভাষা আর সংস্কৃতিকেই। কিম্বা নিজের অস্তিত্বটাকেই। এতে ভালোবাসাটা অটুট থাকে।

এই ভালোবাসাই বাংলা ভাষার জন্য এখন খুব দরকার।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।