আন্তর্জাতিক || পাক্ষিক পত্রপুট || এ রঞ্জনা বসু

রিলেশন

কথাটা কদিন ধরেই বলবে, বলবে করেও আর বলে উঠতে পারছে না ত্রিগুণা। কারণ যাকে বলবে অর্থাৎ তার স্বামী দেবনাথ কে, সে এতটাই ব্যস্ত নিজের অফিসের কাজ নিয়ে যে তার শ্বাস ফেলার সময় নেই। একমাত্র নাতি চিন্টুকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে একেবারে বাজারটা সেরে বাড়ি এসে চা খায় দেবনাথ। এইসাথে মর্নিংওয়াক হয়ে যায়। এরপর আর কথা বলার সময় থাকে না দেবনাথের হাতে।

নাকে মুখে কোনরকম গুঁজে দেবনাথ বেড়িয়ে গেল। এই ট্রেনটা না ধরতে পারলে অফিসে লেট হয়ে যায়। ত্রিগুণা দেবনাথের শার্ট, ট্রাউজার্স ওয়াশিং মেশিনের মধ্যে দিতে দিতে ভাবে আর দেড় বছর বাকি নেই অবসর নিতে অথচ মানুষটা একইরকম কাজপাগল রয়ে গেছে। এখনকার স্বামী স্ত্রীরা নিজেদের কত সময় দেয়। বাইরে ঘোরা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, এখানে ওখানে বেড়াতে যাওয়া এছাড়া সিনেমা, থিয়েটার তো আছেই। নিজের একমাত্র ছেলে আর ছেলের বউকে সবসময় এভাবেই দেখে অভ্যস্ত, তবুও—

আবার মাথার মধ্যে চিন্তাটা চলে এল। এমন সময় বৌমা সুলগ্না এসে বলল— মা, আপনি আজ স্কুল থেকে চিন্টুকে নিয়ে আসবেন। আমাকে এখুনি বেরোতে হবে। একটা এগজিবিশান আছে, ফিরতে রাত হয়ে যাবে। ছেলে সুগতকে দেখল বেশ মনমরা হয়ে আছে। আজকাল চারপাশের সবকিছু কেমন পাল্টে যাচ্ছে। যেগুলো তখন ছিল না, সেগুলো এখন সভ্যতার অগ্ৰগতির সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়েছে। তখন অত অভাবেও দাম্পত্য কলহ প্রায় ছিলই না বলা চলে এখন এই আধুনিক জীবনের আকাশছোঁয়া চাহিদার কারণে সংসারে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোন ব্যপারে মতানৈক্য ঘটেই চলেছে।

সেই রাতেই একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল সুগত। পাঁড় মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরল। ও কবে থেকে অ্যালকোহলিক হয়ে উঠল? ত্রিগুণা যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। এইসময় চিন্টু ঘুমিয়ে ছিল, তাই রক্ষে। না হলে—

এসব দেখার পর থেকে দেবনাথ কিন্তু ভাবতে লাগলো অন্য কথা। সেদিন সুলগ্নার ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। যিনি নিজের গাড়িতে সেদিন সুলগ্নাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন তিনি আর্ট কলেজে নাকি একসাথে পড়াশোনা করেছেন, সুলগ্নার বন্ধু মনোময় ত্রিবেদী। তারপর সারারাত ধরে চলল ছেলে আর বৌমার ঝগড়া। চাপা আওয়াজ ছিলই, আজ সেটা চরমে উঠল।

— ‘চিন্টুকে নিয়ে আমি এবার চলে যাব। তারপর এক সপ্তাহের মধ্যে উকিলের চিঠি পাঠিয়ে দেব’।

— ‘আরে যাও যাও। তুমি কি পাঠাবে তার আগে আমিই পাঠাবো’।

ত্রিগুণা বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে এল। বাইরে থেকে সুলগ্নাকে ডাক দিল কিছুটা জোরের সাথে।
আমার ঘরে চিন্টুকে শুইয়ে দিয়েছি, তুমি গিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়ো। ছেলেকে বলল, আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।

দেবনাথ স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে ওঠে, এসব কবে শুরু হল?

তোমাকে বলব বলব করেও বলা হয়ে উঠছিল না। ছেলে আর বৌমার মধ্যে একটা সমস্যা টের পাচ্ছিলাম অনেকদিন ধরে, এই মনোময় ছেলেটিকে কেন্দ্র করে। ওদের ভেতর ঢুকতে চাইনি। ভেবেছিলাম আজকালকার ছেলে মেয়েদের ধৈর্য্য কম, এমন ঝগড়া করে আবার ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু আজ যা হল—

হ্যাঁ গো, আমাদের চিন্টুর কি হবে? এই সম্পর্কের তিক্ততা ওকে যে শান্তি দেবে না। দেবনাথ আর ভাবতে পারছে না।

ত্রিগুণা মনকে শক্ত করে। দেবনাথের মতো ভেঙে পড়েনি। সুলগ্নাকে সে যতটুকু চিনেছে তাতে সংসার ভেঙে ফেলার মত মেয়ে তাকে মনে হয়নি। দেবনাথ কে বলে, ওতো ভেবো না। ওদের মাথার ওপর আমরা এখনও রয়েছি তো। সন্তানদের ভুলগুলো যে আমাদেরই শুধরে দিতে হবে। তা না হলে কিসের বাবা, মা হলাম। নাও, অনেক রাত হল। এবার একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।