‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। খন্ড – ১)

কফি পাহাড়ের রাজা 

প্রথম পর্ব:

 ১)

এখন রাত দুটো বেজে গেছে। মুরুগান হাত, পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে পাহাড়ের ঢালে। প্রায় রোজই, বৃষ্টি না হলে, এই চাষবাসের সময়ে মুরুগান এই সময়ে, এই ভাবেই শুয়ে থাকে। স্তব্ধ রাত খানখান হয়ে যাচ্ছে ওরই পোষা কুকুরের চিৎকারে। নিশ্চই ওরা কোন জংলি জানোয়ার দেখেছে। কাঠের পা’টা খুলে রেখে দিয়েছে মুরুগান একপাশে। অন্যদিন হলে মুরুগান পাশে রাখা দোনলাটা বাগিয়ে ছুটত ওই চিৎকার লক্ষ্য করে। কিন্তু এখন কেন জানি ওর আর উঠে দেখতে ইচ্ছে করছে না, যেতে ইচ্ছে করছে না। কুকুরগুলো এমনিতেই খুব হিংস্র টাইপের, একেবারে জাত জার্মান শেফার্ড। ওরা ঠিক তাড়িয়ে দেবে জানোয়ারদের। বিনস এখনও কাঁচা, ফলে চোরের উৎপাত হতে আর কিছুদিন লাগবে। তাই আর উঠতে তত গা নেই ওর। আজ একটু বেশিই গুমোট গরম লাগছে। এমনিতেই মুরুগানের সারা বছর একই পোশাক। মিলিটারি ক্যামোফ্লেজ জামা আর অনেকগুলো পকেট দেওয়া প্যান্ট। জামার বোতামগুলো খুলে দিল ও। গলার মোটা রূপোর চেন থেকে জেসাস ঝুলে থাকেন বারোমাস। যদিও চার্চে শেষ কবে গেছে মুরুগান, সে ও নিজেও ভুলে গেছে। এমনকি গত ক্রিসমাসের সময়ও যাব, যাচ্ছি, করে ওর চার্চে আর যাওয়া হল না। বগলে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন জেসাস। তুলে একটা চুমু খেলে ওকে মুরুগান। তারপর খোলা আকাশের বুক ভর্তি তারাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের এভাবে নিঃশর্তে কেউ ভালবাসে? বাসে না, আমি জানি। নিঃশর্ত ভালবাসা কেন, নিঃশর্তে টয়লেটে পেটও ক্লিয়ার হয় না, হতে পারে না। এ পৃথিবীর সবটাই শর্তাধীন, সে আমি, মুরুগান, এই উনষাট বছর বয়সে এসে দিব্যি বুঝে গেছি। আমি এযাবৎ কোন শর্ত মানিনি, ফলে শর্ত ঘাড়ে ধরে আমাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে গেছে।
কুকুরগুলো ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখেমুখে তাদের দিগ্বিজয়ের ভাব। শুয়ে শুয়েই ওদের আদর করে দিল খানিক। ওরাও শান্ত হয়ে ওর কাছাকাছি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আর ঘন্টাখানেই এখানে থাকবে মুরুগান। তারপর নিজের ডেরায় গিয়ে ঘন্টা তিনেক অঘোরে ঘুমোবে। অবশ্য সিজনের সময় এই ঘুমের মেয়াদ এক ঘন্টায় কমে আসে ওর। কারণ আর কিছুই না, জানোয়ারদের চেয়ে, ধূর্ত মানুষ-চোরের বুদ্ধি বেশি, কৌশলও নানাবিধ। সেই অনুযায়ী মুরুগানকেও সতর্ক থাকতে হয়। কয়েকটা পোকা উড়ছিল নাকের ওপর। বিরক্তিতে উঠে বসল ও বাধ্য হয়ে। কাঠের পা’টা নেড়ে ওদের তাড়াল আর তারপরেই ছেলেমানুষের মতো হোহো করে হেসে উঠল কী মনে করে। আসলে মুরুগানের এই এক হাসি রোগ। কখন যে কী পরিপ্রেক্ষিতে তার হাসি আসে, কেউ জানে না। আর কেউ বলতে ওর আছেটাই বা কে? বউটা তো অকালে তিনদিনের জ্বরে মরে গেল। এই জঙ্গল রাজত্ব ওর সহ্য হল না। এখন মনে হয়, কেন যে সে সময়ে বিয়ের ভূত ওর মাথায় চেপেছিল! নইলে হয়ত সাধারণ এক কন্নড় পরিবারের স্ত্রী হয়ে সুখে ঘরসংসার করতে পারত সুশীলা। এই সম্বন্ধটাও হঠাৎ করে নিয়ে এসেছিল ওরই চেনা পরিচিত একজন লাইনের সর্দার। সে হয়ত ভেবেছিল, সুন্দরী মেয়েটি প্রায় ধনী একজন কফি প্ল্যান্টারের স্ত্রী হয়ে বেঁচে যাবে। সুশীলাকে দেখে অল্প বয়সী মুরুগানও আর স্থির থাকতে পারেনি। বিয়েতে রাজী হয়ে গেছিল। ভুলে গেছিল ওর আধক্ষ্যাপাটে চালচলন, মতিভ্রম আর ছন্নছাড়া জীবনের কথা।
অর্থ রোজগার করে বটে ও, কিন্তু সে আর কাজে লাগে কই? কাজ করার নেশায় কাজ করে মুরুগান। এই বিশাল ফার্ম হাউজে সে থাকে কতক্ষণ? আর বাপ, মা, আত্মীয়স্বজন বলতে কেউই আর তেমন নেই ওর এখন, এক ওই ভাইপো ছাড়া। সে আহাম্মকও সারাদিন ঘরে বসে খায়দায়, আর ঘুমোয়। মদে চুড় হয়ে থাকে সারাদিন। কুগান এখন আর মানুষ নেই। রিহ্যাবেও দিয়ে এসেছিল ওকে বেশ কয়েকবার। ফিরে এসে আবার যে কে সেই। মুরুগান তাই ঠিক করে নিয়েছে—এভাবে যে কদিন বাঁচে ও…থাকুক আমার কাছে। অন্তত একটা কাছের মানুষের নিঃশ্বাস তো পাওয়া যায়। কতই বা বয়স ছেলেটার। এই কী ওর পরিণতি হওয়ার ছিল! প্রেম, ভালবাসা এক তীব্রতা শুধু। যা মানুষকে ধ্বংস করে দেওয়া ছাড়া আজ পর্যন্ত কিচ্ছুটি পারেনি। নইলে এমন এক শা জোয়ান ছেলেকে আর একটু হলেই ওরা শুধু পিটিয়ে মেরে ফেলছিল! আর আজকের হাসির উৎস ছিল এই কুগানকে ঘিরেই। হঠাতই কেন জানি মুরুগানের মনে পড়ে গেল সেই কবেকার এক ঝলক দেখা কুগানের টিকিধারী, তিলককাটা, তামিল ব্রাহ্মণ বাড়িওলার কথা। ইয়া মোটা সে, ভুঁড়ির ওপর ধুতি, খালি গায়ে রাগে তামিলে অনর্গল গালি দিয়ে যাচ্ছে কুগানকে। আচ্ছা ও ব্যাটা কী আর মরবার জন্য আর কোন বাড়িওলা খুঁজে পেল না ওই শহরে? আর পেলই বা যদি ওই লোকটাকে, তারই বা কেন এক অপরূপা অপ্সরী, বিদ্যেবতী কন্যে থাকতে হল? আর কন্যে যদিও থাকল, তাতে তো কিছু যায় আসার কথা ছিল না কারুরই। কিন্তু অনেকটাই এল আর গেল। কুগান আর সেই কন্যের গভীর প্রেম জমে গেল। আর তাতেই সর্বনাশ হয়ে গেল ছেলেটার। একে খ্রিস্টান, তায় কন্নড়, এই প্রেম কী আর ওই তামিলরা মেনে নেয়? ভদ্রলোকের প্রতিপত্তিও ছিল খুব, সে জানা গেল কুগানের মার খাওয়ার পরে। মুরুগান যখন খবর পায়, মানে ওকে ওই লোকই খবর দেয় টেলিফোন করে—নিয়ে যান আপনার ভাইপোকে। এরপর যেন আর ওকে না দেখি এ এলাকায়, মনে রাখবেন। এমন এক ফোনের পরে মুরুগান যখন সে বাড়িতে পা দেয়, সেই লোকের ওই গাল বর্ষনের রূপটিই দেখেছিল প্রথমে। আর পেট ফেটে বেদম হাসি এসেছিল তখন। পরবর্তী ঘটনা বা দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সেদিন আর হাসা হয়নি যদিও। সেদিন হয়ত একদল লোকের মারের চোটে কুগান মরেই যেত। মুরুগান কোনমতে তাকে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। সেই থেকে কুগান তার সঙ্গী। তারপর হসপিটাল, ডিপ্রেসান, নেশার আশ্রয়…একের পর এক কুগান তাকে যন্ত্রণা দিয়েই চলেছে। তবুও আছে সে সঙ্গে। আজ এতদিন বাদে, তাও প্রায় বারো বছর তো হবেই, সেই হাসি উগড়ে দিল মুরুগান।
হাসির রেশ কাটলে চোখ জ্বালা করে উঠল ওর। একা থাকতেই ওর সবথেকে বেশি ভাল লাগে। এই পাহাড়, কফিখেত, জঙ্গল, আকাশ ভর্তি তারা, কিম্বা বৃষ্টির সময়ে টানা বৃষ্টির ভেতরে ঝুম মেরে নেতিয়ে পড়ে থাকা ওই এলাচ গাছগুলো ওর প্রিয়তম সঙ্গী। এলাচ গাছগুলোকেই বেশি পছন্দ করে মুরুগান। ওদের ঝাঁকড়া চুলের মতো পাতাবাহার দেখেই বোধহয়। লবঙ্গ বা দারচিনি গাছগুলোও ভাল, কিন্তু এলাচ যেন ওর প্রিয় সখা। আর সত্যি বলতে কী, কফিগাছের চারাদের এই এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি গাছগুলো ছায়াই দেয় না শুধু, কফির সুগন্ধের কারণও ওরাই। ওরা না থাকলে কফি হত গন্ধহীন, কাল দানা মাত্র। যার কদর থাকত না মোটেই। হয়ত এই সব কারণেই মুরুগান এই এলাচ গাছেদের এতটা পছন্দ করে। বৃষ্টির পরে যখন এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি গাছগুলো গতরে বেড়ে ওঠে, নিচের কফিগাছগুলোকে অন্ধকারে ঢেকে দিতে চায়, তখন আবার নিষ্ঠুর হাতে ওদের ছেঁটে দেয় মুরুগান। তাই মাঝেমাঝে নিজেই সংশয়ে ভোগে, কে বেশি প্রিয় ওর—এই এলাচ গাছগুলো নাকি কফি চারা! যেমন আজ এই রাতেও একা থাকতে অভ্যস্ত, স্বচ্ছন্দ মুরুগানের মনে হচ্ছে একজন সঙ্গী থাকলে হয়ত ভালই কাটত জীবনটা। একাকিত্ব বোধ ওকেও কুটকুট করে কামড়ায়। কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ—এই সহজ, সরল হিসেব ওর আসে না। অস্তি বা নাস্তি—এই দুয়ের খাড়া ও কঠিন পাঁচিল দিয়ে ও নিজেকে, নিজের জীবনকে ভাগ করতে পারেনি আজও। ফলে সংশয় তাকে গ্রাস করে, ক্ষ্যাপাটে করে তোলে, বিচ্ছিন্ন করে রাখে আশপাশ থেকে।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।