ল্যাবের সামনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল রোশনি। অধৈর্য হয়ে লম্বা করিডোরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত চক্কর দিল কয়েকবার। ফোনে সময় দেখল। সময় পেরিয়ে গেছে ঢের আগেই। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। পাক্কা পঁয়ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করেছে সে। তাকে ভাবেটা কী কুশল! পুরো পঁয়ত্রিশ মিনিট সে অপেক্ষা করে আছে কুশলের জন্য অথচ টিকিটিরও দেখা নেই তার! একটা ফোন অন্তত করতে পারত কুশল, নিদেনপক্ষে একটা মেসেজ। রোশনি কি এতটাই সস্তা তার কাছে যে তাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে সে! রাগে গজ গজ করতে করতে সশব্দে ফোনটা অফ করে দিল রোশনি। ল্যাবের বন্ধ দরজার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে গটগট করে হেঁটে করিডোর পেরিয়ে গেল দ্রুত। সিঁড়ি ভাঙল হুড়মুড়িয়ে। নিচে নেমে কোনো দিকে না তাকিয়ে পেরিয়ে গেল মেডিকেলের প্রধান ফটক। আগুপিছু না ভেবে চলতি রিক্সা ডেকে উঠে বসল তাতে একলাফে। রোদ্দুরের আঁচ এসে লাগল মুখে। মধ্য ফাল্গুনের দুপুরের হাওয়ায় কী যেন একটা থাকে। কেমন উদাস, উতল হয়ে ওঠে মন, কী যেন নাম না জানা এক বোধ বুকের দরজায় জোর কড়া নাড়ে এসে। তাতে কেমন কান্না পেতে চায় রোশনির। কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠতে চায় গলার কাছটায়, চোয়াল ব্যথা করে ভীষণ, জীবনের যা কিছু বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তি মুহূর্তে সব এসে আছড়ে পড়ে স্মৃতির সৈকতে আর তার ধাক্কায় চোখে জমে যায় নোনা জল। রিক্সায় বসে ঘামতে থাকে রোশনি, ফোঁপায় অজান্তেই। চোখ মুছতে ভুলে যায়। ছোকরা রিক্সাঅলা ফোঁপানির শব্দে চমকে পেছন ফিরে তাকায়। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকায়, প্যাডেল চেপে আচমকা বাড়িয়ে নেয় গতি। নিজের বোকামিতে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে যায় রোশনি। শাসন করে নিজেকে। সামলে নেয় মুহূর্তেই। কণ্ঠ স্বাভাবিক করে বলে, নিউ মার্কেট যাও।
পেছন ফিরে এক পলক রোশনির মুখের দিকে কী একটা দেখে চালক ছেলেটা, কথা না বাড়িয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয় শেষে। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ব্যাপারটা আগাগোড়া ভাবে রোশনি। নিজের ছেলেমানুষীতে শব্দ করে হেসে ওঠে নিজেই। দুম করে রাস্তার একপাশে রিক্সা থামিয়ে দেয় রিক্সাঅলা ছেলেটা। সীট থেকে নেমে ঘাড় কাত করে রোশনির দিকে তীব্র চোখে তাকায়। আঙুলের ইশারায় নামার নির্দেশ দেয় রোশনিকে, মুখেও বলে, যান। নামেন।
হতচকিত রোশনি ভ্যাবাচ্যেকা খেয়ে যায় প্রথমটায়। বাক্য সরে না মুখে। তারপর অবাক গলায় বলে, আমি তো নিউ মার্কেট যামু!
অইন্য রিক্সায় যান গিয়া।
ক্যান? এই রিক্সার কী সমস্যা?
এই রিক্সা যাইব না আর। নামেন।
ছেলেটার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে রোশনি। গোঁয়ার কিছিমের চেহারা, তাতে ভয় মিশেছে খানিকটা, অদ্ভুত লাগছে দেখতে। ফিক করে হেসে ছেলেটার ভয় আরেকটু বাড়িয়ে দিল সে। ছেলেটা রোশনিকে পাগল ভেবে ভয় পেয়েছে, নামিয়ে দিতে চাইছে সে জন্যই। ব্যাপারটা ভেবে ভারি হাসি পেল রোশনির। কথা না বাড়িয়ে ঝটপট নেমে পড়ল সে-ও। পার্স থেকে টাকা বের করে ছেলেটার হাতে দিল হাসি মুখে। টাকাটা পকেটে পুরে কাল-বিলম্ব না করে রিক্সা নিয়ে ছুট লাগাল সে। তার হাবভাবে হাসি চাপা মুশকিল হল রোশনির। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে হেসে ফেলল খিলখিল। শব্দে ফিরে তাকাল ছেলেটা, গতি বাড়াল ছোটার। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেল রোশনির। ব্যাগ খুলে টিস্যু বের করে চোখ মুছল অতঃপর। হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই চমকে তাকাল পেছনে। তাকাতেই মুখের হাসিটা চওড়া হল আরো।
তুমি? ক্লাস নাই এখন?
ছিল। স্যার অসুস্থ। ক্লাস হবে না আজ। তোর ব্যাপার কী? মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে এমন পাগলের মতো একা একা হাসতেছিস যে?
কণার কথায় আবার খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল রোশনি। কণাকে আদ্যোপান্ত ঘটনাটা বলতেই কণাও যোগ দিল হাসিতে। শেষে বলল, ফোন কি এখনও বন্ধ রাখছিস?
হু।
ওই পাগলি! ফোন বন্ধ রাখছিস ক্যান? ল্যাবে ফোন ইউজ করা নিষেধ জানিস না? ল্যাবে কি ইচ্ছে করে দেরি করে কেউ? ল্যাব থেকে বেরিয়ে বেচারা তো হন্যে হয়ে খুঁজবে তোকে। ফোন বন্ধ পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাবে পুরা!
খুঁজুক। মাথা খারাপ হলে হোক। দেরি হবে তাহলে আমাকে আগে আগে আসতে বলল ক্যান? আমি পুরা চল্লিশ মিনিট দাঁড়ায়া থাকছি ল্যাবের সামনে। ফাজলামি পাইছে, না? এখন খুঁজুক যত পারে। ফোন আমি আজ অন করছি না আর। তুমি এদিক কই যাও?
মার্কেটের দিকে যাব একটু। কাজ আছে। তুই কই যাস?
আমিও ওইদিকেই যাচ্ছিলাম। রিক্সায়ালা নামায়া দিল আমারে -বলে, রিক্সাঅলা ছেলেটাকে মনে পড়তেই আরেক দফা হাসল রোশনি। কণাও হাসল। বলল, এইটুকু তো পথ। রিক্সা নিতে গিছিস ক্যান খামোখা!
রিক্সা কি ইচ্ছে করে নিছি নাকি! মেজাজ খারাপ ছিল, রাগের চোটে রিক্সায় উঠে কোথায় যাব ভেবে না পেয়ে বলছি নিউ মার্কেট যাব!
কণা হাসল। বলল, তুই আস্ত একটা পাগল। মানুষের দেরি হতে পারে না একটু?
না। কুশল সব সময় অমন করে আপু। উল্টাপাল্টা সময় দেয়, তারপর তার নিজের আসার নাম থাকে না আর। আজ এমন মেজাজ খারাপ হল যে কী বলব! আচ্ছা, তোমার ঐ পাগল বান্ধবীর খবর কী?
কে? কার কথা বলছিস? -অবাক প্রশ্ন করে কণা।
ইস! বোঝো না! ঐ যে কেয়া! প্রতিদিন একটা করে প্রেম করে যে!
রোশনির বলার ধরণে ফিক করে হেসে ফেলল কণা। হাসতে হাসতে বলল, কেয়ার কথা তোকে কে বলল?
কী যে বলো আপু! কেয়া আপুর কাহিনি জানে না মেডিকেলে এমন কেউ আছে? সবাই তো চেনে তারে!
তাই নাকি? -অবাক হওয়ার ভান করল কণা। রোশনি বকে গেল একাই, ঝড়ের বেগে। কণা চমকাল। রোশনি আসলেই সব জানে, এমনকি রেজার সাথে ডেটিংয়ের কথা পর্যন্ত! কীভাবে? তবে যে লোকে বলে দেয়ালেরও কান আছে, সেটা কি তাহলে সত্যি! কথাটা মনে হতেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরো একটা প্রশ্ন তার মনে উদয় হল এসে। ইচ্ছে হল প্রশ্নটা সরাসরি রোশনিকেই করে সে। ইচ্ছে হল, রোশনিকে সে জিগ্যেস করে যে, এই যে মেডিকেলের এত এত কাহিনি জানে রোশনি, সবাই ই জানে, তাহলে রেজা আর রোশনির মা আলেয়ার কেচ্ছাও কি জানে রোশনি, যা সবাই জানে প্রায়!
প্রশ্নটা করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল কণা। নীরবে রোশনির বকবকানি শুনতে শুনতে হাঁটতে থাকল মার্কেটের দিকে।