কেনো জানি না সুমিকে আমার ভালো লাগতো সেই তবে থেকে যবে থেকে আমি মামার বাড়ি যাই। হয়তো ছোট বেলা থেকে, হয়তো কেন নিশ্চয়ই ছোট বেলা থেকেই যাই, কিন্তু তার কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই।
কিন্তু যবে থেকে ঠিক মনে রাখা শুরু তবে থেকে মামার বাড়ি আর সুমি একেবারে মিলেমিশে একাকার। যেন ওর জন্য ই মামার বাড়ি যাবার এক দুর্দম আকর্ষণ কাজ করতো।
ও বেশ গোলগাল মোটাসোটা, আর বেশ পাকা। মানে ওই থ্রি ফোরে যেসব কথা বলতে নেই এমনকি শুনতেও নেই ও অবলীলায় বলে যেত। আমি বেশ দুরুদুরু বুকে শুনতাম। বুঝতাম ব্যাপারটা নিষিদ্ধ আর নিষিদ্ধ বলেই বোধহয় শোনার টানটাও থাকতো বেশি!
কিন্তু কখনো মনে হয়নি যে কথা গুলো ও শিখলো কি করে? কে জানালো ওকে নারী পুরুষ সম্পর্কের গভীর গোপন কথা গুলো। আসলে বাবা মায়েরা বাচ্চাদের যতটা ছোট বা ইনোসেন্ট ভাবেন ব্যাপারটা আসলে মোটেই সেরকম নয়।
তবে যতদিন যেতে লাগলো, ওকে আমার আরো বেশি করে ভালো লাগতো। ও বেশ ডাকাবুকো। ওদের ঠাকুমার চৌকির তলা থেকে নারকেল বের করে দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে, ইট দিয়ে ভেঙে কতবার যে খেয়েছি! এ ক্ষেত্রে অবশ্য ও দাত্রী আর আমি গ্ৰহিত্রী! শহরে থাকার
দরুন এ সবে আমার অভ্যস্ত হবার কথা নয়।
যখন প্রায় নাইন টেন, প্রেমট্রেম বেশ বুঝি তখনো মুখিয়ে থাকতাম মামার বাড়ির জন্য। আর ওখানে পা দিয়ে ই ব্যাগ পত্তরের নিকুচি করেছে, দৌড় বান্ধবীর কাছে।
দিদা রাগ করতেন, “হ লো ছেমড়ি,তুই আমাগো লিগা আসেন নাকি অর লিগা? ” কিন্তু আমরা দিদার কথা শোনার পর্যন্ত সময় নেই। পেটের ভেতর গ্যাসের মত কথা যেন ভুড়ভুড়ি কাটছে।
মামার বাড়ির পেছনে, পুকুর পাড়ে একটা নারকেল গাছ এমন ভাবে বেঁকে উঠেছিল যে ওর ওপর পা দুলিয়ে বসে দিব্যি মাটিতে পা পাওয়া যেতো।
আমরা দুই বান্ধবী জুড়তাম গল্প, সে যে কত গল্প তার ইয়ত্তা নেই। তবে ওই বয়সে এসে প্রেমটাই বেশ অনেকটা জায়গা দখল করতো। ওর কাকে ভালো লাগে, ওকে কে প্রপোজ করেছে,কটা চিঠি দিয়েছে এইসব আর কি?
এই রকমই এক বিকেল, সবে গরমের ছুটির শুরু আর আমিও হাজির মামার বাড়ি, তখন সন্ধ্যা হয় হয়, সুমি হঠাৎই জিজ্ঞাসা করে, “মিতা, তোকে কেউ কোনোদিন চুমু খেয়েছে? “, “ধ্যাৎ! “, আমি লজ্জা পেয়ে মুখ নীচু করি।
সুমিটা একটা যা তা, কি সব বলে? ” ,”বল না, বল না, কেউ খেয়েছে চুমু? ” ,এদিকে চুমু শুনেই তো আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। কেউ শুনলে আর আস্ত রাখবে না। আমি এইসব আলোচনা করছি? কারণ বয়স টা ভয়ংকর। মা, পদে পদে সে কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই আমি একটু জোর করেই বললাম, “বাদ দে না”,
সুমি হঠাৎই জোর করে ওর ঠোঁটটা আমার ঠোঁটের ওপর চেপে ধরলো, আর ওর গোল গাল শক্ত সমর্থ হাতদুটো চলে বেড়াতে লাগলো আমার সারা শরীর ময়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, প্রচন্ড ভয় করছিল, তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত অনুভূতি।
কোনোরকমে ওর হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। তার পরদিনই মাকে বাধ্য করেছিলাম মামার বাড়ি ছাড়তে। ফেরার পথে দেখলাম ও রাস্তার ওপর সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।
আমাকে ওর সাথে কথা না বলতে দেখে মা জিজ্ঞাসা করলো, “কি রে ঝগড়া হয়েছে? “, আমার উত্তর না পেয়ে ধরেই নিল ,”মৌনং সম্মতি ক্রম। “
এর পর আর উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মামার বাড়ি যাবার নাম করিনি। মামার বাড়ি মনে পড়লেই সুমির কথা মনে পড়তো। ওর সেই দম বন্ধ করা চুমু, ওর সেই স্পর্শ! অদ্ভুত ভাবে সেগুলো আমাকেও মোটেই ভয় পাওয়াতো না, বরং অদ্ভুত এক উত্তেজনা, ভালো লাগা, এক অন্যরকম অনুভূতি, যা এর আগে আমার কখনো হয়নি।
আশা, তনিমা ওদের প্রেমিকদের সম্পর্কে নাকি ঠিক এই একই রকম ফিল করে! আমি অবাক হলাম, তাহলে কি আমি সুমির প্রেমে পড়েছি? তা কি করে হবে, ও তো মেয়ে , একটা অসভ্য মেয়ে! অসভ্য? কই ওকে তো কতো বছর চিনি, এরকম তো আগে কখনো মনে হয়নি?
ও যদি অসভ্য হয়, তাহলে তো আমিও অসভ্য! কারণ ওর সেদিনের স্পর্শ এড়িয়ে পালিয়ে এসেছিলাম বটে কিন্তু আমার তো ভীষণ খারাপ লাগে নি। তাছাড়া স্কুলে ও দেখতাম মেয়েরা, মেয়ে বন্ধুদের একটু এদিক ওদিক ইয়ার্কি করে টাচ করে। হয়তো ও সেটাই করতে চেয়েছে, আমি একটু বেশি রিয়্যাক্ট করেছি। আসলে আমি সুমির কাছে যাবার কারণ খুঁজছিলাম আর ও যে খারাপ নয় এটা নিজেকে প্রমাণ করতেও ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম।
কলেজে ভর্তির পাট চুকতেই আবার মামার বাড়ি হাজির। এবার সুমি কিন্তু নিজে থেকে দেখা করতে এলো না। অগত্যা আমিই গেলাম। মামীমা , মানে সুমির মা বেশ খুশি, “কি ব্যাপার? এতদিন বাদ? “
“সুমি কোথায়? “, ওর ঘরে! আমি চমকে দেবো বলে পা টিপে টিপে ওর ঘরে ঢুকে পেছন থেকে ওর চোখ চেপে ধরি। ও জোর করে আমার হাত ছাড়িয়ে নেয়।
আমাকে দেখে, পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ” এত দিনে মনে পড়লো? “, আমি বুঝলাম না কেন? কিন্তু হঠাৎই প্রবল উচ্ছ্বাসে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। উষ্ণ জল আমার গাল গড়িয়ে নামতে লাগলো, আর সুমি পরম স্নেহে আমার মাথা ওর বুকে চেপে ধরে বললো, ” পাগলী, তুই কি আমায় ছেড়ে থাকতে পারিস? তুই যে আমায় ভালোবাসিস! “
হ্যাঁ হ্যাঁ আমি সুমি কে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি!সেদিন প্রথম বুঝলাম আমি প্রেমে পড়েছি, মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছি।ঠিক কি ভুল জানিনা কিন্তু পড়েছি।
আমি কান্না ভেজা গলায় বললাম, “আর তুই?” সুমি আমার ঠোঁটে ওর ঠোঁটটা নামিয়ে আনতে আনতে বললো, “বুঝিস না, সত্যি বুঝিস না? “
ততক্ষণে আমার শরীর মনে তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। যেন ঝর্ণা প্রবল বেগে সব কিছু ভেঙ্গে নামছে উষ্ণ স্রোতের টানে, আজ ভাসিয়ে নেবে সব, আজ আর কোনো রেহাই নেই। আমি নিজেকে সমর্পণ করলাম সুমির হাতে।
আমাদের সম্পর্কটা আর সবার কাছে নিখাদ বন্ধুত্বের এর বাইরে কিছু না। চট্ করে কিছু ভাবা সম্ভবও না। শুধু আমরা মাঝে মাঝে উষ্ণতা বিনিময় করতাম, মনের, শরীরের। যেন ও আর আমি একে অপরের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যেন আমরা আলাদা নই, এক!
কলেজ শেষে আমরা দুজনেই ইচ্ছে করেই সরকারি চাকরির চেষ্টা করলাম না। জানতাম সে ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা আসতে পারে, অনেক কৈফিয়ত, যদিও কৈফিয়ত আমাদের সমাজকে দিতে হবে জানি, কিন্তু আমরা তৈরি।
সুমি বা আমি আমরা কেউই বাবা মা আমাদের সম্বন্ধ আনলে না বলতাম না। ঠিক ই সেজেগুজে বসতাম পাত্র পক্ষের সামনে। আমাদের দুজনের একটাই শর্ত, যেহেতু আমাদের বাবা মায়ের আমরা একমাত্র সন্তান, তাই বিয়ের পর বাবা মা ও আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।
যদিও বাবা মা হাঁ হাঁ করে উঠতেন, কিন্তু জানতাম এটাই মোক্ষম অস্ত্র তাছাড়া এটা সত্যিও বটে। সত্যি সত্যি ই আমরা একটি পাত্রপক্ষ ও পাইনি যারা বিয়ের পর আমাদের বাবা মা কে আমাদের সঙ্গে রাখতে চায়।
আমার বাবা ঝামেলা করলেন বিস্তর কিন্তু আমার সাফ কথা, “আমি চাকরি করি, উনিও করেন। উনি যদি ওনার বাবা মা এর সঙ্গে থাকতে পারেন আমি কেন না? আর আমি তো ওনাদের এখানে এসে থাকতে বলছি না! তাহলে? “
বাবা এই যুক্তির বিরুদ্ধ যুক্তি না পেয়ে হতাশ গলায় জিজ্ঞাসা করেন, “তাহলে কি সারাজীবন বিয়ে করবি না? “, ” না”, আমার সাফ জবাব।
এর মধ্যেই একদিন রাত্রি তখন প্রায় তিনটে। হঠাৎ মায়ের চেঁচামেচি তে এসে দেখি, বাবা প্রায় অজ্ঞান,চোখ মুখ ঠিকরে বেরোচ্ছে, মুখ থেকে ফেনার মত তরল গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে বালিশ।
আমি সঙ্গে সঙ্গে সুমিকে ফোন করলাম, ও বললো, “পিসেমশাই কে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি তে নিয়ে যা, আমি আসছি! ” ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় সুমি হাসপাতালে উপস্থিত। ওই রাতে গাড়ি ভাড়া করে একাই চলে এসেছে এমনকি মামার বাড়িতে ও ফোন করে দিয়েছে আসার পথে। তারাও এসে পড়লো সকাল সাতটার দিকে।
এর পর প্রায় ন দিন যমের মানুষে টানাটানি। মা কাঁদতে সুমি বলতো, “পিসি চিন্তা কোরো না, পিসেমশাই কে ঠিক বাড়ি নিয়ে যাবো”! ওই কদিন এক মুহুর্তও সুমি আমাদের পাশ থেকে সরে নি।
এরপর বাবা বাড়ি ফিরলে, তখন বাবা মোটামুটি সুস্থ। একদিন নিজেই বলছেন, ” সুমি টা না থাকলে মিতা যে একা একা কি করতো? “, আমি সুযোগ বুঝে বলে ফেললাম, ” আর যদি আমার বিয়ে হয়ে যেত, তাহলে কি করতে? “, ” সত্যি ই তাই, মা দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন।
“আচ্ছা মা বিয়েটা কেন জরুরি? “, সারাজীবন একটা মানুষ তো আমাদের পরেও তোর পাশে থাকবে, তাছাড়া নাতি নাতনী এটাও তো শখ! ” আমার প্রশ্নে মায়ের সহজ সরল জবাব।
আর যাদের ছেলেপেলে হয় না? “, আমার প্রশ্ন ধরতে না পেরে মা বলে ওঠে, ” ও সব অলুক্ষুণে কথা মুখেও আনিস না! ”
“আরে বলোই না”, আমি চেপে ধরি! ” তাহলে আর কি করা, সব ই তার ইচ্ছে “!
মা কিছু না বুঝেই ভগবান স্মরণ করেন।
আমি পট করে এই সুযোগে কথাটা পারি, ” ধরো আমাদের ও এরকম হলো! “, ” মানে? “, মা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
এই ধরো তোমরা আর আদিত্য মামারা এক সাথে থাকলে, আর সুমি আর আমি। ওরা আমাদের সাহারা আর আমরা ওদের। মা কিছু ই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কিন্তু বাবা হয়তো আন্দাজ করতে পারেন কিছুটা।
এরপর ঝড়ঝাপটা কিছু কম যায়নি, কিন্তু আমি আর সুমি দুজনেই দুজনের পরিবারের, দুজনের পাশে আছি আজ প্রায় কুড়ি বছর। সমাজ স্বীকৃতি দিক না দিক, আদালত যা খুশি আইন করুক, আমরা আমাদের পরিবার নিয়ে খুশি। ব্যস, বাকি? “কুছ তো লোগ কহেঙ্গে! “