ক্যাফে গদ্যে পায়েল চ্যাটার্জী

অস্তরাগ

-ঘাসের বিছানা?
-হ্যাঁ! সবুজ, নরম ঘাসের উপর আমাদের যত প্রেমের আসা-যাওয়া! তোমার নূপুরের আওয়াজ। মনে নেই তোমার? পঁচিশটা বছর পেরিয়ে গেল। খুব কি ক্লান্ত লাগছে এখন?
-২৫ বছর ২৮ ঘন্টা ২৪ মিনিট ৩২ সেকেন্ড! তখন মহামারী ছিলনা। ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে হতো না। আজ না হয় একটু ক্লান্তি থাকুক। তোমারতো শরীর খারাপ লাগলেও বলবে না।
-আজ বলবো না।ওই যে দূরে অস্তরাগের সূর্যটাকে দেখছো! ঠিক তোমার লাল টিপের মত। যেমনটা পরে আসতে আগে।
-আজ আকাশটা দেখছো? ঠিক তোমার মত! নির্ভীক, বিস্তৃত অথচ কি উদাসীন! এখনো তারা দেখো নাকি রাতের আকাশে?
-দেখার চেষ্টা করি। তবে চোখের দৃষ্টি আর আগের মত আছে কই? শুধু মনের চোখে আজও তুমি….
-তাহলে সেদিন আমায় একবার দেখেই চিনে ফেলেছিলে যে?
-তোমায় চিনতে আমার আবার কবে থেকে দৃষ্টির দরকার পড়ল? তবে এভাবে তোমার সঙ্গে আলাপ হবে সেটা ভাবিনি। অতিমারি ,ভাইরাস। মুখোশের আড়ালেই ছিলে। শুধু চোখ দুটো ফাঁকি দিতে পারেনি আমায়।
-কথায় কথায় কাব্য করার অভ্যাসটা আজও গেল না দেখছি।
-কোন অভ্যেসই কি এভাবে ছেড়ে যায়? অভ্যেসরা তো আর চিঠি লিখতে পারে না, যে একটা চিঠি লিখেই সব পাট চুকিয়ে ফেলতে পারে।
-আমরা শুধুই শেষটা দেখতে পাই। শেষের শুরুটা দেখার চেষ্টা করি না।
-তোমার বারান্দায় ফুল গাছ গুলো আছে আজও? রোজ বিকেলে কে জল দেয় ওদের? ওদেরর জল দেয়ার সময় চুড়ি গুলো খুলে রাখ না তো? চুড়ির আওয়াজটা ওরা বড় পছন্দ করত।
-শুধু ওরা? যক্ষী বুড়ির মত আগলে রেখেছি ওদের। গাছ, স্মৃতি যথাস্থানেই আছে।
-ওই দূরে বসত তোমার প্রিয় “ঘটি গরম”। ঘর্মাক্ত মুখ, চুলগুলো এদিক-ওদিক উড়ছে। কিছু অবাধ্য চুল লেখতে থাকতো মুখে, ঘামে। মাস্কটা না থাকলে আজও সাক্ষী হতাম। জল খাবে? তেষ্টা পেয়েছে খুব?
-একটু চা হলে মন্দ হত না। তোমার রুমাল টা দেবে?
-কি করে বুঝলে আজও রুমাল ব্যবহার করি! বাইরে চা খাবে এখন?
-এই বোঝা গুলো সঙ্গে নিয়েই তো জীবনের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি। ওই দেখো। চা নিয়ে এস।
-ভাগ্যিস চা-কাকু বলে ডেকে ফেলোনি!
-ইস! এই বয়সে ওই ছোকরা মতন লোকটাকে কাকু ডাকব! বলিহারি আক্কেল তোমার।
-আসলে আজকের বিকেলটার সঙ্গে ২৫ বছর আগের বিকেলগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে। যাই চা নিয়ে আসি।
-এখনো আগের মতই আওয়াজ করে চা খাও!
-তৃপ্তি! জীবনের স্বাদ তো আর নেওয়া হলো না। অগত্যা জিহ্বার মানভঞ্জন করি।
-বিয়ে করলে না কেন?
-তোমার চিঠিতে ভাঙ্গার কথা লেখা ছিল। কিছু গড়ে নেওয়ার কথা তো ছিল না! তুমি বুঝি খুব সংসারী হয়েছ?
-সংসারই বটে। তোমার দেওয়া বইয়ের স্তুপের সঙ্গে সংসার করছি। তোমার ছাত্র-ছাত্রীরা আসে।পড়তে।
-“ভালোবাসার বই-ঘর”। তুমি তাদের বই দিদিমণি।
-সব খবরই রাখো দেখছি! আগলে রেখেছি তোমার স্বপ্ন। সুনন্দ, জাগরী, সফিনারা তাদের প্রিয় স্যারের আদর্শে দীক্ষিত হয়েছে। ও দেশে আর ফিরে যেও না। এরকম অনেক সুনন্দ, জাগরীরা অপেক্ষায় আছে।
-অপেক্ষা শুধু ওদের? তবে ছেড়ে যেতে পেরেছিলাম আদৌ? দূরে গেলে কি আর সুদূরে পাড়ি দেওয়া হয়?
-তোমার মা কেমন আছেন?
-মায়ের সঙ্গে এখন দেখা হয় রাতের আকাশে তারাদের ভিড়ে! প্রশ্ন করি, কেন তোমায় সেদিন চিঠিটা লিখতে বলেছিল? উত্তর পাইনি এখনো।
-তুমি বুঝেছিলে সবটা!
-জানো, তোমার চোখ দুটো অবিকল তোমার মত।স্বচ্ছ। সব পড়ে ফেলা যায়। যদিও মাকে কোনো প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনি। তার আগেই….
-কিছু প্রশ্ন অধরা থাকাই ভালো, কিছু উত্তর অজানাই ভালো।
-এই যেমন এখন আমি যদি তোমার ফোন নম্বর জানতে চাই, জানি, তুমি এড়িয়ে যাবে।
-আসলে একটা বাস্তবের মধ্যে অজস্র বাস্তব লুকিয়ে থাকে। প্রত্যেকটা বাস্তবই একেকটা বিন্দুর মতো সত্যি। আর এই প্রত্যেকটা বাস্তবই হয়তো একটা সুতো দিয়ে বাঁধা। যে বাঁধনের সূত্র আমাদের কারো হাতে নেই। এই যেমন, অস্তরাগে সূর্যটা নিখোঁজ হয়ে আকাশটা কালো মেঘের সঙ্গে লুটোপুটি খেলছে এখন। একটু আগের মিষ্টি বিকেলটাও যেমন সত্যি বৃষ্টির সম্ভাবনা টুকুও তেমনই সত্যি।
-বৃষ্টি তো সেই কবে থেকেই ঝরছে।
-তবে এই ভাইরাসটা আমাদের একেবারে নিঃস্ব করে দেয়নি বল। একই রোগ। একই হাসপাতাল। রোগমুক্তির দিনও একই। মুখোমুখি অবশেষে।
-আসলে আমাদের রোগটা বরাবর একই। তবে মুখোমুখি বোলোনা। মাস্কে-মাস্কে দেখা বলতে পারো!
-এবার যে যেতে হবে। আমার গাড়ি বোধহয়… তোমায় একটু এগিয়ে দেবো?
-আমি পিছুটানে অভ্যস্ত এখন। তুমি এগিয়ে যাও।
-শরীরের যত্ন নিও! দেরি কোরো না। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। এই শরীর খারাপের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজো না। ভালো থেকো। আবার কি কোনোদিন..
-“আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে -তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভিতরে”।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – জীবনানন্দ দাশ
ছবি ঋণ – সৌরভ দাস
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।