ক্যাফে ধারাবাহিক গল্পে সুব্রত সরকার (পর্ব – ৩)

অন্তরার শেষ কথাগুলো

তিন

“কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।” অন্তরা বিড় বিড় করে উঠল।
আমি নড়ে চড়ে বসলাম। কান পেতে বললাম, “কিছু বলবে?”
“বলব। একটু কাছে এসে বসো।” অন্তরা শান্ত নির্লিপ্তভাবে বলল।
আমার বসার চেয়ারটা কাছে নিয়ে বললাম, “বলো, কি বলবে?”
“ভেবে নাও এই কথাগুলোই আমার শেষ কথা।” অন্তরা থমকে থাকল। আমি কেঁপে উঠলাম নিজের অন্তরে। একটা হাত বাড়িয়ে ওর পিঠে রেখে বললাম, “কেন বলছো এসব কথা!”
“ডুলুং এর পরীক্ষার পরই আমি চলে যাব।” এবার আমি হুইল চেয়ারটা চেপে ধরে বললাম, “ডুলুং এর পরীক্ষা তো আর দু’দিন পর।”
“ওর পরীক্ষাটা শেষ হয়ে যাক। ঠাকুরকে আমি অনেক ডেকেছি, তার আগে যেন কিছু না হয়।” অন্তরা কথাগুলো শেষ করে চুপ হয়ে গেল। আমি ওর ম্লান শান্ত মুখের দিকে চেয়ে কান্না চেপে রেখেছি। কিন্তু আমার দু’চোখ ভিজে ঝাপসা হয়ে গেছে। বুক মুচড়ে আরও কান্না আসছে। অন্তরা এবার আমার দিকে চেয়ে করুণ আর্তি নিয়ে বলল, “তুমি কিন্তু আমার শ্রাদ্ধটা করবে। করবে কিন্তু!”
“এসব কেন বলছো?” আমার ঠোঁট ফেটে বেরিয়ে এল কান্না ভেজা দলা পাকানো এই কথা।
“তুমি তো এসব মানো না, তাই বললাম।”
আমি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছি ওর দিকে। ও শান্ত নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। আমি কি বলব বুঝে পাচ্ছি না।
একটু পরেই ও আবার বলল, “গৌড়ীয় মঠে করবে আমার শ্রাদ্ধ।”
“তুমি চুপ করো!” কান্না চেপে আর রাখতে পারলাম না।
“আরও কয়েকটা কথা তোমাকে বলতে চাই।” অন্তরা অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেছে। ও কি তবে বুঝে গেছে মৃত্যুর পূর্বাভাস ! কিন্তু কেউ তো ওকে কিছু বলে নি। মৃত্যু খুব কাছে চলে এসে দাঁড়ালে, মানুষ কি নিজেই তা টের পেয়ে যায়!
আমি অন্তরার মলিন বিবর্ণ মুখটার দিকে চেয়ে চুপ করে আছি। ও এবার ধীরে ধীরে বলল, “আমার দাহকার্য মিটে যাওয়ার পর চিতার একটু ছাই তুলে রেখো। তুমি ডুলুংকে নিয়ে একদিন ঝাড়গ্রামে যেও। চিল্কিগড়ের ডুলুং নদীর জলে ডুলুং যেন ভাসিয়ে দেয় আমার চিতার ছাইটুকু। আমি ডুলুং নদীর জলে ভেসে চলে যাব। বড় শান্তি পাব তখন।”
ডুলুং আমাদের একমাত্র সন্তান। ওর জন্মের পর মেয়ের নাম ডুলুং রাখতে চাই শুনে অন্তরা খুব খুশি হয়েছিল। বিয়ের পর একবার আমরা ঝাড়গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঝাড়গ্রামের শাল- মহুয়ার জঙ্গল, রাজবাড়ি, চিল্কিগড়ের কনকদুর্গার মন্দির ও ডুলুং নদী খুব ভালো লেগেছিল আমাদের। সেই সুখস্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আমাদের মেয়ের নাম রেখেছিলাম ডুলুং। অন্তরারও বড় প্রিয় নদী ছিল ডুলুং।
সেই ডুলুং নদীর জলে অন্তরা ভেসে চলে যেতে চায়। ওকে ভাসিয়ে দেবে আমাদের আদরের ডুলুং! তাই অবাক হয়ে বললাম, “তুমি এত কঠিন একটা কাজ ডুলুংকে দিয়ে করাতে বলছ কেন?”
অন্তরা আমার একথার কোনও উত্তর না দিয়ে বলল, “ডুলুংকে বলবে চিতার ছাইভস্মের সঙ্গে আমার একমাত্র সিডি অ্যালবামে যে ছবিটা আছে, সেই ছবিটাও যেন নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়।”
“তুমি এত কিছু ভেবে রেখেছো!” আমি কাঁদছি ঠোঁট কামড়ে।
“কেঁদো না। আমি আর ভালো হব না।”
“কে বলেছে তুমি ভালো হবে না?”
“ডুলুং এর বিয়ের জন্য রুপোর থালা, বাটি, গ্লাস, চামচ করে রেখেছি। বক্স খাটের মধ্যে নীলরঙের একটা শাড়িতে মোড়ানো আছে। যত্ন করে রেখে দিও। মেয়ে জামাই দু’জনের জন্যই করা আছে। বিয়ের সময় দিয়ে দেবে।”
“তুমি কখন এসব করলে?”
“করেছি। তুমি তো সংসারের সব খেয়াল রাখো না।” বড় অভিমানের মত শোনাল ওর কথাগুলো।
সত্যিই আমি তেমন সংসারী লোক হয়ে উঠতে কোনওদিনই পারি নি। একটু হলেও সংসারে ফাঁকি তো হয়েছেই।
“ডুলুং এর বিয়ের সময় তুমি আমার দেবীশ্বরী স্কুলের বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করবে। ওরা এসে ডুলুং এর বিয়ের কাজ সব করে দেবে। তোমার কোনও অসুবিধা হবে না।”
আমি চুপ করে চেয়ে আছি ওর দিকে। কত কিছু ভেবে রেখেছে। গোপনে, নীরবে সব সাজিয়ে নিয়েছে মনের মধ্যে। ধীরে ধীরে বলছেও সে সব কথা।
“ডুলুং এর পি এইচ ডি কমপ্লিট হলে তুমি ওকে একটা বড় কিছু উপহার দেবে। আমি তো তখন থাকব না। মনে থাকবে তোমার?”
“থাকবে।” আমি শান্ত হয়ে বললাম।
“মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। ওদের কাছে এত গোপন করেও ভালো হয়ে উঠতে পারলাম না। আর দেখা হবে না ওদের সাথে। তুমি কি কিছু বলেছো?”
“না। তুমি তো বারণ করেছো।”
“থাক আর বোলো না। আমি চলে যাওয়ার পরই সব বোলো।”

আমরা চুপ করে বসে আছি। যেন কথা ফুরিয়ে গেছে আমাদের। এই কাঁচে ঘেরা কেবিন থেকে বাইরের কোলাহল, মানুষজনের ব্যস্ততা সব দেখা যাচ্ছে। সে সবই দেখছি উদাসীন দৃষ্টিতে। অন্তরা আবার কথা শুরু করল, “তোমার সাথে তিরিশ বছর ঘর করলাম। ভালো-মন্দ কত কিছুই তো ঘটেছে আমাদের।” অন্তরা বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে একটু থামল। বুঝতে পারছি ও কিছু বলতে চায়। ভাবছে, কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। আমিও গুছিয়ে নিচ্ছি নিজেকে। ও কি বলতে চায় তা শোনার জন্য টানটান হয়ে চেয়ে রইলাম ওর দিকে, “আমাদের দু’জনের ভালো স্মৃতি গুলো মনে রেখো। কত জায়গায় আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি। এই একটা ব্যাপারে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। তোমার জন্য ভারতবর্ষটা প্রায় দেখা হয়ে গেছে।”
“আমরা আবার যাব বেড়াতে।”
“আর কোথাও যাওয়া হবে না। এবার তো চলে যাব!” কথা শেষ করে অন্তরা চুপ হয়ে গেল। আমিও আর এভাবে কথার পিঠে কথা সাজিয়ে যেতে পারছি না। মিথ্যে, অলীক সংলাপগুলো আওড়াতে আর ইচ্ছে করছে না। কষ্ট হচ্ছে। বুকের মধ্যে ক্ষরণ ও দহন আমাকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে।
“চুপ করে কি ভাবছো?” অন্তরা ভাসিয়ে দিল কথাটা।
“কি আর ভাবব!”
“ভুলে যেও আমাদের যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি। মনে রেখো না অপ্রিয়, খারাপ স্মৃতিগুলোকে।”
আমার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। চিবুক ছুঁয়ে বুকের গভীরে চলে যাচ্ছে সে অশ্রুজল। আমি কাঁদছি। কেঁদে আকুল হয়ে ওর হাতদুটো চেপে ধরলাম। অন্তরা কেমন উদাস হয়ে বলল, “তুমি অনেক চেষ্টা করলে, পরিশ্রম করলে। কিন্তু বাঁচাতে পারলে না। এ আমার দুর্ভাগ্য। ট্রিপিল নেগেটিভরা বাঁচে না। আমি চলে যাচ্ছি। তোমরা ভালো থেকো।”
“কি করে ভালো থাকব বলো?”
“তোমার তো ‘অন্য ভুবন’ আছে। ‘সবুজ পাঠ’ কে নিয়ে মেতে থেকো।”
“তোমাকে আবার ‘অন্য ভুবনে’ নিয়ে যাব। তুমি বাচ্ছাদের গান শোনাবে। গল্প বলবে।”
“যেতে তো ইচ্ছে করে, কিন্তু আর যাওয়া হবে না।”
আমি কথা হারিয়ে চুপ হয়ে গেছি। অন্তরা দু’চোখ বন্ধ করে এবার বলল, “তোমাকে আর একটা কথা বলব, শুনবে?”
“হ্যাঁ বলো।”
“এটা আমার শেষ ইচ্ছের কথা। তুমি চাইলে রক্ষা কোরো। আমার কোনও জোর বা দাবী নেই।”
“ওভাবে বলছো কেন?”
“তুমি তো লিখতে ভালোবাসো। অনেক লিখেছো। আরও লিখবে। লেখাটা নষ্ট করবে না। ছেড়ে দেবে না।”
“কিন্তু আমার পাণ্ডুলিপির ভুলগুলো তুমি তো আর সংশোধন করে দেবে না! ঠিক বানানগুলো চটজলদি কে বলে দেবে?”
“অভিধানটা কাছে রেখে লিখবে।”
“এটাই কি তোমার শেষ কথা!”
“না।”
আমি তাকিয়ে আছি অন্তরার মুখের দিকে। ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অপলক দৃষ্টিতে পরস্পরকে দেখছি। অন্তরার দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে নামছে। এই প্রথম ওকে কাঁদতে দেখছি। আমার দু’চোখেও জল। দৃষ্টি ঝাপসা। অন্তরা আমার ডানহাতটা চেপে ধরে খুব আকুল হয়ে বলল, “আমি চলে যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবে? লিখবে তো! আমি খুব আনন্দ পাব। এটাই আমার শেষ ইচ্ছের কথা।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।