সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ২)

সালিশির রায়

কিস্তি – ২

সেদিনই যেন অঞ্জলির কপালে লেখা হয়ে যায় বীভৎস সেই রাতের বিধিলিপি। নিজেরদের বাড়ির ধ্বংস স্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে একে একে সব মনে পড়ে যায় অঞ্জলির। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার মেয়েবেলার নানান ছবি। বাবা-মা আর চার ভাই বোনকে নিয়ে ছিল তাদের সংসার। দিদি সনমনি আর দাদা নিপুনের পর সে। তারপর ভাই স্বপন। দিনমজুরী করেই চলত তাদের সংসার। তারা যখন খুবই ছোট তখন বাবা–মা তাদের রেখে খাটতে যেত। তারা ঠাকুমার কাছে থাকত। বাবার রোজগারের সিংহভাগই চলে যেত নেশার পিছনে।
বাবার বন্ধু চামটা কাকা, দুরোই কাকারাও বিকাল হলেই চলে আসত বাড়িতে। মাঝ উঠোনে তালাই পেতে বসে যেত বাড়িতে তোলা মদের গোলা নিয়ে।সঙ্গে থাকতে মাঠ থেকে শিকার করে আনা ইঁদুর, বেজি কিম্বা সোনাগোদার মাংসের চাট। কোন কোন দিন শুয়োরের মাংসও থাকত। মদের আসর ভাঙতে কত রাত হত তা টের পেত না তারা। তারা তখন ঠাকুরমায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়ত। সে আর দিদি ঠাকুরমায়ের কাছে শুত। ভাই মা– বাবার সঙ্গে আর দাদা পরান কাকুদের স্যালো ঘরে। পরান কাকুদের বাড়ি পাশের ধোওয়াডাঙ্গা গ্রামে। পরান কাকুরা জোতদার লোক। তাদের জমিতেই বারো মাস বাঁধা মুনিশের কাজ করত বাবা- মা। আর দুবেলা খাওয়া আর বছরে দুটো লুঙ্গির বদলে দাদা ওদের গরু ছাগল দেখত। রাত জেগে স্যালোও চালাতে হত। তাদের অভাবের সংসারে ঠাকুমাই ছিল তাদের আদরের ঠাঁই।
ঠাকুমার স্মৃতি যেন আজও জ্বল জ্বল করছে। সেই ঠাকুমায়ের পরিনতির কথা ভাবলে আজ যেন দম বন্ধ হয়ে আসে অঞ্জলির। নিজেকে কেমন অসহায় মনে হয়। ঠাকুমার মৃত্যুর পরই তারা প্রথম বুঝেছিল আদিবাসী সমাজের অনুশাসন কাকে বলে। বাবা তখনও মোড়ল হয়নি। সেই সময় একদিন ঠাকুরমার পায়ে কুষ্ঠ ধরা পড়ে। সেটা বাড়তে থাকে। শহর থেকে ওষুধ এনেও উপশম হয় না। বরং একের পর এক আঙুল খসে পড়তে থাকে। দুর্গন্ধে কেউ কাছে ঘেষতেই পারত না। সে আর দিদি দুবেলা ডেসিং করে ওষুধ লাগিয়ে দিত। খাইয়েও দিত সময় মতো। আস্তে আস্তে পচন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুমায়ের কুষ্ঠ হওয়ার খবরটা ছড়িয়ে পড়ে পাড়ায়।
খবরটা জানাজানি হতেই পাড়ার লোকেরা তাদের অচ্ছুৎকরে দেয়। কেউ আর তাদের বাড়ির ছায়া পর্যন্ত মাড়ায় না। বেশ কয়েক মাস শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকার পর একদিন রাতে মৃত্যু হয় ঠাকুরমার। তারপরই ঠাকুরমার সৎকার চরম টানাপোড়েন শুরু হয়। ৩ কিমি দূরে নদীর ধারে শ্মশান। সেখানেই তাদের পাড়া সহ ৪/৫ টি আদিবাসী পাড়ার মৃতদেহ সৎকার করা হয়। ঠাকুরমার মৃত্যুর পর বাবা যেন কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে। কারণ তারা না জানলেও বাবা তো আদিবাসী সমাজের অনুশাসনের কথা জানত। কুষ্টে মৃত্যু হলে কেউ যে সেই মৃতদেহ ছোঁবে না তা বাবার অজানা ছিল না। এসব ক্ষেত্রে পরিবারের লোককেই একাই সৎকার করতে হয়।
কিন্তু একা মৃতদেহ অতদুরে নিয়ে গিয়ে সৎকার করা সহজ কাজ নয়। দাদা তো তখনও নেহাতই ছেলে মানুষ। তাই ঠাকুরমায়ের মৃতদেহের পাশে কেমন যেন থম মেরে বসে পড়েছিল বাবা। সে আর দিদি ছুটে গিয়েছিল বাবার বন্ধু চামটা কাকা, মলিন্দ কাকাদের বাড়ি। তারা দূর থেকেই দেখতে পায় তাদের দেখে চামটা কাকা ঘরের ভিতরে ঢুকে যায়। আর কাকী বলে, কাকা সেই সকালেই মেয়ের বাড়ি গিয়েছে। আজ আর ফিরবে না। সেখান থেকে তারা যায় মলিন্দ কাকার বাড়ি। মলিন্দ কাকার মেয়ে বেলমতি অঞ্জলির সঙ্গেই পড়ত। হাতের কাছে তাকে পেয়েই অঞ্জলি বলে , বেলু কাকা কই? আমার ঠাকুরমা মারা গিয়েছে। সবটা শোনেও না বেলমতি। অঞ্জলিকে থামিয়েই বলে ওঠে — তা বাবা কি করবে শুনি ? তোর ঠাকুরমা তো কুষ্ঠ হয়ে মরেছে। কেউ ছোঁবে না। যা না মোড়লের কাছে গিয়ে দেখ কি বলে।
বেলমতির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অঞ্জলি। স্কুলে একসঙ্গে পড়াশোনা করেও বেলমতি কি করে এইরকম কথা বলতে পারল তা ভেবে পায় না অঞ্জলি। ভেবে পায় না, মাস খানেক আগেও যারা তাদের বাড়িতে গিয়ে বাবার পয়সায় মদ মাংস খেয়ে এসেছে তারা বাবার এই বিপদের দিনে কি করে সব ভুলে গেল ? কিন্তু ভাবার মতো সময়ও নেই। দু’বোন তখন ছুটে যায় কালীরাম কিস্কুর বাড়িতে। কালিরাম জ্যেঠু ছিলেন তখন পাড়ার মোড়ল। তিনি তখন কয়েকজন সাঙ্গ-পাঙ্গকে নিয়ে চারপায়ে বসে হাতের তালুতে খইনি টিপছিলেন। তারা জ্যেঠুর পায়ে ধরে বলেছিল, জ্যেঠু হঠাৎ করে ঠাকুমা মারা যাওয়ায় বাবা যেন কেমন হয়ে পড়েছে। আপনারা একবার গেলে ভালো হয়।
জ্যেঠু ধীরে সুস্থে খইনি টেপা শেষ করেন। পারিষদদের একটু করে দিয়ে বাকিটা একহাতে ঠোট ফাঁক করে চালান দেওয়ার পর এক চোখ টিপে তাকানোর সময় পান। যেন কোন মৃত্যু সংবাদ নয় , খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করতে এসেছে তারা দু’বোন। চাউনি দেখেই গা,টা রি-রি করছিল তার। সেটা আন্দাজ করেই বোধহয় কালি জ্যেঠু মাছি তাড়ানোর মতো করে বলেন, তা আমি কি করব ? যা – যা, বাপকে বলগে গলায় খড়ের দড়ি বেঁধে টানতে টানতে পুঁতে দিয়ে আসবে। কুষ্ঠে মরা আমারা কেউ ছোঁব না। অন্যের হলে তোর বাবাও ছুঁত না।
আর শুনতে পারেনি তারা। দুই বোন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত বাবা একাই ঠাকুমাকে গলায় দড়ি বেঁধেই কুকুর-ছাগলের মতোই টেনে–ছেচড়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল। শ্মশানের ধারে নদীর চরে ঠাকুরমাকে পুতে ভোর রাতে ফিরেছিল ক্লান্ত বিধস্ত বাবা। কিন্তু দুদণ্ড তিষ্ঠোতে না তিষ্ঠোতে প্রচন্ড হইচই শোনা যায় মোড়লের বাড়িতে। বাড়ি থেকেই অঞ্জলিরা শুনতে পায় উত্তেজিত গলায় সবাই বলাবলি করছে — এ ঘোরতর অন্যায়। কিছু একটা বিহিত না হলে মারাং বুরুর কোপে গ্রামকে গ্রাম শেষ হয়ে যাবে। অঞ্জলিরা কিছু বুঝতে পারে না। কিন্তু দ্রুত চিৎকারটা তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।