সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ২০)

সালিশির রায়

কিস্তি – ২০

তার রেশটা এখনও মায়াঅঞ্জন হয়ে লেগে রয়েছে অঞ্জলির চোখে। হৃদয়দা চলে যাওয়ার পর তার কোন কাজে মন লাগে না। কি করে যে হৃদয়দাকে সে হৃদয়ে এতখানি জায়গা দিয়ে বসল কে জানে। এর আগেও দু’জন তার দিকে এগিয়ে এসেছিল। একজন সনাতনকাকার ছেলে শোভন আর একজন গেরস্থ পাড়ার সুনীল মোড়লের ছেলে অশোক। সে পাত্তাই দেয় নি। দু’জনের চোখের ভাষা লুঠেরার মতো। আর হৃদয়দার চোখে সে দেখেছে দীঘির অতল জলের ইশারা। সে দীঘিতে ডুবেও বড়ো সুখ। কিন্তু সে পাত্তা না দিলে কি হবে , শয়তান দুটো আজও তার পিছু ছাড়ে নি। একা কোথাও দেখলেই কু’ইঙ্গিত করে , অশ্লীল কথা বলে। তার গা জ্বলে যায়। কিন্তু সে তো মেয়ে , তাই কিছু বলতে পারে না পাঁচকান হলে পাঁচজনে পাঁচকথা বলবে। সবাই তাকেই দোষ দেবে। বলবে, ধিঙ্গীপনা করে বেড়ালে ছেলেরা তো সুযোগ নেবেই। মাঝখান থেকে তারই বদনাম হবে। তারপর যদি একবার কেউ কথাটা মোড়ল পরিষদের কানে তুলে দেয় তাহলে তো কথাই নেই। অবধারিত সালিশি সভা বসিয়ে আবার জরিমানা করা হবে। তাই সে ওদের এড়িয়েই চলে।
কিন্তু আজ আর তা পারল না। হৃদয়দা বেরিয়ে যাওয়ার পর বাইরের দরজাটা খোলাই ছিল। সে একাই রান্নাচালায় বসে বসে হৃদয়দার কথাই ভাবছিল। ভাইটা কাঁদরে ছিপ নিয়ে মাছ ধরত গিয়েছে। মা শুয়েছে ভিতরের ঘরে। সেই সময় চুপি চুপি বাড়িতে ঢোকে শোভন। তাকে দেখে অবাক হয়ে যায় অঞ্জলি। এতদিন মাঠে ঘাটে নোংরামি করেছে , বাড়ির ভিতরে আসার সাহস পায়নি। আজ কি মতলবে বাড়ির ভিতরে এসে সিঁধোল তা ভেবে পায় না। একরাশ বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে শোভনের দিকে তাকায় সে। আর গোটা শরীর এঁটো করার দেঁতো হাসি হেসে শোভন বলে —- এক জায়গায় দুই দর তো চলবে না রে।।
—- মানে ? কি উল্টোপাল্টা বলছিস তুই ?
— কি বলছি তুই বুঝতে পারছিস না ? ওই রাজমিস্ত্রি ছোঁড়াটা এলে মুখে মধু ঢেলে কথা বলিস আর আমাকে দেখে চোখে আগুন ঝড়াস কেন ?
— খবরদার, হৃদয়দাকে ছোঁড়া বলবি না। তুই তো ওর নখেরও যোগ্য নোস।
—- ওঃ খুব গায়ে বাজছে দেখছি। ছোড়াটার হাতে হাত রেখে কি করছিলি কিছু দেখি নি ভাবছিস। ওই জামরুল গাছটা থেকে সব দেখেছি। ওকে রাস্তায় আসতে দেখেই তোরা কি করিস তা দেখার জন্য গাছে চেপে বসেছিলাম।ওই কথা শুনেই খুব রাগ হয়ে যায় অঞ্জলির।
অসভ্যতারও একটা মাত্রা আছে। অন্যের বাড়িতে নজর রাখার জন্য গাছে চড়ে বসে থাকা শুধু অসভ্যতাই নয় , চূড়ান্ত অন্যায়ও। তাই কড়া করে দু’কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না সে। বলে, আমার বাড়ির ভিতরে আমি কি করব না করব তা কি তুই ঠিক করে দিবি ? আমার যা ইচ্ছে তাই করতে পারি , তাতে তোর কি রে ?
—- না তা তুই পারিস না। কোথাকার কে এক ছোঁড়া এসে পাড়ার মালের মধু খেয়ে যাবে আর আমরা আঙুল চুষব ? তা হবে না।
বলে জোর করে অঞ্জলির হাত ধরে নিজের বুকের দিকে টানার চেষ্টা করে শোভন। আর সহ্য করতে পারে না অঞ্জলি। সপাটে একটা চড় কসাই শোভনের গালে। শোভনের চোখে তখন জ্বলে কামনা আর আক্রোশের আগুন। সে একটু একটু এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে। আর অঞ্জলি একটু একটু করে পিছিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নেয় দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো বঁটি। তারপর শোভনের দিকে তাক করে বলে, আয় এগিয়ে আয় দেখাচ্ছি মজা।
ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে শোভন বলে — কাজটা তুই ভালো করলি না। এর শোধ আমি একদিন সুদে আসলে তুলবই।
— বেশ , যা পারিস করিস। কিন্তু এরপর আমার গায়ে হাত দিতে এলে আমি তোর হাত বঁটির এক কোপে নামিয়ে দেব।
সেই সময় এক হাতে ছিপ আর অন্যহাতে একটা শোল মাছ ঝুলিয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢোকে দুলাল। তাকে দেখে সুর সুর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় শোভন। আর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে অঞ্জলির। সে আশঙ্কা করেছিল বিষয়টি নিয়ে হয়তো বাড়াবাড়ি করবে শোভন। কিন্তু ভাইকে দেখে তার ওই পালানোর ভঙ্গিমাই বলে দিচ্ছে সেও বিষয়টি জানাজানি হোক চায় না। তাই আপাতত কোন দুর্যোগের আশঙ্কা নেই। কিন্তু দিদির রণচণ্ডী রূপ দেখে অবাক হয়ে যায় দুলাল। তার কাছে এসে বলে , কি হয়েছে রে দিদি। শয়তানটা কি তোকে কিছু বলেছে ? দিলি না কেন এক কোপ। সেদিন শয়তানটা ও মাকে ঢিল ছুড়ে মেরেছিল। অঞ্জলি দেখে ভাইয়ের চোখে আগুন আর তার হাতে তখনও ধরা রয়েছে বঁটি। তাড়াতাড়ি সে বঁটিটা দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিয়ে ভাইকে কাছে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ও কিছু না। ভাইটার চোখেও যেন আগুন জ্বলে। সেদিনের পর থেকে মোড়লের ছেলে তো বটেই পাড়ার বন্ধুদের সংগে খুব একটা মেশে না দুলাল। নিজের মাকে বন্ধুদের বাবা-মা’দের নির্মমভাবে মারার সেই ঘটনাটা তার মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাবা–মায়ের ওই আচরণের জন্য যেন তার বন্ধুরাও দায়ি।
সেই মনোভাব থেকে সে ছোট ছোট বন্ধুদের ও এড়িয়ে চলে। তাই খেলার সময়ে সে ছিপ নিয়ে মাছ ধরে বেড়ায়। তাতে পরিবারের কিছুটা সুবিধাই হয়। পয়সা দিয়ে মাছ কেনার সামর্থ্য তো নেই। কোন দিনই বা ছিল ? এক লহমায় ছোটবেলাটা যেন সামনে এসে দাঁড়ায়। তারা বর্ষাকালে মাঠনালা, গর্তের জল সেঁচে ধরে নিয়ে আসত ছোট ছোট মাছ, সাদা কাকড়া, গুগলি। বাবা কখনও আঁধারকাঠি দিয়ে চ্যাঙ, ছিমুড়ি, কই, কখনও ব্যাঙ কিন্বা ছোটমাছ বঁড়শিতে টোপ গেঁথে শোল, বোয়াল মাছ ধরার জন্য কাঁদরে জ্যা-ডাঁড়া পুতে দিয়ে আসত। তারপর খুব ভোর ভোর সেই ডাঁড়া তুলতে বেরিয়ে যেত। না হলে কেউ বড়শি থেকে মাছ ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যেত। কখনও কখনও মাছ সমেত ছিপও লোপাট হয়ে যেত। তা নিয়ে কত জনের সঙ্গে কত যে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে তার ঠিক নেই।তবে মাঝে মধ্যেই বাবা বোয়াল কিম্বা শোল মাছ ধরে নিয়ে আসত। তারা ওইসব মাঝের ঝাল খুব ভালোবাসত। মা কাচা লংকা দিয়ে ঝাল করত। সেবারে একটা মজা হয়েছিল। বাবা মাঠ থেকে একটা বান মাছ ধরে এনেছিল। সাপের মতো মাছটা দেখে তো ভয়ে সাড়া। প্রথম দিকে খাওয়া তো দুরের কথা কিছুতেই মাছটার ধারে কাছে ঘেঁষছিল না তারা। তারপর মা যখন মাটির হাঁড়িতে তেঁতুল দিয়ে টক করেছিল তখন তিনদিন ধরে সেই টক খেয়েছিল তারা।
সবথেকে মজা হয়েছিল কাছিমটাকে নিয়ে। বাবার ডাঁড়াতে একবার একটা কাছিম উঠেছিল। ভাই তো কিছুতেই কাছিমটাকে খেতে দেবে না। পোষার জন্য বায়না ধরে। সেই মতো একটা পাতনাতে পোষা হয় সেটাকে। কিন্তু যখন তুলে মাটিতে নামানো হত তখন সেটা যেই মুখ বের করে চলতে শুরু করত অমনি ভাই ভয়ে দূরে সরে যেত। দূর থেকে লাঠি দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করত। একদিন সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে কাছিমটা পিছনের ডোবায় নেমে যায়। আর মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ভাইয়ের সে কি কান্না। মা কোলে নিয়ে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। শেষে বাবা এসে বলে, কাছিমটা তো বাচ্চা পাড়তে গিয়েছে। কয়েকদিন পরেই অনেকগুলো বাচ্চা নিয়ে ফিরে আসবে। তারপর থেকে ভাই সকাল- বিকাল নিয়মিত ডোবাটার পাড়ে গিয়ে জলের দিকে তাকিয়ে থাকত। আর ‘ কই কাছিমটা বাচ্চা নিয়ে আসছে না তো ‘ বলে বলে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।তারপর একদিন আপনা থেকেই সব ভুলে যায়। সব যেন সেদিনের ঘটনা। আজ দিদি আসছে , ভালোই হয়েছে। ভাইয়ের ধরে আনা মাছটা দিয়ে সে মায়ের মতো ঝাল করবে। দিদির নিশ্চয় খুব ভালো লাগবে। কিন্তু সরষে নেই বাড়িতে। তাই সে দুলালের হাতে ২ টো টাকা দিয়ে বলে , যা তো ভাই মোড়ের দোকান থেকে দেড় টাকার সরষে নিয়ে আয়।আর চার আনার তুই কিছু নিস। বাকি চারআনা ফেরত আনবি কিন্তু। তাড়াতাড়ি ফিরবি।ভাই মহানন্দে ছুটতে ছুটতে চলে যায়। আর তখনই গ্রামের পথে ভেসে আসে মোটরবাইকের শব্দ।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।