সাপ্তাহিক অণু উপন্যাসে সুব্রত সরকার (পর্ব – ৭)

বনবাসের বর্ণমালা

সাত

শুভ্র খুব সাবধানে একটু একটু করে ঘন জঙ্গলের পথে অনেকটা এগিয়ে গেল। কিন্তু হরির দেখা পেল না। এই জঙ্গলে আর কোনো মানুষ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। সূর্যের আলো ভালো করে ঢোকে না, তাই কেমন ছায়া ছায়া গা ছমছমে চারপাশ। শুভ্র হাল না ছেড়ে আরও এগিয়ে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। জঙ্গলে কতরকম শব্দ হচ্ছে, পোকা ডাকছে, পাখি ডাকছে, ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে একটা শব্দও শুনতে পাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু’একটা রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে।
পাখির ডাকের সাথে হঠাৎ এক উচ্ছল হাসির রিন রিনে শব্দ ভেসে এল শুভ্রর কানে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে শুভ্র। এ নিশ্চয়ই কোনো মহিলার হাসি। খুব খুশির হাসি সে হাসছে। কিন্তু হাসিটা যে কোথা থেকে ভেসে এল তা বোঝার চেষ্টা করছে শুভ্র। এবার ওকে আরও অবাক করে দিয়ে ভেসে এল পুরুষের হাসি। এ হাসির দমক তো ভীষণ চেনা! মন বলল, এ তো হরিশংকরের হাসি। শুভ্র এবার অনুমান করতে পারছে খুব কাছাকাছি কেউ আছে। তারা হাসছে, কথা বলছে, গল্প করছে। মোটকথা মানুষজন আছে। এতক্ষণে শুভ্র যেন একটু প্রাণ ফিরে পেল। স্বস্তি নিয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়াল। তারপর ওখান থেকেই হাঁক মারল, “হরিশংকরদা তুম কাঁহা হো?”
“দাদা, মত ডরিয়ে। হাম হ্যায়।” ভেসে এল হরির অভয় বাণী।
শুভ্র প্রত্যুত্তরে আবার বলল, “তুম কাঁহা হো?”
“দাদা, আউর থোরা দো’কদম আইয়ে না।”
শুভ্র খুব দ্রুত হেঁটে কয়েক পা এগোতেই দেখল, জঙ্গলের গভীরে গাছের ডাল-পালা, লতা-পাতা দিয়ে বানানো এক ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের বারান্দায় বসে এক নারী আগুন জ্বেলে সেই আগুনে কি সব সেঁকছে। হরি তার গা ঘেঁষে বসে বেশ হাসি ঠাট্টা, রঙ্গ রসিকতা করছে। দেখে মনে হল সে রমণী হরিকে প্রশ্রয়ই দিচ্ছে। দু’জনে তাই বেশ রমণীয় খুনসুটিতে মজে মশগুল হয়ে আছে।
শুভ্র সেই পর্ণকুটিরের কাছে গিয়ে বুঝতে পারল ওরা দু’জনেই নেশা করেছে। তাই এমন অকারণে হাসছে, কথা বলছে। শুভ্র এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “তুমি আমাকে কিছু না বলে বসিয়ে রেখে চলে এলে কেন?”
“আরে দাদা, তুমি ঝর্না দেখছিলে দেখে আমি আর ডিস্টার্ব করি নি। ভাবলাম তুমি এঞ্জয় করছো, করো।”
“এতক্ষণ একা একা ছিলাম, ভয় লাগছিল তো!”
“আরে দাদা, ডরনে কি কোই বাত নহি।”
শুভ্রর রাগ এতটুকু কমে নি। তবু আর কোনও তর্কে গেল না। হরি টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দাদা, তোমার কোই গালফ্রেন্ড হ্যায়?”
শুভ্র কি বলবে বুঝতে না পেরে একটু ধমক দিয়েই বলল, “হরিদা এবার চলো।”
“আরে দাদা, গালফ্রেন্ডের সাথে এট্টু দেখা হল, এট্টু দারু পিয়ে নিলাম দু’জনে। গুসসা কিউ দাদা! ইয়ে লতা মেরি গালফ্রেন্ড হ্যায়।”
লতা হা হা করে হেসে উঠে বলল, “দাদা, তুম ভি হো যাইয়ে না মেরা বয়ফ্রেন্ড!”
শুভ্র বেশ বুঝতে পারল, ওরা দু’জনেই এখন মাতাল হয়ে আছে।
বেলা অনেক হয়েছে। সূর্য এখন মাথার ওপর। এবার ফিরে যেতে পারলেই ভালো।
লতা আগুনে সেঁকছে এলাচের দানা। এই জঙ্গলে বড় এলাচের গাছ আছে প্রচুর। এলাচ বেচেই ওদের অর্থ রোজগার হয় বেশি। আদা গাছও আছে জঙ্গলে। এলাচ ও আদা এই দুটো প্রধান ফসল। শীতকালে কমলালেবু হয় এখানকার অনেক বাগানে। লতা এক মুঠো এলাচ দানা শুভ্রর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দাদা লিয়ে যা। বহুত আচ্ছা ইলাচ হ্যায়। ঘর লে যা।”
শুভ্র হাত বাড়িয়ে লতার থেকে এক মুঠো এলাচ দানা নিল। হরি জোরে হাততালি দিয়ে হেসে বলল, “লতা, দাদা কা গুসসা চলা গয়া।”
লতা খুব হাসছে। পাহাড়ি লতার শরীরে সাজপোশাক তেমন কিছু নেই। চোখ-মুখ খুব উজ্জ্বল ফর্সা। বেশ দেখতে লতাকে। খুনসুটি করার সময় আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। হরি লুকিয়ে লুকিয়ে লতার সাথে ভালোই রঙ্গ-তামাশায় মজে ভুলেই ছিল সব।
লতাকে বিদায় জানিয়ে হরিকে নিয়ে শুভ্র জঙ্গলের পথে ফিরে আসছে। হরির কথা জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। পা দুটো টলমল করছে। হরি হঠাৎ গান গেয়ে উঠল, হরির গান শুভ্র আগে শুনেছে। হরি গিটার বাজিয়ে সুন্দর গান গাইতে পারে। হরি এখন খালি গলায় খুব দরদ দিয়ে গাইছে, “মেরে সপনোকি রানি কব অ্যায়গি তু…”
দু’জনে হাঁটছে। দূর থেকে মুন্নি ঝোরার জলের আওয়াজ ভেসে আসছে। জঙ্গলের আড়াল আবডাল থেকে পাখিরা ডাকছে। পাখির ডাক শুনতে শুনতে শুভ্রর মনটা উদাস হয়ে গেল। মণিকুন্তলার কথা মনে হল হঠাৎ। এরকম গভীর নির্জন জঙ্গলে ও যদি বেড়াতে আসত, ওরও নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগত। ওর জামাইবাবুটা এক্কেবারে নচ্ছার। ওকে বড্ড জ্বালাতন করে। মণিকুন্তলাও দিদির কথা ভেবে কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে জামাইবাবুর নষ্টামি। শুভ্র মনে মনে ভাবছে, ওকে নয় বলবে, তুই এবার বিয়েটা করে ফেল। দেখবি আর সাহস পাবে না এই সব মেসেজ পাঠাতে। একটু হলেও ভয় পাবে তোর ওই বজ্জাত জামাইবাবু।
মণিকুন্তলা তখন যদি বলে, “ঠিক আছে, তুই ছেলে দেখে দে!”
শুভ্র কি পারবে সেই ছেলেকে খুঁজে বের করতে!…

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।