গল্পবৈঠক ৩৪ এর গল্পে সবিতাব্রত সিংহ বাবু

গল্প একটি রঙিন ছাতার গল্প

হঠাৎ বিকালের দিকে ঈশান কোণ থেকে একটা কালো মেঘ উঠলো। সুবর্ণকে বাইরে যাওয়ার পোশাক পরতে দেখে মা বললেন, “ এখনই বৃষ্টি নামবে খোকা, এখন বাইরে না গেলেই পারতিস।”
মাথায় চিরুনি চালাতে চালাতে আয়নায় মায়ের প্রতিবিম্বের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে মুচকি হেসে সুবর্ণ বলে, “এই টিউশনটা কামাই করা চলবে না মা। কাউন্সিলার, ভালো টাকা দেয়। তাছাড়া বাবার ঔষধ আনতে তো বাইরে যেতেই হতো মা।”
” আচ্ছা খোকা, কতদিন এমনি করে চলবে বলত। তোর বাবা কি আর সুস্থ হবে না কোন দিন? ”
সুবর্ণ মায়ের কাঁধে দু’টো হাত রেখে বলে, ” আমাদের তো হাল ছেড়ে দিলে চলবে না মা। তা ছাড়া ডাক্তার বাবু তো বলেছেন বাবার ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। ”
” কি জানি বাপু, দূর্ঘটনার পর আজ এক বছর হতে চলল। এত এত টাকা খরচ হয়ে গেল অথচ নিজের পায়ে দাঁড়ানো তো দূরে থাক ভালো করে বস্তে পর্যন্ত পারে না। ”
সুবর্ণ এর কোন উত্তর দিতে পারে না। কি উত্তর দেবে, বাবা যে আর কোন দিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না, সেটা কেমন করে বলবে মাকে। বাবা আবার ঠিক হয়ে যাবে, আবার কারখানায় যাবে, সুবর্ণ আবার কলেজ যাবে। এই স্বপ্ন নিয়েই তো মা বেঁচে আছে। সুবর্ণর মনে হল স্বপ্নই হল মানুষের বেঁচে থাকার এক মাত্র অবলম্বন। স্বপ্ন ভেঙে যায়, মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ে, কষ্ট পায়। কিন্তু মানুষ থেমে থাকে না। দিশাহারা মানুষ স্বপ্নের মধ্যেই আবার দিশা খুঁজতে থাকে।
সুবর্ণকে চুপ কারে থাকতে দেখে মা বলেন, “আমি জানি খোকা এই বয়সে আমাদের জন্য তুই খুব ঝামেলায় পড়ে গেছিস। তোর বন্ধুরা সব কলেজ যাচ্ছে আর তুই সারাদিন অন্যের দোকানে কাজ করে আবার সন্ধ্যায় লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গানের টিউশন করছিস। আমার বড়ো কষ্ট হয় বাবা।” মায়ের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।
সুবর্ণ বেশ বুঝতে পারে দিন দিন মা খুব অসহায় বোধ করছে । ভয় পায়, সেও যদি দাদার মতো ছেড়ে যায়। যে সময় দাদাকে এই সংসারে সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল ঠিক তখনই সে আলাদা হয়ে গেল। সুবর্ণ বুঝতে পারে না, মা বাবা ভাই বোন এই সম্পর্কগুলোর কি কোন মূল্য নেই। আজকের দিনে স্বামী , স্ত্রী, পুত্র,কন্যা এর বাইরে কি মানুষ আর কিছুই ভাবতে পারে না। কে জানে, হয়তো তাই। কিন্তু মানুষ ভুলে যায়, আসলে সম্পর্কগুলো ঘূর্ণীয়মান চাকার মতো আজ যে উপরে আছে কাল সে নীচে নেমে যাবে।
সুবর্ণ মায়ের চোখ দু’টো মুছিয়ে দিয়ে বলে, ” আমি তো আছি মা, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
” আমরা তো সেই ভরসায় বেঁচে আছি বাবা। ”
সুবর্ণ আর দাঁড়ায় না, দ্রুত বেরিয়ে যায়। মা পিছন থেকে বলেন, ” ছাতাটা নিয়ে যা বাবা, এখনি বৃষ্টি নামবে। “
টিউশন শেষ করে সুবর্ণ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বলে, “ নীলা, বৃষ্টি বোধহয় থামবে না। তুই বারং একটা ছাতা দে, আমি বেরিয়ে যাই।”
নীলা উঠে এসে সুবর্ণর পাশে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে হাত রেখে বলে, “ বৃষ্টিতে ভিজতে আমার দারুণ লাগে। এই সুবর্ণদা, চল না ছাদে গিয়ে একটু ভিজে আসি।”
সুবর্ণ হাসে, “ নীলা তুই একটা পাগলী বুঝেছিস। তোর বাবা জানতে পারলে কি হবে ভেবে দেখেছিস।”
নীলা এক মুঠো জল নিয়ে সুবর্ণর দিকে ছুড়ে একেবারে ঠোঁটের কাছে মুখ এনে বলে, “ জানি সুবর্ণদা, জানি। আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্ক ভাগী।”
নীলার কম্পিত বুকের স্পর্শে সুবর্ণ আমূল কেপে যায়। এই অযাচিত দান ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি সঞ্চয় করে রুগ্ন বাবার অসহায় চোখ গুলোর কথা মনে করে। নীলার আবেশি দুটো চোখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সুবর্ণ বলে, “ গানের লাইন আর বাস্তব জগত এক নয় নীলা। বাস্তব বড়ো কঠোর, বড়ো রুক্ষ এখানে একজন আর একজনের বুকে পা রেখে এগিয়ে যেতে চায়। এখানে …. “
নীলা পায়ের পাতায় ভর দিয়ে সুবর্ণর ঠোঁটে ঠোঁট ছুইয়ে সুবর্ণকে কথা শেষ করতে দেয় না,ফিসফিস করে বলে, , “ জান সুবর্ণদা, আমাদের ঘরে এতো ক্ষমতা এতো গ্লামার যে স্বপ্নদেরেও এ্যপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হয়। আমি তোমার বুকে মাথা রেখে স্বপ্নের দেশে বাঁচতে চাই সুবর্ণদা। বল তুমি পারবে না তোমার দু’হাত দিয়ে আমাকে আগলে রেখে স্বপ্নের দেশে নিয়ে যেতে ।”
সুবর্ণ দু’হাত দিয়ে নীলাকে আমূল জড়িয়ে ধরে ।
ঠিক তখন রাতের অন্ধকারে শিকারী হায়নার জ্বলন্ত চোখের মতো দুটো চোখ পর্দার আড়ালে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে।

সে দিন সারা রাত ধরে বৃষ্টি হল। বাবা বার বার জানতে চাইলেন, ” খোকা কি এলো? এত রাত হয়ে গেল!
মা জেগে থাকলেন খোকার জন্য। জানালার গরাদ ধরে তাকিয়ে রইলেন গলির শেষ প্রান্তে আবছায়া অন্ধকারের দিকে, কখন সেই অন্ধকার ভেদ করে খোকা আসবে।
এক সময় ভোর হল। বৃষ্টিও থামল। পূর্ব দিকের দিগন্তরেখায় ছন্নছাড়া মেঘেদের সরিয়ে সূর্য্যদেব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠলেন। সোনা রঙের আলো ছড়িয়ে পড়লো গলিময়। ভোরের মৃদু আলোর মতোই একটি মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসতে লাগলো সেই গলি পথ দিয়ে। বেলা যত বাড়ল ততই গুঞ্জন ক্রমশ কোলাহলে পরিনত হল। সেই কোলাহলের মধ্যে ছিল, একটি হতাশ যুবকের আত্মহত্যার কাহিনি অথবা একটি রঙিন ছাতার গল্প।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।