গদ্যানুশীলনে সুদীপ ঘোষাল

পাড়ি

এক

– আজ কত হলো সুনীতা
– তিনশ কুড়ি টাকা রে।
সুনীতা আর সাতন কথা বলছেন রাতে।সাতন পাশের বাড়ির ছেলে।আসলে সুনীতা অভাবের সংসারে মানুষ হয়েছে।তার বাবা টোটো চালাতে গিয়ে এক পথ দুর্ঘটনায় মারা যান।সেই টোটো গ্যারেজে রেখে মিস্ত্রি ঠিক করে দেয়।এখন সুনীতা টোটো চালিয়ে বিধবা মা কে সাহায্য করে কিছু আয় ক’রে।সংসারটা তার রোজগারেই চলে।সুনীতার মা বলেন,সকালে বেরোবার আগে একবাটি জল উঠোনে নামিয়ে দিবি।কত পাখি একফোঁটা জলের জন্য হন্যে হয়ে ওড়ে।ওদের আশীর্বাদে তোর ভালো হবে। এটা ঠাকুর পুজোর থেকেও বেশি পুণ্যের। তোর বাবাও দিতেন।
সুনীতা একবাটি জল উঠোনে রাখে আর দু বোতল জল টোটো গাড়িতে রেখে দেয়।রাস্তায় চলতে চলতে অসহায় মানুষকে সে জল খাওয়ায় এই প্রচন্ড গরমে।
সুনীতা তার বাবার টোটো গাড়িটা চালায়।প্রতিবেশি বীণা তার মাকে বলে,অপয়া টোটো গাড়িটা তোর স্বামীকে খেল আবার তোর মেয়েকেও না খায় দেখিস বাপু।
রাতে বাড়ি ফিরলে সুনীতার মা তাকে সাবধান করে বলে,দেখিস সাবধানে টোটো চালাস। আবার কোনো দুর্ঘটনা যেন না ঘটে।যা অপয়া টোটো, তোর বাবাকে মারল আবার তোকেও যদি..
সুনীতা বলে,ওসব কুসংস্কার মা।আর কিছু হবে না দেখো।দুর্ঘটনা বারবার ঘটে না।
– আমার ভয় হয় বাপু।সারাদিন চিন্তায় থাকি।
– তুমি একদম চিন্তা কোরো না মা।বাবার আশীর্বাদ আমার সঙ্গে আছে।
সুনীতা মায়ের সঙ্গে রাতের খাবার খায় আর বলে,টোটো চালিয়ে বেশ ভালো রোজগার হচ্ছে মা।দেখো মাস ছয়েকের মধ্যে আমি আর একটা টোটো কিনব।
তার মা বলেন,আবার টোটো কিনে কি করবি?
– ভাড়া খাটাব মা।এই টোটো গাড়িটা আমি চালাব আর একটা ভাড়ায় চলবে।আয় হবে দ্বিগুণ। তাহলে পাকা বাড়ি করতে পারব।
– দেখিস মা। খুব সাবধানে চলিস।
সুনীতা বিছানায় শোয়।সারাদিনের খাটনিতে ঘুম খুব সুন্দর হয়।একেবারে একঘুমে সকাল হয় তার।
সকাল হলে ফ্রেশ হয়ে, হাতমুখ ধুয়ে কিছু জলখাবার খেয়ে বেড়িয়ে পরে টোটো গাড়িটা নিয়ে।সকালবেলা অনেক ডেলি প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে।মেন রাস্তায় দাঁড়ালে সুনীতা টোটোভর্তি লোকজন পেয়ে যায়।অনেকে তাদের গ্রামে যেতে চায় দশ কিমি দূরে।সেক্ষেত্রে সুনীতার লাভটা ভালোই হয়।এখন রাস্তার ধারে টোটোর ব্যাটারি চার্জের জন্য অনেক দোকান হয়েছে।দূরে কোথাও যেতে হলে সুনীতা ফুল চার্জ করে নেয় ব্যাটারীর।ফলে রাস্তায় অসুবিধা হয় না।আর তাছাড়া এলাকার সকলে সুনীতাকে চেনে।ফলে সুবিধা অসুবিধায় সুনীতার লোকের অভাব হয় না।
টোটোতে যাত্রীদের জীবনের নকশিকাঁথা শোনে সুনীতা।কতরকম নারী পুরুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এ আনন্দ সে আর কাউকে বোঝাতে পারে না।টোটো গাড়িতে একা থাকলে সে তার মৃত বাবার সঙ্গে কথা বলে।তার বাবা বলেন, কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে তুই জীবনের দূরপথে পাড়ি জমাতে পারবি রে।সুনীতা বলে,তোমার আশীর্বাদে একদিন দেখবে আমি তোমার স্বপ্ন সফল করে তুলব।
মাঝে মাঝে তার বন্ধু বান্ধবরা আসে। তারা বলে,মেয়েরা তো এ লাইনে কাজ করে কম। তুই কি করে সময় কাটাস রে।মাঝে মাঝে দেখি তুই আপনমনে কথা বলিস।সুনীতা বন্ধুদের চা, বিস্কুট খাওয়ায় আর বলে আমি কথা বলি আর গান শোনাই নিজেকে।নিজের সঙ্গে কথা বলে দেখবি, অনেক সুখ লুকিয়ে আছে জীবনে।নির্জনে নিজের সঙ্গে কথা বলে দেখবি, একাকিত্ব কত সুখের। বন্ধুরা সুনীতার কথা বুঝতে পারে না।তারা সুনীতাকে শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে।সুনীতার প্রয়োজনে তারা জান লড়িয়ে দেয়।আড়ালে তারা বলে,হিম্মত আছে মেয়েটার। বাবার পুরোনো টোটো চালিয়ে সংসারটা বাঁচিয়ে রেখেছে।বাপের বেট বটে।
সুনীতাকে সনাতন টোটোওয়ালা একটু বেশি কথা বলে।সনাতন তার থেকে পাঁচবছরের বড় হবে।যেতে আসতে তাদের চোখে চোখে কথা হয়।সুনীতা নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।অতশত প্যাঁচপোচড় বোঝে না।তবে সনাতনের বাড়তি আগ্রহ তার ভালো লাগে।সে বলে, সনাতনদা, এবার আমি একটা নতুন টোটো কিনব।
সনাতন বলে,আমার তো টোটো নাই।একজনের টোটো চালাই।দিনে একশ টাকা তাকে দিতে হয়।
– রোজ একশ টাকা মানে মাসে তিন হাজার টাকা।
– হ্যাঁ ওদের টাকা দিয়ে আমারও তিনহাজার টাকা লাভ থাকে।
– তিনহাজার টাকায় তোমার সংসার চলে?
-চলে না তবে বাড়িতে অবসর সময়ে টিউশানি করি।আমার আর বোনের কোনোরকমে চলে যায়।
– তোমার বাবা মা নেই?
– না, করোনায় মারা গেছেন।
– ও খুব দুঃখজনক ঘটনা গো।
– আমরা দুজনে বেঁচে আছি।
– তা হলে সনাতনদা আমি নতুন গাড়ি কিনলে তুমি চালাবে।মাসে দুহাজার দিলেই হবে।
– তাহলে তো নিশ্চয় চালাব।এই টোটোগাড়িটা মালিককে জমা দিয়ে তোমার গাড়ি চালাব।
সুনীতার টাকা জমেছে ব্যাঙ্কে প্রায় দেড়লক্ষ টাকা।সে দেরী না করে নতুন টোটো গাড়িটা কিনেই ফেলে দুদিন পরে।
সেদিন সুনীতার মায়ের কি যে আনন্দ হল তা বলার নয়।প্রতিবেশীদের রসগোল্লা বিতরণ করা হলো।
সুনীতা তার মাকে বলল,নতুন গাড়ির চালকও ঠিক হয়ে গেছে মা।সনাতনদা চালাবেন আর মাসে মাসে দুহাজার টাকা দেবেন।গাড়ির খরচ খরচা সব সনাতনদার।
সুনীতার মা বললেন,ছেলেটাকে একদিন বাড়ি নিয়ে আসিস মা। মিষ্টিমুখ করে যাবে।
সুনীতা বলল,ঠিক আছে মা।

দুই
মাস তিনেক পরে সুনীতা বলল,সনাতনদা আমাদের বাড়ি চলো, মা ডেকেছেন।
সনাতন বলল,চলো টোটো গাড়ি চালিয়ে যাই তোমাদের বাড়ি।
সুনীতা পুরোনো গাড়িতে আর সনাতন নতুনটায়।দুজনে বাড়ি ঢুকে বসল।সুনীতার মা বললেন,এতদিনে সময় হলো সনাতন।এসো হাত ধুয়ে কিছু খাও।
সনাতন হাত ধুয়ে খেল। তারপর সুনীতার মাকে প্রণাম করে বলল,শোনো মাসীমা তুমি আমার মায়ের মত।আমি তোমার অনেক কথা শুনি সুনীতার কাছে।সুনীতার মা বলেন,তোমার বোনের তো বিয়ে দিলে সুনীতা বলছিল।
– হ্যাঁ মাসীমা।একমাস হলো একটা ছেলে দেখে বোনটার বিয়ে দিলাম।ছেলেটা একটা ট্যাক্সি চালিয়ে রোজগার করে।বেশ ভালো ছেলে।
– কত খরচ হলো বিয়েতে?
– আশ্রমে বিয়ে দিয়েছি।ওরা কোনো টাকাপয়সার দাবি করে নি।বিয়ে হয়েছে ভালোভাবেই।
– বেশ বাবা বেশ।আমি খুব খুশি হয়েছি।তবে এবার সুনীতার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করতে হবে।
– বেশ মাসিমা। আর একদিন আসব।আমি উঠি তাহলে এখন।
সুনীতা পাশের ঘরে ছিল।তার মা ডাকতেই সনাতনের সঙ্গে বাড়ির বাইরে এলো সুনীতা।এখন বেলা তিনটে বাজে।এখন অনেক কাজ বাকি আছে। শ তিনেক টাকা হলেই ফিরে আসা যাবে।
সনাতন নিজের রাস্তা ধরে চলে গেলো আর সুনীতা বাসস্ট্যান্ডের রাস্তা ধরে চলে এলো উত্তরা সিনেমার কাছে।এখন শহরে অটোমেটিক সিগন্যাল হয়েছে।ফলে ওয়ান ওয়ে ধরে চলে যাতায়াত।

তিন

সুনীতা টোটো চালিয়ে একদিন সনাতনদার বাড়িতে এল।সকালে টিউশানি করে তারপর জলখাবার খেয়ে বের হয় সনাতন।সুনীতা দেখল, সনাতন ছাত্র ছাত্রীদের পড়াচ্ছে।সুনীতা ভেতরের ঘরে বসল।ছাত্রছাত্রীরা কৌতূহলী হয়ে উঠলে সনাতন বলল,অতিথি এসেছেন ঘরে। আজ তোদের ছুটি, যা।সুনীতার আনা প্যাকেট খুলে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের একটা করে মিষ্টি দিল সনাতন।ছেলেমেয়েরা মিষ্টি খেল, জল খেল। তারপর চলে গেল বাইরে।এখন সনাতন সুনীতাকে বাবা মায়ের ছবি দেখাল।বোনের বিয়ের ছবি দেখাল।সুনীতার বেশ ভালো লাগছে সনাতনের ঘরের পরিবেশ।ব্যাচেলর ছেলের ঘর যেমন হয় আর কি।সে দেখল,একটা জামা মেঝেতে পড়ে আছে আর প্যান্ট দড়িতে ঝুলছে।বইগুলো অগোছালো অবস্থায় পড়ে আছে।সুনীতা যতটা পারলো ঘর গুছিয়ে দিল।সনাতন এখন বাথরুমে।সে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল সুনীতা বিছানার চাদরটা ঝেরে দিচ্ছে। সনাতন বলল,থাক থাক তোমাকে ওসব করতে হবে না।চলো আমরা এবার কাজে যাই।সনাতন আর সুনীতা যখন বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে সূর্যদেব তখন মধ্য গগনে বিরাজ করছেন।
দেরী হওয়ায় প্রথমে দুইজনে খেয়ে নিল তারপর যে যার পথে রওনা হল।

চার
সুনীতার বয়স প্রায় পঁচিশ হল।তার মায়ের চিন্তা তাকে পাত্রস্থ করতে হবে।সুনীতা বলে,মা আমার অনেক কাজ বাকি আছে।আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।মেয়েদের বিয়ে করা বাদ দিয়ে আরও অনেক কাজ আছে।বিয়ে করলে আমি পরাধীন হয়ে যাব। বাবার স্বপ্ন ছিল, পাকা বাড়ি হবে,গরীব দুঃস্থদের খাওয়ার ব্যবস্থা হবে আর একটা গ্রন্থাগার হবে গ্রামে।আমি বাবার স্বপ্ন সফল করব।
তার মা বলেন,তার জন্য তো অনেক টাকার প্রয়োজন।
সুনীতা বলে,আমি আবার একটা নতুন টোটো কিনব। সনাতন নতুন টোটো নিয়ে ঢুকলো।সে বলল,তুমি তো গুগল পে করে দিয়েছো।আমি গাড়ি নিয়ে এলাম।পাশের ছেলটিকে দেখিয়ে সে বলল,এই দেখো আর একজন চালকও ঠিক করেছি।
সুনীতা বলল,তুমি আমার পরিশ্রম কমিয়ে দিলে সনাতনদা।
সনাতন বলল,আমি তোমার পাশে সবসময় থাকব।
অনেক ভিড় হয়েছে নতুন টোটো দেখে। পাড়ার অনেকে বলল,সুনীতা এবার তুমি নতুন টোটোগাড়িটা চালাও।পুরোনোটা অই ছেলেটাকে চালাতে দাও।
সুনীতা বলল,না আমি পুরোনো গাড়িটাই চালাব। সুনীতা কি করে বোঝাবে পুরোনো টোটো চালাতে গিয়ে রোজ বাবার গায়ের সুগন্ধ পায় সে। আর মনে অনেক জোর পায়। বহুদূরের পথ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।