ক্যাফে গল্পে সুব্রত সরকার

ফার্স্ট বয়

খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল কেয়ার। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে দূরের পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে। সূর্য উঠছে। প্রথম আলোর নরম আভায় সবুজ পাহাড়টাকে বেশ লাগছে। বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়াল কেয়া। সূর্য ওঠার দৃশ্যটা উপভোগ করতে চায়।
শ্যামল কিছুতেই এখন উঠবে না। গভীর ঘুমে লেপ্টে আছে। তাও কাল রাতে রাজি করিয়েছে,
“অন্তত সাড়ে সাতটায় ওঠো। আটটার সময় কিন্ত স্কুলটাতে যাব।”
আদিবাসী অধ্যুষিত এই রাঢ় বঙ্গের টাঁড় জমিনের বুনো বনাঞ্চলে বেড়াতে এসে কাল ওরা স্কুলটা আবিষ্কার করেছে। ‘পলাশ কুঞ্জ’ হোম স্টে থেকে সামান্য দূরে। পায়ে পায়েই চলে যাওয়া যায়। প্রায় খোলা আকাশের নীচে ধূ ধূ দিগন্তের এক প্রান্তে ছোট ছোট দুটো ঘর ও লম্বা একটা বারান্দা নিয়ে এই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুজন শিক্ষক আর জনা পঞ্চাশেক ছাত্র ছাত্রী।
খুব কিচিরমিচির, হৈ চৈ হচ্ছিল। কাল হোম স্টের বারান্দা থেকে স্কুলের বাচ্চাগুলোকে দেখে কেয়া বলেছিল,”কি সুন্দর ওদের জীবন। প্রকৃতির পাঠশালায় যেন ওরা পড়ছে। চারপাশে এমন সুন্দর পাহাড়, জঙ্গল। কি শান্ত নিরিবিলিমাখা সবুজ নির্জনতা। মনে হয় যেন ছুটে চলে যাই ওদের কাছে!”…
“গেলেই তো পারো।” শ্যামল সিগারেটে আগুন ধরিয়ে বলল।
“যাবে?” কেয়া হেসে বলেছিল,” খুব আনন্দ হবে। চলো না কাল সকালে একবার যাই স্কুলটাতে!”
“অত সকালে আমি যেতে পারব না। ঘুমই ভাঙবে না।” শ্যামল ভোরে উঠতে একদমই পারে না। তাই সকালের অজুহাতটা ঠেলে দেয় কেয়ার দিকে।
কেয়া হেসে সমাধান করে দিয়ে বলল,” আমরা একটু পরেই নয় যাব। স্কুল তো নটা – সাড়ে নটা পর্যন্ত হয় দেখছি।”
” ঠিক আছে আমরা আটটার পর বেরব এখান থেকে।” শ্যামল কথা দিয়েছিল অল্প হেসে।
*
হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে চলেছে। টুকরো টুকরো কথায় গল্প হচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে পড়ার শব্দ। কেমন সুর করে করে ওরা পড়ছে। পড়ার শব্দের সাথে মিশে আছে একটা মিষ্টি কলকাকলি। কেয়ার ব্যাগে দু’প্যাকেট লজেন্স। মনে ওর খুব আনন্দ, খুদে খুদে পড়ুয়াদের সাথে দেখা করে, কথা বলে ওদের হাতে লজেন্স দেবে।
শ্যামল হাঁটতে হাঁটতে কথার ফাঁকে হঠাৎ বলল, “এমন একটা স্কুলের টিচার হওয়ার মজাই আলাদা বলো।”
“আমার তো ভীষণ মজা হতো। ঈশ! আমি যদি এমন কোনও স্কুলে দিদিমণির চাকরী পেতাম!”…
“পেলে কি করতে? চলে আসতে?”
” আসতামই তো।”
“তাই! তাহলে আমার কি হতো?”
” কি আবার হতো! তুমি সপ্তাহান্তে চলে আসতে। সেই দু’দিন দুজনে এমন নির্জনে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম।”…
**
স্কুলের কাছাকাছি ওরা চলে আসতেই বাচ্চাগুলো চুপ হয়ে গেল। ওদের সবার কৌতূহল দুই অতিথিকে আসতে দেখে।
কেয়া ফিসফিস করে বলল,” ওরা কেমন অবাক হয়ে দেখছে দেখো!”
” অবাক তো হবেই!” শ্যামল ঠাট্টা করেই বলল, “তোমার মত পাগলকে দেখতে তো মজাই লাগে!”
” অ্যাই!” কেয়া ঠাট্টা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,” আমি পাগল নই, পাগলী। আমার সঙ্গে আছে পাগল!”
শ্যামল স্কুলে ঢুকেই কি সুন্দর সহজ ভাবে “নমস্কার মাস্টারমশাই” বলে হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল।
“নমস্কার।” মাস্টারমশাইও হেসে বললেন,” আসুন, আসুন।”
কেয়া শ্যামলের পিছু পিছু গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াল। মাস্টারমশাই বারান্দায় ওদের বসিয়ে পড়াচ্ছিলেন। চোদ্দ – পনেরোটা রুগ্ন শিশু বই খুলে পড়ছিল। শ্যামলই কথা শুরু করল,”ওরা কেমন পড়াশোনায়? রোজ স্কুলে আসে? ড্রপআউট হয়?
ওরাই কি ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার? মিড ডে মিল দেওয়া হয়?” এমন কত সব প্রশ্ন শ্যামলের। কেয়া বেশ অবাক হয় শ্যামলের এত কৌতূহল দেখে। মাস্টারমশাই ওর সব প্রশ্নেরই উত্তর ধীরে ধীরে দিচ্ছেন। শিশুগুলো তখন পড়া ভুলে ওদের দুজনকে অবাক চোখে দেখছে। নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ফিক ফিক করে হাসছেও। কেয়ার বেশ লাগছে এমন করে ওদের মজা করতে দেখে। মনে মনে ভাবছে, মাস্টারমশাইের কথা শেষ হলেই ওদের সাথে ভাব জমিয়ে দুটো কথা বলবে। গল্প করবে। সবার হাতে লজেন্স দেবে।
মাস্টারমশাইয়ের কথা শেষ হতেই শ্যামল বলল, “হ্যাঁরে, তোরা কোন ক্লাসে পড়িস?”
একজন বলল,” আমরা থিরি।”
” থ্রি!” শ্যামল চোখ নাচিয়ে মজা করে বলল, “পড়তে ভালোলাগে তোদের?”
ওরা এমন প্রশ্নে চুপ হয়ে যায়। উত্তর খুঁজে পায় না। মাস্টার মশাই মুখ টিপে হাসছেন। কেয়াও হাসছে। শ্যামল এবার বলল, ” লজ্জা পাচ্ছিস কেন? বল না সত্যি কথাটা। আমার তো একদম পড়তে ইচ্ছে করত না!.”
এবার শিশুর দল হাসল। তবে জোরে নয়। ফিক ফিক করে। শ্যামল ওদের হাসতে দেখে বলল, “তোরা কি রোজ আসিস স্কুলে?”
উত্তর টা একসাথে এলো না। কেউ কেউ বলল, “হামি রোউজ আসি গো!”
শ্যামল এবার জানতে চাইল,” তোদের ফার্স্ট বয় কে?”
উত্তর নেই। সবাই চুপ। মাস্টারমশাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন। শ্যামল আবার বলল,” তোদের ফার্স্ট বয় কে একটু দেখি।”
এবার একটা লিকপিকে দুবলা মেয়ে লাজুক লাজুক মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” হামি আছি।”
“ওমা তুই! ভেরি গুড। তোর নাম কি রে?”
” তারামণি মাড্ডি।”
” বাহ্। সত্যিই তো তুই তারা!”
কেয়া সবার হাতে লজেন্স তুলে দিল। ওরা খুব খুশি। হাসছে, আনন্দ করছে। শ্যামল এসময় হঠাৎ একটা কান্ড করে বসল,” কেয়া, তুমি একটা গান শোনাও ওদের। এই পরিবেশে দারুণ লাগবে।”
কেয়া তো অবাক! হঠাৎ করে শ্যামল যে এমন একটা প্রস্তাব দিয়ে বসবে ও ভাবতে পারে নি। তাই একটু বিব্রত হয়ে পড়ে। কি গাইবে ভেবে পায় না। মাস্টারমশাই তখন হেসে বললেন, ” হ্যাঁ দিদি, একটা গান শোনান আমাদের। খুব ভালো হবে।”
***
স্কুল থেকে ফিরে আসছে দুজনে। পাহাড়তলীর ছোট্ট গ্রাম এই কুসুমডিহা। চারপাশ শান্ত, নির্জন।
পাখিরা ডাকছে হঠাৎ হঠাৎ। সেই শিসের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে। রাস্তার দুধারে প্রচুর পলাশ গাছ। এটা পলাশের মাস নয়।তাই ঝাকড়া পলাশ গাছগুলো ন্যাড়া- নিস্পত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কেয়া হাঁটার ছন্দে আস্তে আস্তে বলল,” ফার্স্ট বয় কে কেমন লাগল?”
শ্যামল কোনও উত্তর দেয় না। চুপ করে হাঁটতে থাকে।
পাহাড়ের গায়ে এখন ঝলমলে রোদ্দুর। চোখের সামনের এই পাহাড়টাকে সারাদিন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায়। আজ অনেকদিন পর কেয়া সত্যিকারের একটা আনন্দ যেন খুঁজে পেল জীবনে। তাই প্রাণ মন ঢেলে ওদের গানও শুনিয়ে এলো,”প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে, মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ…”
“আমি ফার্স্ট বয় কে খুঁজতে গিয়ে তারামণিকে দেখতে পাব সত্যিই ভাবি নি!”…. শ্যামল আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কথাটা বলল।
কেয়া অদ্ভুত সুন্দর করে একটু হাসল। হাসিটা শ্যামল খেয়াল করল না!… না করুক, কেয়া ভাবছে, “তারামণি, তোকে আমার দুটো লজেন্স দিয়ে আসা উচিৎ ছিল রে!….”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।