ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সমীরণ সরকার (পর্ব – ৩)

সুমনা ও জাদু পালক
পুটু পিসি যাওয়ার আগে বারবার করে সাবধান করে দিয়েছে, ‘ সাবধানে থাকিস রে সুমনা।গাঁয়ে ছ্যাঁচড়া চোরের উপদ্রব খুব বেড়েছে। কক্ষনো দরজা খোলা রাখবি না। অপরিচিত কোন লোককে ঘরে ঢুকতে দিবি না। তোর মা জ্বর গায়ে উঠে দরজা বন্ধ করতে না পারলে বাদল ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় দরজায় তালা দিয়ে যাবি !’
কথাগুলো মনে করে সুমনার খুব হাসি পায়। তাদের ঘরে কি আছে যে চোরে নেবে। কাঁসা-পিতলের যে কয়েকটা বাসন ঘরে ছিল, বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর এক এক করে সেগুলো হয় বিক্রি হয়ে গেছে নয়তো বাঁধা পড়েছে ছাতু মোড়লের ঘরে।
ছাতু মোড়ল সুদে টাকা খাটায়। শুধু তাদের গ্রামে নয়, আশেপাশের আরও দশ বারোটা গ্রামের লোকেরা টাকা ধার নেয় ছাতু মোড়লের কাছ থেকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা জলখাবার খেয়ে একটা লাঠি আর ছাতা হাতে ছাতু মোড়ল বেরিয়ে পড়ে দেনাদার দের ঘরে ঘুরে ঘুরে মাসিক সুদের টাকা আদায় করতে। আসল টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ছাতু মোড়ল কখনো তাগাদা দেয় না। মাসে মাসে সুদের টাকাটা পেলেই সে খুশি। শতকরা পাঁচ টাকা হারে মাসে সুদ নেয় ছাতু মোড়ল ।
ছাতু মোড়লের বড় ছেলের বৌ কাঁসা পিতলের বাসন, ছোটখাটো সোনার গহনা ইত্যাদি বন্ধক রেখে সুদে টাকা ধার দেয়। সুদের হার টা একটু কম । শতকরা মাসিক তিন টাকা।
ধার শোধ করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে। সেই সময়ের মধ্যে ধারের টাকা শোধ করতে না পারলে বন্ধক দেওয়া জিনিস ফেরত পাওয়া যায় না। তাদের কাঁসা পিতলের বাসনগুলো তো ওইভাবেই ছাতু মোড়লের বড় ছেলের বউয়ের কাছে এক এক করে জমা পড়েছে।
এখন তো সুমনাদের ঘরে বাসন বলতে অনেক জায়গায় টোপ খাওয়া একটা পুরনো অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি, কালি-মাখা একটা পুরনো লোহার কড়াই, দু তিনটে লোহার হাতা খুন্তি আর কয়েকটা পুরনো হলদেটে হয়ে যাওয়া স্টিলের থালা -গ্লাস -বাটি। এগুলো নিতে চোর নিশ্চয়ই তাদের বাড়িতে আসবে না।
মায়ের সারা গায়ে এক কুচি সোনা ও নেই। নগদ টাকা ও জমা নেই ঘরে। মজুত চাল ও তো নেই ঘরে যে ছ্যাঁচড়া চোর নেবে।
তা তো হোলো, কিন্তু আজ সুমনা কি খাবে আর মাকেই বা খেতে দেবে কি ?হাঁড়ির তলে যে সামান্য কটা চাল ছিল, মায়ের জ্বর হওয়ার পর সে কটা প্রথম দুদিন কোনমতে ফুটিয়ে খেয়েছে। অনেকবার বলার পরেও একদানা ভাতও দাঁতে কাটেনি মা। অনেক বলার পর সারাদিনে কম মিষ্টি দিয়ে দু’কাপ লাল চা আর কয়েক গেরাস শুকনো মুড়ি খেয়েছে। অসুস্থ শরীরে মা শুধু বারেবারে খোঁজ নিয়েছে যে, সুমনা ভাত রান্না করে খেতে পারল কি না, কি দিয়ে খেল ইত্যাদি।