|| সাহিত্য হৈচৈ – সরস্বতী পুজো স্পেশালে || সঞ্জীব সেন

বেলা বোস, রং নাম্বার আর সেইসব স্বপ্নগুলো

মোবাইল আসিনি তখন, বাড়ি বাড়ি টেলিফোনও ছিল না, পাড়ার মোড়ে টেলিফোন বুধ ছিল , একটাকার কয়েন দিয়ে ফোন করত হত । তখন টিভিতে এত চ্যালেন ছিল না, নাচ গান , সিরিয়াল ছিল না , সপ্তাহে দুদিন সিনেমা হত
চিত্রহার চিত্রমালা হত ।আর শীতকালে ক্রিকেট হত টিভিতে ।শুধু রবিবার সারাদিন নানারকম অনুষ্ঠান হত ।তখন মানুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলত ।রকে আড্ডা হত ।সমবয়সী ছেলেরা আড্ডা ইয়ার্কির সাথে সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যায় কী কী হবে ঠিক করে নিত ।তাই বলে কী প্রেম করত না ! করত লুকিয়ে চুরিয়ে নানান ফন্দিফিকির করে ।চিঠি বিনিময় হত গল্পের বইএর ভিতর । প্রেমিকার চিঠিতে ভুল বানান হলেও বলত না বাংলার মাষ্টার প্রেমিকা যদি রেগে যায় । এই গল্প সেই সময়কার যখন ছেলেমেয়েরা গল্পের বই পড়ত চুটিয়ে । সুনীল গাঙ্গুলী থেকে বুদ্ধদেব গুহ । আর তাদের স্বপ্নগুলো ছিল বেলা বোস থেকে রং নাম্বার ।
আমাদের বাড়ি থেকে মামাবাড়ি যেতে একটা সর্টকার্ট পথ ছিল, সাইকেলে আধঘন্টার পৌছে যাওয়া যেত । মামাবাড়ির এইজায়গাটা আমার বেশ লাগত ।তাই সুযোগ পেলেই চলে আসতাম । মসজিদ লাগোয়া ছোট একটা মাঠ ছিল খেলা হত ।মসজিদে একটা পুকুর ছিল বাগান ছিল ।মসজিদে একজন মলা থাকত । মাধ্যমিকের পরের বছর কয়েকদিন ছিলাম । সেবার সরস্বতী পুজোয় দারুণ আনন্দ হয়েছিল ।সেবারই প্রথম সিগারেট খেয়েছি লুকিয়ে ।ওদের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে গেছিলাম ।পুজোর আগের দিন যেতেই ওরা ম্যাম্বারশীপ বাবদ সত্তর টাকা আদায় করে নিল ।বিকালে একটা ক্যালচারাল পোগ্রাম হয় ।গান গাইল একটা মেয়ে নাম অনুরাধা যার বয়স ষোলবছর । ষোল বছর হল নারীর পূর্নবিকাশের পথের প্রথম ধাপ ।আমি হাঁ করে শুধু ওকেই দেখালাম । প্রথম নারীবোধ জন্মাল ।তখন গল্প উপন্যাস পড়তে শুরু করেছি । সুনীলবাবু গল্পে প্রেমে পড়ার প্রকৃত বয়স সম্পর্কে কী বলেছে জানা হয়নি । তবে মনে হল আমার আসতে বছর খানেক দেরি আছে । তারপর থেকে ফি বছর এইসময় আসতামই। এদের একটা গ্রুপ ছিল বুড়ো দার মুদি দোকানের পাশে বকুল গাছ তলায় আড্ডা হত ।সুন্দর করে বাধানো ছিল ।গ্রুপে একজন বছর পাঁচেকের সিনিয়র দাদা ছিল । নাম বিপুল দা ।সিনিয়ার একজন থাকার সুবিধা আছে । অনেককিছু জানা যায় । বুড়ো দা সদ্য বিয়ে করেছে, বুড়ো দাদা বৌ নিভা বৌদি
অকারণেই দোকানে চলে আসত ।আমারা দেখতাম ।।বিপুল দা একদিন বলে ফেলল বিপুল কিভাবে হ্যান্ডেল করে কে জানে , এজন্যই সকালে দোকান খুলতে দেরি করে ।আমরা হাসতে গিয়েও হাসলাম না ।চুপচাপ বসে রইলাম । আমার সুনীল গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের গল্পের একটা লাইন মনে পড়ে গেল সাতেরো আঠেরো বয়সের ছেলেরা নিজেদের চেয়ে বয়সে বড় মেয়েদের দেখে যুগ্ধ হয় অর্থাৎ যাদের শরীর পূর্ণ বিকশিত । বাঙালী গড়পরতা মেয়েদের তেইশের আগে বিকশিত হয় না ।সেদিক দিয়ে নিভা বৌদি পঁচিশ ।প্রথমে সুডৌল স্তনদুটো দেখলাম ।পড়ে কোমর তারপর পা আবার স্তন দুটো দেখলাম ।ফুলফুল শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ পড়েছিল । সমতল পেটে অর্ধ-চন্দ্রাকৃতি নাভীটা উকি দিচ্ছিল ।সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে এলাম ।আর সেদিন রাতেই স্বপ্নে এল নিভা বৌদি তবে নামটা দ্রিমি , বুদ্ধদেব গুহর একগল্পে পড়েছিলাম চোলি ঘাগড়ার পোশাকে উন্টোনো জামবাটির মত সুগোল স্তন অর্ধেকটা বেড়িয়ে আছে তারপর দ্রিমি একটা চন্দ্রমল্লিকা ফুল বুকের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে বলল বাড় করে আনো দেখি তাহলে বুঝব তুমি খুব সাহসী । আমি দ্রিমির বুকের ভিতর হাতটা চালান করে দিলাম। শঙ্খের মতন স্তনদুটোর খাঁজের ভিতর থেকে বাড় করে আনতে গিয়ে হাতটা চেপে ধরল আর খিলখিল করে হেসে উঠল ।আর বলল কি গরম লাগছে ।তখনই ঘুম ভেঙে গেল । সত্যিই গরম লাগছিল ।এমন একটা স্বপ্ন দেখার জন্য তিরস্কার করব নিজেকে নাকি স্বপ্নটাকে হত্যা করব ভাবছি ।বাথরুমে গিয়ে দ্রিমির ভরাট উত্থিত স্তনদুটো ভেবে নিয়ে স্বপ্নটাকে মুক্তি দিলাম ।মনে হল শিকার করার মত শিকার হওয়াতেও আনন্দ থাকে ।
, দুটো সরস্বতী পুজো চলে গেছে ।জেনেছি বিপুলদা দিপালি নামে একটা মেয়ের সাথে দারুণ প্রেম করছে ।সরস্বতী পুজোর সকালে বুক থাকে ।বনহুগলী দিপালি দির বাড়ির সামনে ঘোড়ঘুড়ি করে ।সরস্বতী পুজোর সকালে প্রেমিকাকে দারুণ লাগে ।একটু দেখার জন্য এইটুকু লেবার তো দিতেই হয় । আমরাও প্রাপ্তমনস্ক হিসাবে বেড়ে উঠেছি তখন । কয়েকদিন পর শীতের সকালে আমি আর মহাভারত মসজিদের পুকুর ধারে গল্প করছি ।মহাভারতের আসল নাম হল ভরত । কিভাবে মহাভারত হল এর পিছনে একটা গল্প আছে ।ওর দাদার নাম হল রাম ।ছোটবেলায় বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ।জানা যায় সার্কাশে আছে ।ভরত পণ করছে দাদাকে যেমন করেই হোক বাড়ি ফেরাবেই ।শুধু তাই না হঠাৎ একদিন বলে ওঠে বলত অশ্বথামার নাম অশ্বথামা হল কেন ! জন্মের সময় ও নাকি অশ্বের মত ডেকে উঠেছিল, টিভিতে মহাভারত চলছে । আর ওর সব কথাই মহাভারত রিলেটেট ।যাই হোক আমি আর ও বসে গল্প করছি ।হঠাৎ বলে জানিস নতুন বৌ এর গায়ে গন্ধ থাকে ।আমি বললাম তুই পাস নাকি, ও বলল কেয়া বৌদি ছাদে কাপড় মেলছে একটা গন্ধ ভেসে আসছে ।কেয়া বৌদির বাড়ি ওদের বাড়ির পাশেই ।মসজিদ পেড়িয়ে ।এখান থেকে দেখা যায় ।তখনই ওকে বললাম অনুরাধার সঙ্গে আমার মোলাকাত করিয়ে দেয় না তোদের নিচের একতলায় তো ভাড়া থাকে ।ও বলল কেন প্রেম করবি! আমি বললাম প্রেম তো অনেক দূরের ব্যাপার ।কথা বলতাম ।জানিস পুজোর দিন একদঙ্গল মেয়ের সামনে আমায় শুনিয়ে কী বলেছে ।বলে জয় দা মনে হচ্ছে একদিন আমাদের এই পাড়ারই জামাই হবে দেখে নিস । মহাভারত হেসে উঠেছে । বললাম ওকে বলিস, কাশিপুর গান সেলে কাজের কথা চলছে
। মহাভারত বলল ঠিক আছে দেখছি , আমি বললাম যদি ফিটিং করে দিতে পারিস তাহলে যা খেতে চাস খাওয়াবো , পরের সপ্তাহে রবিবার আসতে বলল দুপুরে ছাদে ঘুড়ি ওড়াবো তখন ও আসবে ।দারুণ উৎসাহে গেলাম ।ঘুড়ি ওড়াচ্ছি আর সময় গুনছি ।অনুরাধা এল সদ্য স্নান করে ।বিদ্যাসাগর কলেজে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে ভর্তী হয়েছে ।অনুরাধা এসেছিল হলুদ চুড়িদারে ওড়নাহীন ।উপন্যাসে পড়া মানসীর মত লাগছিল।চুড়িদারের ভিতর থেকে ফুটে ওঠা স্তনদয়ের আভাস আর দু ফোটা জল স্তনবৃন্তে ধারণ করা ।এই অবস্থায় নারীত্বের এই শিল্পকে নষ্ট করতে নেই । মহাভারত ঘুড়ি নিয়ে ওদিকটায় চলে গেল ।আমি ভাবছি কি বলে শুরু করব ।অনুরাধা পাশেই দাঁড়িয়ে ।ওই বলল চাকড়িটা হয়ে গেলে খাওয়াতে হবে কিন্তু ।আমি বললাম কি খেতে চাও ।ও বলল ফুচকা , ব্যাস আর, ! ও বলল আমি অল্পেতেই খুশি, তারপর আবার চুপচাপ, হাতখানেক দুরত্বে দাঁড়িয়ে দুজনাই দুদিক মুখ করে ।ইতঃস্থত করছি। তোমাকে কিছু বলার ছিল এখানেই এসে আটকে আছি । কিছুসময় পর ও বলল আমার একজন আছে তবে তুমি ছেলে হিসাবে খারাপ ছিলে না ।আবার চুপচাপ ।আমার মনের ভিতর ভাঙচুর চলছে । ও বলল সুতপাকে চেনো! ও তোমার প্রতি একটু কার্নিক ।সেইজন্য সেদিন ওকে শুনিয়েই বলেছিলাম কথাটা জয় দা এপাড়ার জামাই হবে একদিন ।ও আমার কানমুলে দিয়েছিল ।অনুরাধার সাবলীল কথাগুলো থেকে ওর প্রতি আমার অন্যরকম ভালবাসার জন্ম নিয়েছে ।ও তখন বলে চলেছে সুতপার কথা ।আমি মনে মনে ভাবছি সুতপা দেখতে শুনতে খারাপ নয় ।গায়ের রঙটা একটু চাপা ।হায়ার সেকেন্ডারী অবধি পড়েছে । এবার বিয়ে দিয়ে দেবে ঠিক করেছে ।মনে মনে ভাবলাম সবাই আমারা নিয়তীতাড়িত । ওই বলল তুমি চাইলে ঘটকালি করতে পাড়ি ।সুতপার সঙ্গে দেখা করার দিন জানতে পারলাম দিপালীদির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ।বিপুলদা দারুণ আপসেট ।লোকাল বুধ থেকে ফোন করেছিল দিপালী দি বলেছে রং নাম্বার ।বিপুল দা একটা চাকরি পেয়েছে মাইনাটা কম ।ছয়মাস পর বাড়াতো । সেসময় একটা গান খুব চলত “ চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো ”। কিছুদিন যাবৎ হিউএন সাং ওদের উজ্জয়িনী নগরী তে ঘুরছিল ।হিউএন সাং মানে হল ঘটক ।ছেলের বয়স অনেক বেশী তবুও তো সরকারী চাকরি! এভাবেই সবাই নিয়তীর অদৃশ্য সুতোর টানে বেবাক পুতুল বনে যায় ।
সময় বয়ে যায় নদীর মত, জলের ধারার মত । পনের বছর কেটে গেছে ।এর মধ্যে এদিকে আসাই হয়নি আর । তার কারণ মামারা বাড়ি করে অন্যত্র চলেগেছে ।আর সুতপারা ভিতর দিকে ‌জমি কিনে বাড়ি করেছে ।অনেক দিন ধরেই ভাবছি আসব ।সরস্বতীপুজোর সময় মসজিদ পাড়ার এই মাঠে ।যেখানে জীবনের বিশেষ সময় কেটেছে ।মসজিদ পাড়ায় এসে চোখে পরল আমূল বদলে গেছে জায়গাটা। ফ্লাট , বাড়ি, আবাসন, শপিং মল ।কোন জায়গা ফাঁকা নেই, পুজোটা এখন আর হয় না ।মসজিদ লাগোয়া মাঠটাও নেই সেখানে আবাসন ।মসজিদে ঢোকার রাস্তাটা ওদিক থেকে করেছে ।মসজিদের ভিতর যাওয়ার ইচ্ছা হল ।সেই পথেই দেখা হল মহাভারতের সাথে ।ছেলেকে সাইকেলে নিয়ে বেড়িয়েছে ।ওর কাছেই সব শুনলাম ।ও ছেলেকে ঘুড়ি কিনে বাড়ি পাঠিয়ে দিল ।মহাভারত বলল জানিস বুড়ো দা দোকান বেচে দিয়েছে, নিভা বৌদি বিউটি পার্লার দিয়েছে এই আবাসনের নিচে চল আগে সেখানে চল , বুড়ো দার শরীর খুব খারাপ ,আমি বললাম নিভা বৌদি আগের মতন আছে ।মহাভারত বলে কী করে থাকে, তুই আমি আগের মত আছি!সময় সব কিছু খেয়ে নেয় ।তবে নিভা বৌদিকে দেখতে আগের চেয়ে ভাল হয়েছে রে, বিউটিশিয়ান কোর্স করে এই দোকানটা দিয়েছে ।ভালোই চলে ।কথা বলতে বলতে পৌছে গেলাম আবাসনের নিচে , নিভা বৌদি কাস্টমার ডিল করছে ।ইয়ং মেয়েরা, বাঙালীর ভেল্যান্টাইন ডে, বাইকে করে ঘুরবে প্রেমিক নয় তারচেয়ে বয়ফ্রেন্ড বলা ভাল ।নিভা বৌদি দেখেই বলল কিরে জয় এতদিন পর ।মনে পরল এদিকের কথা, আমি মাথা চুলকে বললাম , আসলে মামারা ওইদিকে চলে যাওয়ার পর আর সুতপারাও বিরাটি চলে যাওয়ার পর এদিকে আসা হয় না, দেখলাম সত্যিই নিভা বৌদি আগের চেয়ে দেখতে সুন্দর হয়েছে ।কালো রঙের ডিপকাটের ব্লাউজের সাথে হলুদ মানানসই শাড়ি পরেছে ।কপালে সিঁদুরের নিচে হলুদের লম্বা একটা দাগ দিয়েছে ।রোদচশমাটা মাথার উপর । অপর্ণা সেনের মত লাগছে । নিভা বৌদি বলল বিপুলদা চাকরি ছেড়ে ক্যাটারিং এর ব্যবসা করে ।বিয়ে করেনি আর । বলল অনুরাধা এখন এই আবাসনেই থাকে । ভাগ্য ভাল থাকলে দেখা হতেও পারে । ভাগ্য সুপশন্ন ছিল দেখলাম ও বরের সাথে ফিরল বাইকে করে বাচ্চা ছেলেটা সম্ভবত ওদের অনুরাধার মুখের আদল । নিভাবৌদি বলল প্রোমোটার ।ভাল পয়সা করে নিয়েছে ।মহাভারতকে বললাম চল ওদিকটা যাই । বললাম আবাসন হল ক্লাবঘর দেয়নি ।পুজো হয় না ।ও বলল ক্লাব এখন ইয়ংদের ।পুজো করে । সন্ধ্যায় ডিজে বাজে ।আমাদের কেউ যায় না । আমাদের সব প্রতিবাদ এখন বকুলগাছটার নিচে জমা হয় । আবাসনের ছাদে পুজো হচ্ছে । অনেকদিন পর গানটা শুনলাম অঞ্জন দত্তের সেই গানটা ” চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো“
। যেন বিপুল দার জন্য লেখা হয়েছিল গানটার সঙ্গে মেয়েদের সমবেত কোরাশ গলা ভেসে আসছে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।