|| সাহিত্য হৈচৈ – সরস্বতী পুজো স্পেশালে || শর্মিষ্ঠা সেন

ধনুর কান্ডকারখানা

আমার ভাই ধনুকে মনে আছে? সেই দুষ্টু ছেলেটা যে খুব শক্ত শক্ত বাংলা শব্দ বলে বাড়ির সব্বাইকে জব্দ করে দিয়েছিল?
ধনু মাথায় একটু বেড়েছে, মাথাও বেড়েছে! এখন সারাদিন তার বকবক শুনতে শুনতে আর অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমাদের সবার নাজেহাল অবস্হা। সে যেন বাড়ির বুড়ো জ্যাঠামশাই একজন! সব বিষয়ে তাকে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং মতামত দিতে হবে। দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে মা জোড়হাত করে সকাল সন্ধ্যা বলেন, “হে মা সরস্বতী, আমার ধনুটাকে একটু সুবুদ্ধি দাও।” ও বড়বড় ড্যাবড্যাবে চোখদুটো দিয়ে সবকিছু দেখে আর অনর্গল কথা বলে যায়।
মায়ের কথা শুনে সেও বলেছে এবার সরস্বতী ঠাকুরের কাছ থেকে সে অনেক বুদ্ধি চাইবে, যাতে বড় হয়ে বাবার চেয়েও অনেক বড় চাকরি করতে পারে, কিংবা ভানুদাদার মতো মস্ত বড় ডাক্তার হতে পারে। এবেলা ওবেলা ধনুর মনোবাসনা পাল্টে যায় যদিও। এর মধ্যেই একদিন বলেছে ও বরং ঝন্টু মাছওয়ালার মতো মাছের দোকান দেবে, অবশ্য সে দোকানে শুধু ইলিশ বিক্রি হবে, আর বিক্রি না হলেও ক্ষতি নেই, সব বাড়ির লোকের জন্যে থেকে যাবে তাহলে, বাবা নিশ্চয়ই টাকা দিয়েই মাছগুলো নেবে। এসব আগডুম, বাগডুম আরো কত কথা! সব কথা লিখে রাখলে একটা গোটা গুটি রচনা বই হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যেই ঠাম্মার কাছ থেকে যাবতীয় গল্প গাঁথা তার শোনা হয়ে গেছে। সরস্বতী বিদ্যার দেবী। তিনি দ্বিভূজা, শ্বেতবর্ণা, তাঁর হাতে থাকে বীণা এবং পুস্তক অর্থাৎ বই। তাঁর বাহন রাজহাঁস। এই সরস্বতী আমাদের বাঙালিদের নিজস্ব। অ-বাঙালিদের সরস্বতী চতুর্ভূজা, ময়ূরাসনা বা কমলাসনা। ঠাম্মার কাছে শুনে ধনু বাড়িসুদ্ধ সবাই কে বলেছে সরস্বতী পুজোর দিন ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে হলুদ মেখে স্নান করতে হবে, বাসন্তী শাড়ী বা পাজামা পাঞ্জাবী পড়তে হবে, অঞ্জলি দেওয়ার আগে পর্যন্ত কিচ্ছুটি মুখে দেওয়া চলবে না এবং কুল খাওয়া তো একেবারেই না।
যেন আমরা আগে কেউ পুজো করিনি। আসলে এবার মায়ের স্কুলের পুজোয় ছাত্র ছাত্রীদের আসতে বারণ করা হয়েছে, তাই আমরাও‌‌ যাব না, বদলে‌ এবার বাড়িতেই ছোট প্রতিমা এনে পুজো করা হবে। তাই ধনুর আনন্দের সীমা পরিসীমা নেই।‌ ওর দুষ্টুমি যেন‌ আরো বেড়েছে!
গত সপ্তাহে মা বসে বসে সবজি কাটছিলেন। ধনু এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মা, তুমি কী করছো?”
“উচ্ছে কাটছি বাবা।”
“মা, উচ্ছে খেলে কী হয়? পেটের পোকা মরে যায়?”
মা হেসে বললেন, “হ্যাঁ, পোকা মরে যায়, আর যে সব বাচ্চাদের রাতে দাঁত কটকট করে তাদের বেশী করে খেতে হয়।”
ধনু একটুও না দমে উওর দিল, “ঠিক বলেছ তো মা! ছোট কাকাকে বেশী করেই দিতে হবে। ঠাম্মা বলছিল ছোট কাকার মাথায় পোকা নড়েছে তাই ছোটকাকা কলেজে যাওয়ার সময় রোজ রোজ গন্ধ মেখে যাচ্ছে, লেখাপড়া করছে না।”
ছোট কাকা সে সময় টেবিলে বসে মোবাইল ঘাঁটছিল, ধনুর কথা শুনে রেগেমেগে বলল, “এ বাড়িতে আমার কোনো সম্মান নেই! আমি ছোট বলে যা খুশী তাই?”
দেখেশুনে আমি আর মা হেসে গড়াগড়ি! মা বললেন, “হ্যাঁ তুই আমার মামন, ধনুর চেয়েও ছোট। তোকে বেশী করেই উচ্ছে দিতে হবে।”
এ তো গেল বাড়ির লোকের কথা। লকডাউন উঠে যাবার পরও বাজার খুব একটা যাওয়া হচ্ছেনা। ঠাম্মার সময়কার সবজিওয়ালা বাবুলাল সপ্তাহে এক-দুদিন এসে সব দিয়ে যায়। ধনুও আজকাল বাবার সাথে সাথে গম্ভীর মুখে বাজার করে।
সেদিন বলে, “বাবুলাল, তুমি এসব পোকা ধরা বেগুন বেছে বেছে আমাদের দিয়ে যাও কেন? আর পালংগুলো তো টাটকা ছিল না, ওসব খেলে আমার শরীরটা আর টিকবে না! ভালো চাও তো আজ ঐ টমেটো গুলো দিয়ে যাও, খেয়ে পয়সা দেব।”
বাবা তো অপ্রস্তুতের একশেষ। ধনুকে বললেন, ”শিগগির কাকুকে সরি বলো! এসব কথা বাচ্চারা বলেনা।”
ধনু চটজলদি জবাব দেয়, “এসব তো মেজ কাকা থাকলেই বলতো। সেদিন কাকা পালং শাকের রস খেতে পারেনি, গন্ধ ছিল পচা পচা, তাইতো আমি কাকার হয়ে বলে দিলাম। আমি তো এমনিতে বাবুলাল কাকাকে খুব পছন্দ করি।”
বাবা গম্ভীর মুখ আরো গম্ভীর করে ঘরে আসেন।
মোবাইল ফোনের নাগাল পেলে তো কথাই নেই। ধনু ফোন ধরে দিব্যি কথা বলতে পারে। সেটা নিয়ে কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, আমাদের বাড়িতে বাচ্চাদের ওপর তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই; তবে ধনু মাঝেমধ্যে এমন কথা বলে ফেলছে যে মান সম্মান রাখা দায় হয়ে পড়ছে! আজই যেমন সকালবেলা শুনতে পেলাম ধনু খুব মিষ্টি মিষ্টি করে কার সাথে যেন কথা বলছে। কান পেতে শুনে বুঝলাম মেজকাকার হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে, আমি কাকাকে আওয়াজ দিতে যাব হঠাৎ শুনি ধনু বলছে, ” না, না, আজ তো কাকা খেতে যেতে পারবে না, সকাল সকাল উঠে দুবার গোবর দেওয়া হয়ে গেছে। মা আজ কাকাকে শুধু সেদ্ধ-ভাত দেবে।” সেটা হজম করতে করতে আবার শুনি বলছে “তোমরা বুঝি বেশী খেয়ে ফেললে গোবর করে ফেলোনা?”
মা তাড়াহুড়ো করে এসে চোখ পাকিয়ে ফোন নিয়ে কোনরকমে ব্যাপারটা ম্যানেজ করলেন শেষে! ধনু এসব কথা শিখেছে মোতি পিসির কাছ থেকে। পিসি খুব পেটরোগা। দুদিন পর পরই কামাই করে আর এসে বলে, “বৌদিগো, শরীলটা খারাপ কচ্ছিল, গুয়ে গোবরে একাকার কচ্ছিলাম, তাই কাজে আসিনিকো!” ধনু ঠিক শুনে জায়গামতো বসিয়ে মেজ কাকার প্রেস্টিজের ফালুদা বানিয়ে দিয়েছে!
বাড়িতে সবার দৃঢ় ধারণা ধনু মজা দেখবে বলেই এমন কান্ড কারখানা করে। কে জানে!
সেদিন পাশের বাড়ির সাণ্যালদাদু অনেক দিন পর এসেছিলেন বাড়িতে। ঠাম্মা, দাদু জমিয়ে গল্প করছিলেন বসে বসে। মোতি পিসি এসে সবাইকে চা পকোড়া দিয়ে গেছে। ধনু কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখে কি মনে হতে ঘরে চলে গেল। আমার তখনই মনে হয়েছিল ব্যাটা নির্ঘাত বদমতলব আঁটছে। ঠিক তাই। ঘর থেকে সোজা সাণ্যালদাদুর কাছে গিয়ে বলে, “দাদু, তুমি একটু তাড়াতাড়ি চা টা খেয়ে নাও, কাপটায় দাদু দাঁত ভেজাবে। বেশীক্ষণ বাঁধানো দাঁত বাইরে রাখতে নেই, জলে ডুবিয়ে রাখতে হয় তো।”
সাণ্যালদাদু হো হো করে হাসলেন বটে, কিন্তু আমি খেয়াল করলাম, উনি আর চায়ের কাপে মুখ দিলেন‌না।
এই হয়েছে অবস্হা! এ ছেলে স্কুলে গিয়ে যে কী করবে সে কথা ভেবে মায়ের হৃৎকম্প হয়। সেদিন বাবা মা আলোচনা করছিলেন, আমি শুনেছিলাম। এখন অনলাইন ক্লাসে সে চুপটি করে ল্যাপটপের সামনে বসে থাকে। ম্যাম ডাকলে খুব ভদ্র ছেলের মতো পড়া বলে। ধনুর সাথে চুক্তি হয়েছে সে ভালো হয়ে থাকলে তাকেও দিদির মতো লোভনীয় জিনিসপত্র কিনে দেওয়া হবে। লোভনীয় জিনিস বলতে আমার জিওমেট্রি বক্স, অ্যাক্রিলিক কালার, ক্যানভাস, এসব। আর পুজোর লোভটা তো আছেই।
দেখতে দেখতে পুজোর দিন চলে আসে।
খুব সুন্দর ছোট্টখাট্ট ঠাকুর এনেছেন বাবা। হলুদ শাড়ী আর মাটির গয়না। চাঁপার‌ কলির মতো আঙুল, টিকালো‌ নাক, টানা টানা চোখ, ঠাকুর যেমন হয় আর কি! কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমি আর ছোট কাকা পুজোর জায়গা সাজিয়েছি, আলপনা দিয়েছি।
আজ সবার স্নান সারা। ধনু সাদা পাঞ্জাবি আর ছোট ধুতি পরে খুব সাবধানে হাঁটছে। ঠিক যেন মা সরস্বতীর বাহন! ঠাম্মা বসে বসে ফল কাটছেন। মোতি পিসি কাল থেকেই এখানে, পুজোর যোগাড় করছে আর মা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন।
যাইহোক পুজো শুরু করলেন মেজ কাকা। আমরা সবাই অঞ্জলি দিলাম। এবার উঠে যাবার আগে কাকা বললেন, “শোনো, যে যে এতদিন যা যা অন্যায় করেছ এইবেলা মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও। মা রেগে গেলে কোনো‌ উইশ ফুলফিল হবে না।”
আমরা সবাই এ ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছি। হঠাৎ শুনি ধনু কিছু বলছে…বলছে, “মা গো, মা সরোসতী, আমি তোমার দুষ্টু ছেলে ধনুর্ধর, আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি…মা, আমি খুব সরি, আমি কাল রাতে চুপিচুপি একটা কুল খেয়ে ফেলেছি …আমাকে মাফ করে দাও মা!”
মেজো কাকা প্রাণপণে হাসি চেপে বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, মা ঠিক তোকে মাফ করে দেবেন। এবার ঝটপট একটা উইশ‌ করে ফ্যাল।”
ধনু হাসি ঝলমলে মুখে হাতজোড় করে বললো, “মা, আমি যেন বুদ্ধিমান, বলবান, রূপবান, শক্তিমান….” কথা শেষ করতে পারেনা বেচারা, ছোট কাকা বলে, দেখিস আবার ‘হনুমান’ বলে ফেলিস না, তাহলে আর রক্ষে থাকবে না! আমরা সবাই বাড়ি কাঁপিয়ে হেসে উঠি। ধনুও বেশী কিছু না বুঝে সবার সাথে যোগ দেয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।