ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ১১)

রূপকথা পৃথিবীর

তুমি কি ভুলেছো বাঁশবাগানের ভূত
তুমি কি ভুলেছো প্রভাতফেরির গান ?
তুমি কি ভুলেছো আড়ি ভাব , ভাব আড়ি ?
মায়ের জন‍্য অকারণে পিছুটান ?
####
আজকে আমি কোত্থাও বেরোবো না।সারাদিন পাঁচ মামার সঙ্গে হুটোপুটি করবো। আর ,ওরাও আমাকে পেলে…. আচ্ছা, আমার পেছনে সবাই কেন এত লাগে বলতো দিদি ? আমি কি খুব হাস্যকর ? আমার গাল টিপে সবাই এত আহ্লাদ পায় কী করে ?
মামার বাড়িতে গেলেই ,সাত সকালে ছোটমামা ইচ্ছে করে আনন্দবাজারের সব খবর চ়েঁচিয়ে় চেঁচিয়ে আমাকে শুনিয়ে পড়তে
শুরু করে ।আমি বলে , মোহনবাগানের খেলার রেজাল্ট কি হলো , সেটা জানার জন্য হাঁ করে বসে থাকি ! আচ্ছা , কী খিটকেল কান্ড বলতো দিদি? নেহাত ছোটমামা আমাকে ট‍্যাঁকে করে ভবানীপুর পাড়ার পূর্ণতে হাটারি বা বনফ্রি দেখতে নিয়ে যায়, আর মোহনবাগান মাঠেও আমাকে নিয়েই ছোটে । তাই ক্ষমা করে দিই ।
অথচ ছোটমামারও তো রোজগার বলতে কিছু নেই । বেকার গ্যাজুয়েট। গোটা কয়েক টিউশানি আর বাজার থেকে ঝেড়ে যেটুকু পয়সা আসে , ছোটো ভাগ্নেভাগ্নির জন্যে সেটাও খরচ করে দেয়।
এবারও আমাদের তিন ভাই-বোনের জন্য ক‍্যাডবেরি এনেছে । দেখতে দেখতে বেলা গড়াতে শুরু করে ।পাঁচ মামা আমি দাদা সবাই মিলে আমাদের পাশের টুকরো মাঠে ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টন খেলছি আর মাঝেমধ্যে থালা ভর্তি চায়ের কাপ চলে আসছে মা — দিদির হাতে হাতে । ওদিকে , সারাপাড়া খুসবু উঠেছে বাবার পোলাও রান্নার । বাবা শুধু পাঁচ মামাকেই খাওয়াবে না , কৌটো ভর্তি করে দিয়ে দেবে শ্বশুর-শাশুড়ি , ছোটোশালীর জন্য। এই জন্যেই বাবাকে ওরা এত ভালবাসে । কিন্তু দিদি ,তুই লক্ষ্য করেছিস , বাবা একটা ব্যাপারে ডাহা ফেল । এত ভালো পানতোয়া তৈরি করতে পারে , কিন্তু রসগোল্লা তৈরি করতে গেলেই কেলো ! কিছুতেই নরম নরম হতে চায় না! সেই রসগোল্লা শ্বশুরবাড়িতে পাঠালেই , এক সপ্তাহের মধ্যে পোস্টকার্ডে দাদুর চিঠি আসে — প্রিয় শচীন , তুমি যে রসগোল্লা পাঠিয়েছো , আমার বয়স্ক দা়ঁতে তা একবারে ভাঙতে পারলাম না । বরং কেউ তা ছুঁড়ে যদি আমাকে মারতো , তাহলে এই বুড়ো বয়সে আমার আহত হয়ে হাসপাতাল যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। যাই হোক , আশীর্বাদ করি , তুমি পরের বার বাগবাজারের ভোলা ময়রাকে স্মরণ করে রসগোল্লাশিল্পে প্রবেশ করবে ।
ইতি—-
আর আমার দিদিটা এমন বিচ্ছু যে , সেই পোস্টকার্ড যত্ন করে জমিয়ে রাখে বাবার পিছনে লাগার জন্যে ।
ভাইফোঁটার মহাভোজ শেষ হতে হতেই বিকেল। মা বলে — হেমন্তের বিকেল তো , তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় । সন্ধে নামতেই আমাদের বাড়ির সামনে এক এক করে , জ্বলে ওঠে তুবড়ি , একসময় নিভেও যায় । আমাদের পাঁচ মামা আরেক রাউন্ড চা শিঙাড়া খেয়ে রওনা দেবার তোড়জোড় শুরু করে দেয় । বাবা বলে–পৌনে ন’টা পর্যন্ত থার্টি ফোর বাস আছে তো, তোরা এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেন বলতো ? রসিক মেজো মামা সঙ্গে সঙ্গে ফুট কাটে–বড়দি, এখন তো কুকুরের ডাকই শুধু শুনছি , শেয়ালগুলো ডাকতে শুরু করবে কখন ? বলতে বলতেই ঝিলের পাড়ে শেয়ালের ডাক শোনা গেল । বড়োমামা দিদির কোঁকড়ানো একমাথা চুল ঘেঁটে দিয়ে বললো– এই রে, তোদের গ্রামে রাতের সাইরেন বেজে গেছে… বড়দি, এবার পালাই!
পাঁচ মামা রওনা দিলো বাসস্ট্যান্ডের দিকে। ব্যস ! আমাদের ভাইফোঁটাও শেষ। মামাদের বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌছে দিয়ে এসে , হঠাৎ দেখি পূর্ব দিগন্তে একটা বিষণ্ন উড়ন তুবড়ি যেন — আর পারছিনা রে , আর পারছিনা রে…. বলতে বলতে আকাশে খুব ক্লান্ত হয়ে উড়ে গেল।
বাড়ি ফিরতেই হঠাৎ মনে হল, কালকেই স্কুল খুলবে । তার মানে পরীক্ষা , তার মানে অংক পরীক্ষা, তারমানে আবার আমার ধ‍্যাড়ানোর সম্ভাবনা। মা, মন ভালো করার জন্য বললো — শিখা , তুই এবারের পুজো সংখ্যা ‘প্রসাদ’ এ প্রফুল্ল রায়ের উপন্যাস ‘এখানে পিঞ্জর’ পড়েছিস ? পড়ে দেখিস, ওটা সিনেমা হবেই আর অবশ্যই উত্তম কুমার , অপর্ণা সেন অভিনয় করবে। দিদি ব্যাজার মুখে বলল — পড়েছি ,আমারও খুব ভালো লেগেছে । দাঁড়াও , ডিস্টার্ব কোরোনা। আমি এখন আমার পরীক্ষার পড়া তৈরী করছি । আমার কেমন সন্দেহ হলো । দিদি যেমন আমার বই খাতার দিকে আড়চোখে তাকায় , আমিও তেমনি তাকালাম । ওমা একী ঈ ঈ ঈ ? এর নাম পরীক্ষার পড়া ? মলাট পাল্টে আমার দিদি নিমাই ভট্টাচার্যের প্রেমের উপন্যাস ‘মেমসাহেব’ পড়ছে ! ওমা , দেখে যাও… সঙ্গে সঙ্গে, দিদি ওর ডান হাত দিয়ে আমার মুখ চাপা দিয়ে দিয়েছে। মা বললো কী হয়েছে রে ? আমি সঙ্গে সঙ্গেই সুর পাল্টে, গলায় খানিকটা ন্যাকামি মিশিয়ে বললাম–ও মা, এক গ্লাস জল খাওযাবে ?
বাবার বাদশাহী পোলাওয়ের যা ঢেকুর উঠছে না… কী বলবো তোমাকে ?
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।