ছোটদের জন্যে বড়দের লেখা ছোটগল্পে সুব্রত সরকার

ছোটদের গল্প

নতুন গোয়েন্দা

খেয়ালী আঁকছে। ও এখন জলরঙে ছবি আঁকা শিখেছে। আজ একটা পাহাড়-জঙ্গলের নিসর্গ চিত্র আকঁছে।
স্কুল বন্ধ সেই লক ডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে। অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। আজ সেই ক্লাস ছুটি। দুপুরে বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে। ঠাম্মা শুধু জেগে বসে গল্পের বই পড়ছে। ঠাম্মা গল্পের বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসে। দাদুও খুব বই পড়ে। দাদুর গল্পের বই হল সব গোয়েন্দা গল্পের বই। রাত জেগে জেগেও দাদু এই সব বই পড়ে। দেশী বিদেশী কত গোয়েন্দা গল্প-উপন্যাস যে দাদু পড়ে ফেলেছে , তা গুনে বলা অসম্ভব। খেয়ালীও গল্পের বই পড়তে ভালোবাসে। তবে সে সব বই হল পাহাড়-জঙ্গলে ট্রেকিং আর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প।
খেয়ালীদের এই পাড়াটা খুব শান্ত, চুপচাপ । সবার নিজেদের বাড়ি। সবাই অনেকদিনের পুরোনো লোকজন। এই পাড়াতে এখনও কোনও ফ্ল্যাট বাড়ি হয় নি। পুরোনো পাড়া। রাস্তাঘাট ছোট ছোট। অলিগলি আছে। খেলার মাঠ আছে। পুকুর আছে। পানাকচুরিতে ভরা একটা ডোবাও আছে। আর আছে একটা মন্দির।
খেয়ালীদের পাশের বাড়িতে থাকে ফুলঠাম্মা ও ফুলদাদু। নয়ন কাকু থাকে বিদেশে। বাড়িতে থাকে শুধু ঠাম্মা আর দাদু। দুজনেরই অনেক বয়স হয়েছে। খেয়ালীর মা-বাবা তাই খুব খেয়াল রাখে ঠাম্মা-দাদুর। খেয়ালীও খোঁজ খবর নেয় সব সময়। গল্প করতে খুব ভালোবাসে ফুলঠাম্মা। খেয়ালীকে দেখলেই গল্প করবে। খেয়ালীরও তখন খুব ভালো লাগে।
ফুলঠাম্মার বাড়ির কুকুরটা হঠাৎ চিৎকার করছে। ওঁদের ছোট্ট একটা স্প্যানিয়াল আছে। ওর নাম টয়। ফুলদাদু খুব যত্ন করে ওকে। টয় এত চিৎকার করছে কেন কে জানে!
খেয়ালী পাহাড়চূড়ায় রং করছে। ছবিটা খুব সুন্দর হচ্ছে। আঁকতে আঁকতে খেয়ালী বিভোর হয়ে গেছে। হঠাৎ কানে ভেসে এল একটা চিৎকার, “চোর চোর!…
ফুলঠাম্মা চিৎকার করছে এমন। ফুলদাদুও চিৎকার করে বলছে, “চোর চোর, পালালো পালালো…
খেয়ালী আঁকার খাতা, রং, তুলি সব ফেলে ছুটে গেল বারান্দায়। এসে দেখল ফুলঠাম্মা খুব কাঁদছে।
গলার কাছ দিয়ে রক্ত ঝরছে। ফুলদাদুও কেমন দিশাহারা হয়ে কাঁপছে। খেয়ালী ওঁদের এভাবে দেখে বলল, “কি হয়েছে গো ঠাম্মা?”
ফুলঠাম্মা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দেখ না আমি জানলার ধারে শুয়ে ছিলাম, হঠাৎ চোর জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার গলার সোনার চেনটা টেনে ছিঁড়ে নিয়ে পালালো। আমার বিয়ের কত দিনের পুরোনো ভারী সোনার চেনটা চলে গেল!”
ফুলদাদু বলল, “তোর দাদু দিদাকে শিগগিরি বল তো, চোরটা এক্ষুনি পাঁচিল টপকে পালালো।”
খেয়ালী চটজলদি দাদু-ঠাম্মা-মাকে এই চুরির কথাটা বলেই বারান্দা থেকে বাড়ির বাইরে এসে ফুল ঠাম্মার বাড়ি দৌড়ে চলে গেল।
ফুলঠাম্মা তখনও কাঁদছে। গলার কাছটা অনেকটা চিরে রক্ত ঝরছে। দাদু ওষুধ মলম দিয়ে ব্যান্ডেজ করছে কাঁপা কাঁপা হাতে।
খেয়ালী নিজের দাদু-দিদাকে ওঁদের পাশে থাকতে বলে মাকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। চোরটা কোথায় পালালো ভাবছে। মাকে বলল, “তুমি পাড়ার সবাইকে এক্ষুনি খবর দাও। সবাইকে বেরিয়ে আসতে বল। আমি দেখছি, চোরটা পালিয়ে গেল কোথায়? বেশিদূর পালাতে পারে নি মনে হয়।”
খেয়ালী খুব সতর্ক হয়ে বুদ্ধি করে চারপাশটা নজর করতে করতে এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল। ওর চোখদুটো স্থির হয়ে গেছে। ফুলঠাম্মার বাড়ির ঠিক দুটো বাড়ির পরেই যে পানাকচুরিতে ভরা ডোবা রয়েছে, সেখানে দুটো ময়লা হাওয়াই চটি পরে। এবং চটিদুটো ডোবার দিকেই গড়িয়ে রয়েছে। খেয়ালী ডোবাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ডোবাটার এক জায়গায় পানাকচুরিগুলো কেমন যেন বেশী নড়াচড়া করছে। আর কালো নোংরা জল বুঁদ বুঁদ করে ফেনা তুলছে ওখান থেকে। খেয়ালী এবার আরও বেশী সতর্ক হয়ে একটু একটু করে পানাকচুরি ভরা ডোবাটার কাছে গিয়ে দেখে বুঝতে পারল, নির্ঘাত কেউ ওখানে ডুব দিয়ে লুকিয়ে রয়েছে!
মা ও আশপাশের অনেক কাকু-কাকিমারা সব ছুটে ছুটে আসছে ফুলঠাম্মার বাড়ির দিকে। খেয়ালীকে ওভাবে ডোবাটার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কর্নেল জেঠু বলল, “কি দেখছিস রে ওখানে?”
কর্নেল জেঠু আর্মিতে ছিলেন। খুব সাহসী। খেয়ালী পুরো ব্যাপারটা বলতেই জেঠু বুঝে গেলেন সন্দেহটা একদম ঠিক।
ডোবার নোংরা জলে কচুরিপানার আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা লোক, এবং সেই লোকটাই যে চোর, তাতে আর কোনও সন্দেহই নেই! ততক্ষণে আরও অনেক লোকজন সব চলে এসেছে। সবাই মিলে ঘিরে দাঁড়াল ডোবাটার চারপাশে। চোর বাবাজী তখন ভয়ে মুখ ডুবিয়ে ওই নোংরা জলে ঘাপটি মেরে দম বন্ধ করে থাকল।
চোর এখন ডোবায় বন্দী। চারপাশে অনেক লোক। সবাই অপেক্ষা করছে কখন পুলিশ আসবে? পুলিশ এলেই চোরকে উঠে আসতে হবে। পালিয়ে আর বাঁচতে পারবে না চোরবাবাজী!
কর্নেল জেঠু খেয়ালীর এই বুদ্ধি ও সাহস দেখে দারুণ অবাক হয়েছেন। সাবাশ সাবাশ বলে অনেক বাহবা দিলেন। পাড়ার সব কাকু-কাকিমারাও খুব খুশি। ফুলঠাম্মা আর কাঁদছে না। সোনার চেনটা ফিরে পাওয়া যেতে পারে, এটা ভেবেই আনন্দে ফুলদাদুও বেজায় খুশি।
পুলিশের কালো ভ্যান চলে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমেই মেজবাবু সেপাইদের বললেন, “চোর ব্যাটাকে শিগগির জল থেকে তুলে ভ্যানে ভর। গারদে পুরে আজ ওকে বোঝাব চুরি করার মজা!” তারপর হাসতে হাসতে বললেন, “চোর যে এই নোংরা কচুরিপানার ডোবায় লুকিয়ে পড়েছিল, আপনারা বুঝলেন কি করে?”
কর্নেল জেঠু একগাল হেসে বললেন, “স্যার, আমাদের এই ছোট্ট গোয়েন্দা খেয়ালীর জন্যই তা সম্ভব হয়েছে। চোর ব্যাটা যে এই ডোবায় লুকিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিল, তা খেয়ালীই ঠিক খেয়াল করতে পেরেছে।”
মেজবাবু খুব খুশি হলেন শুনে। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন খেয়ালীর সাথে। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, “তুমি তো দারুণ বুদ্ধিমতী । রিয়েলি ইউ ব্রেভ গার্ল! তোমাকে প্রাইজ দেওয়া উচিত। আমি থানায় গিয়েই বড় বাবুকে বলব তোমার কথা। ইউ ডিসার্ভ আ প্রাইজ! থ্যাঙ্ক ইউ।”
পুলিশের জিপে বন্দী হয়ে চোরবাবাজী চলে গেল। ফুলঠাম্মার সোনার ভারী চেনটা পাওয়া গেছে। পাড়ার সবাই খুব খুশি। খেয়ালীরও আনন্দ হচ্ছে। সবাই ওর বুদ্ধির প্রশংসা করছে। খেয়ালী বাড়ি ফিরে আসতেই দাদু ওকে আদর করে বলল, “ওরে আমার ছোট্ট গোয়েন্দা! তুমি তো আজ বাজিমাৎ করে দিয়েছো!”
খেয়ালী লাজুক হেসে বলল, “তোমার কাছে বসে গোয়েন্দা গল্পগুলো শুনে শুনেই তো এভাবে ভাবতে পেরেছি। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। কেল্লা ফতে!”
“ওমা তাই!” দাদু একথা শুনে খুব খুশি।
কলিং বেলের শব্দ। দরজায় অনলাইন শপিং এর ডেলিভারি ম্যান। দাদুর নতুন বই ডেলিভারি দিতে এসেছে। খেয়ালী হেসে বলল, “দাদু, তুমি আবার গোয়েন্দা বইয়ের অর্ডার দিয়েছিলে?”
“হা হা হা।” দাদু হাসতে হাসতে একটা নতুন গোয়েন্দা গল্পের বই খেয়ালীর হাতে দিয়ে বলল, “এই বইটা তোর জন্যই অর্ডার করেছিলাম। নতুন গোয়েন্দার এটাই প্রথম পুরষ্কার!”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।