ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ৭)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় কর্তৃক
১৮৯৭ সালে নেপাল থেকে আবিষ্কৃত রামচরিত কাব্য খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বীরভূমের ছয় জন সামন্ত রাজার সম্বন্ধে আলোকপাত করেছে।

বীরভূমের লাভপুর অঞ্চল শামলাবাদ নামে তৎকালে পরিচিত ছিল। শামলাবাদের শেষ সামন্ত রাজা দিনমনি সিংহ বাহাদুর। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তিনি রাজত্ব করেছেন।

বীরভূমের কীর্ণাহারে কিঙ্কিন নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন।তাঁর পূর্বপুরুষ কীর্ণাহার মানকর এর উত্তর পূর্বে অমরার গড় থেকে এসে নানুরের নল বংশীয় রাজা সাতরায়কে নিহত করে এই অঞ্চলে রাজত্ব স্থাপন করেন। কিল গির খাঁ নামে এক পাঠান, রাজাকে হত্যা করে রাজ্য দখল করলে রানী দুর্গাবতী মহেশপুরে গিয়ে শেষ জীবন কাটান।

বীরভূমের নানুরের চারমাইল পূর্ব দক্ষিণে গোপডিহি গ্রামের কাছে লোহিত নামের এক রাজা ছিলেন। প্রায় এক বর্গমাইল গোলাকৃতি জায়গা জুড়ে রাজার রাজবাড়ী ছিল। এখানে ঘরের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন কয়েক বছর আগেও দেখা যেত‌।

বোলপুরের তিন মাইল পূর্ব উত্তরে সিয়ান নামে একটা জায়গা আছে‌ ।শিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমায় শ্বেত বসন্ত নামে একজন হিন্দু রাজা রাজত্ব করতেন।

বোলপুরের চার মাইল পশ্চিমে সুপুর গ্রামে সুরথ নামে এক রাজা রাজধানী ছিল। রাজা সুরথ প্রতিষ্ঠিত সুরথেশ্বর শিব এখনো বর্তমান।

দুবরাজপুর এর পশ্চিম উত্তরে খগরো গ্রামে খগাদিত্য নামে একজন রাজা ছিলেন।তাঁর প্রতিষ্ঠিত খগেশ্বর শিব মন্দির এখনো বর্তমান।

বীরভূমের মল্লারপুরে মল্ল নামধারী এক রাজার রাজধানী ছিল। এখানকার মলেশ্বর শিব মন্দিরের দরজায় ১১২৪ শকাব্দ ক্ষোদিত আছে। প্রবাদ এই যে, এই মন্দিরটি মল্লরাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং তন্ত্রোক্ত বচনের—

বীরভূমৌ সিদ্ধ নাথঃ
রাঢ়ে চ তারকেশ্বরঃ
সিদ্ধনাথ, এই মলেশ্বর শিব।

ময়ূরেশ্বর থানার অন্তর্গত ঢেকা গ্রামের রাজা রামজীবন রায় চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে পরিচিত। ইনি তদানীন্তন বীরভূমের রাজা, খাজা কামাল খাঁর( মৃত্যু ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দ) সমকালে বর্তমান ছিলেন। রাজা রামজীবন রায় বীরভূমের কলেশ্বরের বিখ্যাত শিব মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে ইনি তারাপীঠ মন্দির অবস্থিত চন্দ্রচূড় শিব মন্দিরটির সংস্কার করেন।
এইভাবে সারা বীরভূম জেলা জুড়ে অসংখ্য সামন্ত রাজাদের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরসমূহ আজও বর্তমান।
মুসলমান শাসন আধিকারে বীরভূম জেলা যাওয়ার আগে বীরভূমে গুপ্ত যুগ ,পাল যুগ, বর্মন যুগ ও সেন যুগ অতিবাহিত হয়েছে।
গুপ্তযুগের সভ্যতা হিসেবে বীরভূমের বারা ও নানুর সুপরিচিত। ওই জায়গা দুটি থেকেই
গুপ্ত বালাদিত্য নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে।
নানুরের কাছে বেলুটি গ্রামে মহাকবি কালিদাসের বাড়ি ছিল বলে জনশ্রুতি আছে।
এই গ্রামে একটি সরস্বতী মন্দির আছে এবং ‘কালিদাসের ঢিপি’ নামে একটি ঢিপি আছে।
পাল যুগের লিপি পাওয়া গেছে মুরারই এর কাছে পাইকরে। পাইকর গ্রামে রাজা নয় পাল দেব এবং তার ছেলে বিদ্রোহ পাল দেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ চেদীরাজ লক্ষী কর্ণের নামাঙ্কিত একটি স্তম্ভ লিপি পাওয়া যায়।
পাল যুগের পরে এই জেলায় বর্মন যুগ এসেছিল। এই জেলার সঙ্গে ভোজ বর্মা, শ্যামল বর্মা ও হরি বর্মার যোগ ছিল। লাভপুরের কাছে সামলাবাদ এই শ্যামল বর্মার নামে পরিচিত ।

কীর্তি সেনের তাম্র শাসনে সামন্ত সেন নামে এক রাজার নাম উল্লিখিত আছে। এই সেন রাজাদের পূর্বপুরুষরা কর্নাট ক্ষত্রিয়গণ রাঢ়ে এসে রাজত্ব স্থাপন করেন। রাজেন্দ্র চোল ১০২০ খ্রিস্টাব্দে রাঢ় আক্রমণ করেন। বীরভূমের বীরনগর এর কাছাকাছি নাকি ছিল সামন্ত সেনের রাজ্য ও রাজধানী। সামন্ত সেনের ছেলে হেমন্ত সেন রাঢ়ে ও বীর নগরে বাস করতেন , তাঁর ছেলে বিজয় সেন খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দী শতাংশে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেন। তাঁর মন্ত্রী পাহি দত্তের নাম থেকেই ‘পাইকর’ নামটি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন । বীরভূম জেলার মুরারই এর কাছে এই পাইকর বর্তমান।
সেন রাজাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের ফলে বক্তিয়ারের সেনাপতি মোঃ শেরান বীরভূমের প্রাচীন রাজধানী লক্ষণ নগর বা লক্ষ্ণুর দখল করেন।
বল্লাল সেনের নৈহাটি সীতাহাটি তাম্র শাসন থেকেও প্রমাণিত হয় যে সেন রাজাদের আদি উদ্ভব স্থল ছিল রাঢ় জনপদে(বংশে তস্যাভ্যুদয়িনি সদাচারচর্চা,– নিরুঢ়ি প্রৌঢ়া রাঢ়া মকলিতচরৈর্ভুষয়ন্তোহনুভাবৈঃ) এবং আদি পর্বে রাঢ়দেশের মধ্যেই রাজধানী বা শাসন কেন্দ্র ছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধকে কেন্দ্র করে বেদ বিরোধী বৌদ্ধ জৈন ও আজীবক ধর্মমতের উদ্ভব হয়েছিল এবং পার্শ্ববর্তী রাঢ় অঞ্চলে ওই সকল ধর্ম মতের প্রভাব ও প্রসার পড়েছিল। 24 জন জৈন তীর্থঙ্কর এর মধ্যে কুড়ি জনের নির্বাণ লাভের স্থান ছিল পরেশনাথ পাহাড়, যার অবস্থিতি ছিল রাঢ় ভুমিতে ।
গুপ্ত যুগ এবং গুপ্ত যুগের পরেও বহু লিপি এবং প্রাচীন জৈন মূর্তির নিদর্শন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে বীরভূমে জৈন ধর্মের ব্যাপক প্রচার হয়েছিল।
বীরভূমের বিভিন্ন মন্দিরে পূজিত দেবদেবীর মধ্যে তার প্রমাণ আজও মেলে।
পাল যুগে রাঢ়বঙ্গে বৌদ্ধ সহজযান ধর্মমতের প্রচার হয়েছিল বলে জানা যায়।
গুপ্ত রাজাদের আমলে বা তার কিছু পূর্বে রাঢ়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব দেখা যায়। গুপ্ত যুগে রাঢ় জনপদ গুপ্ত অধিকারভুক্ত হওয়ার ফলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভক্তিবাদী ধর্ম আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং প্রাচীন পুরাণ গুলি এই পর্বে পূনর্লিখিত হয়ে বর্ধিত ও বর্তমান আকারে প্রচারিত হয়েছিল। রাঢ় দেশ তথা বীরভূমে প্রধানত বিষ্ণু শিব ও সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রথম পর্বে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। রাঢ়ে পৌরাণিক ধর্মের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পঞ্চোপসনা। বিভিন্ন পুরান কে অবলম্বন করে বিষ্ণু ,শিব ,শক্তি, সূর্য ও গণেশ কে কেন্দ্র করে বৈষ্ণব ,শৈব, শাক্ত,সৌর ও গাণপত্য সম্প্রদায় গুলির উদ্ভব হয়েছিল।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।