সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ৩)

আমার মেয়েবেলা

ডিসেম্বর মাস টা আমাদের ফরাক্কার সকলের খুব ভাল কাটত। নভেম্বর ডিসেম্বর জানুয়ারি । এই তিনটে মাস যেন একটা স্বপ্নের মধ্যে থাকতাম আমরা। পরীক্ষা হয়ে যেত। বেশ ঠান্ডা পড়ত।চারিদিকে জল মাঝখানে ছোট্ট ফরাক্কা। ঠান্ডা তো পড়বেই। কিন্তু তবুও আমাদের অত ঠান্ডা লাগত না। সয়ে গিয়েছিল। সকালে উঠেই মনটা ভাল হয়ে যেত।
খুব সুন্দর একটা ঝকঝকে সকাল ছিল আমাদের ,,, কনকনে ঠান্ডা,, আবার রোদে বসলেই শীত উধাও,,, চারিদিকে উৎসবের মেজাজ,,, পরীক্ষা শেষ। পড়াশোনার বালাই নেই।
আমরা কেউই অত এখনকার ছেলেমেয়ে দের মতো পড়াশোনা করতাম না। পরীক্ষা হয়ে গেল। বই বন্ধ । রেজাল্ট বেরোলে নতুন বই পেলে তখন আবার দেখা যাবে । এখন শুধু খেলাধুলা, গান বাজনা,
গঙ্গায় দাপাদাপি ,ফুল চুরি, কারোর বাড়ির মোটাসোটা হাঁস মুরগি নিয়ে এসে নিজের ভেবে কোনও ফাঁকা কোয়ার্টার এ ছোটখাটো পিকনিক করা, পাশের গ্রাম থেকে পথ ভুলে চলে আসা কোনও হৃষ্টপুষ্ট ছাগল,,, এক রাত্তিরে কেটেকুটে ধুয়ে ফিস্ট করে সাফ করা,,,
অবশ্য এসব চুরির ঘটনায় আমি কিন্তু ছিলাম না। এগুলো সব বন্ধুরা বা বড়ো দাদারা করত। মেয়েরা এসবের মধ্যে ছিল না।
তখন আমাদের ফরাক্কায় গান বাজনার খুব চল ছিল। সন্ধ্যা বেলায় এমন কোন কোয়ার্টার ছিল না যেখান থেকে হারমোনিয়াম তবলা বা ঘুঙুর এর শব্দ শোনা যেত না। আমারও গান করা ছিল। তবে আমার মাস্টারমশাই রাত আটটায় আসতেন । চলত রাত এগারোটা বারোটা পর্যন্ত।
তো যাইহোক শীতকালে আমরা ছেলেমেয়েরা যেন একটু অন্য মুডে থাকতাম। চারিদিকে রঙিন প্রজাপতির মতো এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পতপত করে উড়ে বেড়াতাম,,
তবে আমি বেশি উড়তে পারতাম না আমার মায়ের নজরদারির জন্য ।
শীতের এই তিন মাস আমাদের ফরাক্কায় যাত্রা হোত। উফ্ সে যে কী আনন্দ কী যে উত্তেজনা!
এই সময়টায় তখন আমিও অন্যদের মতো একটা উৎসবের মেজাজেই কাটাতাম। সব চেয়ে বড়ো কথা পরীক্ষাটা হয়ে যেত।। সুদ কষতে হত না, চৌবাচ্ছার জল বেরিয়ে যাওয়া ঢোকার হিসেব রাখতে হতো না। তেল মাখা বাঁশে বাঁদরের ঢংও দেখতে হত না।। লাভ ক্ষতির পরিমাণ না দেখে নিজের মতো একটু কাটাতাম পুতুলের বিয়ে টিয়ে দিয়ে।
বাপরে এই অংক আমাকে সারাটা বছর যে কী জ্বালাতন করত। ভাল লাগত না কিছু। পাগল পাগল লাগত ক দেখলেই।।
‘আমার মেয়েবেলার সেই সময়টায় স্কুলে এসেই জল খাওয়াটা খুব বেড়ে যেত আমার। ফার্স্ট পিরিয়েড খুব মন দিয়ে করতাম। হয় বাংলা নাহলে ইংরেজি ক্লাস হত। ভাল লাগত । অসুবিধা হত না। তবে 45 মিনিট ক্লাস করার পর মাথাটা ছাড়ানোর জন্য ক্লাসের বাইরে আমাকে যেতেই হোত। আর পরের ক্লাস যদি অংক বা ফিজিক্যাল সায়েন্স হত ,,, তাহলে তো কোনও কথাই নেই। বাইরে বেরোতামই। মনিটরের কোনও কথা শুনতাম না ।
আর মনিটররা না ছাড়লে
ক্লাসে বসে ওদের সঙ্গেই অনর্গল কথা বলতাম। টিচার দেখলে ঝাড় খেত মনিটররা। অনেক রকমই চাপ ছিল ওদের। দুষ্টু গরুর থেকে শূন্য গোয়াল অনেক ভাল। তাই আমাকে কেউই আর তেমন আটকাত না।
আমি গোটা স্কুলটা ঘুরতাম।প্রথমে টয়লেটে যেতাম। তারপর জল খাওয়া, স্কার্ট ভেজানো কমপ্লিট করে হেড স্যারের ঘরের পাশে ঐ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের স্কুলের বাইরের বড় খেলার মাঠটা দেখতাম। অনেক দূর পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করতাম। গরমের সময় প্রচন্ড গরম পড়তো। রোদের তেজও ছিল তেমনি। লু লেগে যেত আমাদের,, গরু গুলোও ঘাস খেতে খেতে ছায়ায় এসে বসে পড়ত ধপ করে।
আশেপাশের সব কোয়ার্টার এর দরজা জানলা বন্ধ থাকত । অসম্ভব একটা নির্জন দুপুর। এই রকম দুপুর আমার খুব প্রিয় ছিল,,, অংক ক্লাস ততক্ষণে শুরু হয়ে যেত। চোরের মত মুখ করে ক্লাসে ঢুকতাম। মাথার মধ্যে দিয়ে পাটিগণিত এর জটিল সমীকরণ উড়ে উড়ে চলে যেত। তাও বীজগণিত জ্যামিতি টা মন্দের ভাল ছিল। অংক ক্লাসে জানলা দিয়ে পাখি ওড়া দেখতাম। একটা কাঠবেড়ালি কী সুন্দর বসে বসে পাকা পেয়ারা খেত। ওমনি মনে পড়ে যেত স্কুল ছুটি হলে পাল কাকুর বাড়ি যাব। কাকুর বাগানের পেয়ারা গাছটায় বেশ ডাঁশা পেয়ারা হয়েছে। কাকুকে বলতে হবে।। না আমি কখনো ফুল ছাড়া আর অন্য কিছু চুরি করিনি।।
আমার আর একটা নেশা ছিল । নিজের সঙ্গে কথা বলতে আমি খুব ভালো বাসতাম। যে কথা কাউকে বলা যায় না সে কথা বলা যায় নিজেকে ,,নিজের সঙ্গে একটা সখ্যতা,, একটা বোঝাপড়াও যেন গড়ে তোলা যায় এইভাবে কথা বলে,,নিজের সঙ্গে সুন্দর একটা সময় কাটান যায়,,, নিজের ভুল গুলো শুধরে নেওয়ার একটা পথ খুঁজে পাওয়া যায়,,কিংবা আমার ” আমি” টার একটা আলাদা স্বতন্ত্র স্বত্তা অনুভব করা যায় । বাড়িতে তো এসব হয়না। সারাক্ষণ মায়ের সজাগ দৃষ্টি,, একটু এলোমেলো করে ,,, নিজের মতো করে থাকার স্বাধীনতা কই পেতাম।
দুটো ক্লাসের মাঝে এই যে মিনিট তিনেক বা মিনিট পাঁচেক সময় পেতাম!! খুব এনজয় করতাম আমি,, আসলে আমার মনের মধ্যে দুটো স্বত্তাই খুব স্ট্রং ছিল। আমি যেমন এক্সট্রোভার্ট ছিলাম। আবার তেমনই ছিলাম ইনট্রোভার্ট । তখন বুঝতে পারিনি। এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি।।
আমি বন্ধু দের সঙ্গে যেমন হৈ চৈ করতাম। আবার একা থাকতেও পছন্দ করতাম। টিফিনের সময় কোনও কোনও দিন ঐ বারান্দার গ্রিল ধরে অনেক দূর দেখার চেষ্টা করতাম। একটা নিস্তব্ধতা যেন আমাকে টানত। ঘুঘুর ডাক,,, মাঝে মাঝে গরুর হাম্বা,,,ছাগলের ম্যা ম্যা,,,,, গরু বা মোষের মাথায় অথবা লেজে বসে কাকেদের দুষ্টুমি। দূরে সাইকেল চালিয়ে কোনও কাকুর বাড়িতে ভাত খেতে আসা।স্কুলের ছোট মাঠে ছোট ছোট ভাই বোন গুলোর দৌড়াদৌড়ি। দেখতে মন্দ লাগত না।।
সেই সময় আমি আমার সঙ্গে কথা বলে আমার ভাললাগা,,, দুঃখ,, কষ্ট,,, যন্ত্রণা,,, আনন্দ সব কিছুই ভাগ করে নিতাম। ঠিক ভুলের বিচার করতাম। নিজের কাছে নিজেই পরামর্শ চাইতাম। সাইকোলজির ভাষায় যাকে বলে,, “কাউন্সেলিং”।
তখন থেকেই আমি এটা করতাম। কিন্তু তখন বুঝতে পারি নি।।
যা বলছিলাম সেই সময় মানে শীতকালটা অত
পড়াশুনোর ঝামেলা থাকত না। খুব সকালে ফুল টুল তুলে মালা গেঁথে,,, তারপর এক ঘন্টা গান করে আমার ছুটি। তখন আমি কোয়ার্টার এর সামনে বাগানে চেয়ার বা মাদুর পেতে বসতাম। পা দুলিয়ে দুলিয়ে কমলালেবু খেতাম। গাঁদা ফুলের পাপড়ি গুলো সব ছিঁড়ে একটা উঁচু মতো যেটার ওপর পাপড়ি গুলো আটকে থাকত
মনে হয় ওটাই বৃতি। ওটা খেতাম। এক বান্ধবী শিখিয়েছিল খেতে।। মা বাগানে একটা থালায় করে বা কুলোতে করে নুন হলুদ লঙ্কা একটু সামান্য সরষে বাটা মাখিয়ে পাকা কুল শুকোতে দিত। সারি সারি কাচের বয়ামে কুলের আচার,,, আহা কী তার স্বাদ!
মাদুর পেতে মা লেপ রোদে দিত। আমি আর ভাই ঐ লেপের তলায় ঢুকে ঘর ঘর খেলতাম। কখনও আবার আরামে ঘুমিয়েই পড়তাম।
সব কোয়ার্টারের সামনে ,পাশে,,ফুলের বাগান থাকত। নানা ধরণের সবজিরও বাগানও ছিল। গাঁদাফুলের সমারোহে আমাদের “ফরাক্কা” তখন বাসন্তী রঙে রঙিন। রাস্তার দুধারে কোয়ার্টার এর সামনে সবার বাগানে গাঁদা, চন্দ্র মল্লিকা ফুটে থাকত। কী যে ভাল লাগত! চারিদিকে হলুদ কমলা সাদা ফুলে কোয়ার্টারের রাস্তাগুলো যেন একদম অন্যরকম হয়ে যেত। কি সুন্দর গন্ধ বেরোত!
তখন ফরাক্কা টাউনশিপ একটু একটু করে জমজমাট হচ্ছে । নতুন নতুন কোয়ার্টার,, ঝকঝকে পিচের ঢালা পরিষ্কার রাস্তা । কোথাও কোনও নোংরা নেই। টাউনশিপ ডিভিশন তখন দুর্দান্ত কাজ করছে। সকালে জমাদার কাকু এসে সকলের কোয়ার্টারের বাথরুম, পায়খানা, নর্দমা পরিষ্কার করে দিয়ে যেত। ফরাক্কা তখন ক্যালেন্ডার এর ছবির মতো ঝকঝকে। সত্যিই আমাদের ফরাক্কা তখন এতটাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল যে হাইড্রেন দিয়েও কোনও বাজে গন্ধ বেরোত না। খুব মেইনটেইন করা হত।। টাউনশিপ অফিসে খবর দিলেই ঘর হোয়াইট ওয়াশ করে দিয়ে যেত বিনা খরচায়। একদম সাদা সাপটা চুনের দেওয়াল দেখেই বড়ো হয়েছি। তখন প্লাস্টিক পেইন্ট কি তাই ই জানতাম না।
সকলের উঠোন ছিল সিমেন্টে বাঁধানো। ঝকঝকে। আর ছিল সিমেন্টে বাঁধানো তুলসী মঞ্চ। সারা বৈশাখ মাস ভোর জলের ধারা দেওয়া হত। ফুঁটো ওয়ালা ছোট্ট মাটির ঘট তুলসী গাছের দুধারে পুঁতে রাখা দুটো
শক্ত কাঠির সাহায্যে বেঁধে দেওয়া হতো। তুলসী গাছের মাথার উপর ঘট টা বাঁধা থাকত। আমরা জল ভর্তি করে রাখতাম। শেষ হলেই আবার ঘটে জল ভর্তি করে দিতাম। তুলসী গাছের গোড়ায় একটা ছোট্ট শিবলিঙ্গও থাকত। তাঁর মাথায় টুপ টুপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ত। মা বলত গরমে তো শিব ঠাকুরের কষ্ট হয়। তাই তাঁর মাথায় সব সময় গঙ্গা জল দিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। আমি যতক্ষণ বাড়ি থাকতাম খেয়াল রাখতাম। ঘটে জল শেষ হয়ে গেলেই দৌড়ে ঘট ভর্তি করে চলে আসতাম। সিমেন্টের উঠোন রোদে আগুন হয়ে থাকত। চটি পরে তো আর তুলসী মঞ্চে জল দিতে পারি না। খালি পায়েই দিতাম। উফ্ কী গরম হয়ে থাকত উঠোনটা। খুব কষ্ট হতো আমার।
গরম কালে রাতে আমরা ঐ উঠোনে বসেই খেতাম, লন্ঠন জ্বালিয়ে। গরমের সময় প্রতিদিন কারেন্ট চলে যেত। আমরা তখনও লোডশেডিং বলতে শিখিনি।শেষ পাতে বাবা আবার গুড় দিয়ে রুটি খেত। যত ভাল রান্নাই হোক শেষে বাবার গুড় চাইই চাই।। গরমের সময় বেশির ভাগ দিনই আমি পান্তা ভাত খেতাম। আগের দিনের ভাত না থাকলে গরম ভাত জল ঢেলে তার সঙ্গে ছোলার ছাতু, নুন পেঁয়াজ সরষের তেল দিয়ে সাথে আলুসেদ্ধ বা আলুভাজা আহা কী যে অসাধারণ। মা ই মেখে দিত। তখন আমি আলুসেদ্ধ বলতাম। কলকাতায় এসে শিখলাম একে বলে আলুভাতে।
যাইহোক একটু বড়ো হতেই তার সঙ্গে ছোট্ট একটা কাঁচা লঙ্কা খেতে শিখলাম। যেদিন মাংস হতো সেদিন জলঢালা ভাত খেতাম না। তবে আম লিচু খাওয়া হত প্রচুর।
ভাত খেতে বসার আগে একটা বাটিতে জল দিয়ে তাতে চারটে আম বোঁটা কেটে ভিজিয়ে খেতে বসা হত। এ কাজটা বাবাই করত। পরে বড়ো হতে আমিই করতাম। আমার বাবা ঘরের অনেক কাজই করত। আসলে মানুষ টা একদম বসে থাকতে পারত না। সব কাজেই এক্সপার্ট ছিল। কী ভাল রান্না করত আমার বাবা! মা তো বাবার কাছেই রান্না শিখেছিল। বাবা কাজ করলে আমার ভারি কষ্ট হত। একটু বড়ো হতেই বাবাকে রিলিফ দেওয়ার জন্য বাবাকে সাহায্য করতে শুরু করলাম। একটাই লক্ষ্য তাড়াতাড়ি বাবার কাজগুলো শিখে নেওয়া। এই উদ্দেশ্যে আমি অল্প বয়েসে ই অনেক কাজ শিখে গিয়েছিলাম।