“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় স্বপন পাল

ছায়াশরীর  

দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে শুভ। কলিংবেলের সুইচের গায়ে আঙুল কিন্তু চাপ দিতে পারছেনা। ভিতরে শান্তামাসিমা এই অন্ধকারে কারো সাথে কথা বলছেন। কার সাথে ? কৌতুহল বড় বিষম বস্তু। এই মাত্র চারদিক অন্ধকার করে আলো চলে গেল। দুপুরে জোর বৃষ্টি হয়েছে, তখন থেকেই গণ্ডগোল। আসছে যাচ্ছে। কতক্ষণ পর আবার আলো আসবে কে জানে। আলো এলেই না হয় আবার আসবে শুভ, এখন আর না ঢোকাই ভালো। তবু একবার এক পাল্লার দরোজাটায় হাত দিলো, ওমা খুলে যাচ্ছে যে। একটু ফাঁক হতেই কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেলো শুভ। শান্তামাসিমা বলছেন, আমি এখন ব্যাঙ্কের কাজ অনেকটাই পারি গো। তুমি অতো ভেবো না। তাছাড়া শুভ আছে না, সরলের ছেলে শুভ, ও সব করে দেয়। কি ভালো যে ছেলেটা। এই লকডাউনের সময়েও ও দু’একদিন পর পর খবর নেয়। যদিও ছাদে উঠে ডাক দিলেই হয়, কিন্তু তা করেনা, ঘরে ঢুকে খোঁজ নেয়। আবার বাজার ফেরত এলে কিছুতেই ঘরে ঢুকবেনা। বলবে দোকানের জিনিসগুলো দরজায় রাখছি মাসিমা, নিয়ে নেবেন। নিজের কথা শুনে একটু দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শুভ। মাসিমার প্রশংসা। কেউ আছে, কিম্বা দেখা করতে এসেছে। যদিও এই ভাইরাস সংক্রমণের সংকট কালে কেউ কারো বাড়িতে খুব প্রয়োজন ছাড়া যায় না। খোঁজখবর তো মোবাইলেই সারে। বোধহয় খাবারঘরের টেবিলে ইমার্জেন্সি ল্যাম্প জ্বলছে। শান্তামাসিমাকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু দেওয়ালে ওঁর ছায়াটা বিশাল লম্বা হয়ে কথার তালে তালে সাযুজ্য রেখে দুলছে। শুভর ইচ্ছে করলো না শান্তামাসিমাকে ডাকতে। আস্তে আস্তে দরোজাটা ভেজিয়ে রেখে ফিরে এলো নিজের বাড়িতে। ডাকাবুকো মহিলা এই শান্তামাসিমা। একাই থাকেন নিজের বাড়িতে। একবছরের বেশীই হলো দত্ত মেসোমশাই বুকে ব্যথা নিয়ে একরাত্রে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতাল নিয়ে গিয়েছিল শুভ আর আরো ক’জন পাড়ার মানুষ মিলে। সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল, ভেন্টিলেটরে দিয়েও বাঁচাতে পারেনি। ভোর নাগাদ মারা গেলেন। সেই থেকে
মাসিমা একা। অনেকে বলেছে একজন সবসময়ের জন্য কাজের মেয়ে রাখতে। মাসিমা রাজি হয়নি। এখন নিজের মোবাইল আর জেরক্স-এর দোকান সামলে, কোনদিন দোকানের ছেলেটাকে বসিয়ে রেখে শুভ মাসিমার প্রয়োজনের জিনিসগুলো কিনে আনে কিম্বা ব্যাঙ্কে যায়। আজ যেমন গিয়েছিল ১৫ এইচ ফর্ম জমা করতে আর পাশবইটা আপ টু ডেট করে আনতে। পাশবইটাই ফেরত দিতে এসেছিল সে, তা সেটা কাল সকালে দিয়ে দেবে। শান্তামাসিমার বাড়ির দরোজাটা যে খিল দেওয়া নাই সেটা মাসিমা জানে তো? একটা ফোন করা যাক ভাবলো শুভ। মাসীমাকে বলা উচিত যে সদর দরোজাটায় খিল আঁটা নেই। শান্তা মাসিমা ফোন তুলতেই শুভ বললো, আমি শুভ মাসিমা, দুপুরে আর পাশবইটা ফেরৎ দিতে যাইনি। ভাবলাম খাওয়ার পর হয়তো বিশ্রাম করছেন। তাই রাতে দোকান বন্ধ করে একটু আগে গিয়েছিলাম আপনার সাথে দেখা করতে। আমি ঢুকেছি আপনাদের বাড়ি ওমনি পাওয়ার চলে গেল, কাল সকালে বেরোনোর সময় পাশবইটা ফেরৎ দিয়ে যাবো কেমন, আর ব্যাঙ্কে আপনার ১৫ এইচ ফর্ম জমা করে দিয়েছি। আচ্ছা মাসিমা আপনাদের বাড়িতে কেউ এসেছে ? কারো সঙ্গে কথা বলছিলেন মনে হলো ? এখনও শুভ শান্তার বাড়ির মালিকানায় বহুবচন ব্যবহার করে, মেসোমশাই থাকতে যে অভ্যেস সে কি আর সহজে যাবে। শুভ শুনলো, মাসিমা বলছেন, আমাদের বাড়িতে কে আসবে শুভ, কই কেউ তো আসেনি, তাছাড়া এই লকডাউনের সময় কে বা আসবে বলো ? কেন, তুমি কি কাউকে দেখেছ ? শুভ একটু আতান্তরে পড়ে গেল। সে বলতেও পারছেনা যে দরজা অল্প ফাঁক করে সে শুনেছে মাসিমা কারো কাছে শুভর প্রশংসা করছেন। কেমন যেন ভদ্রতায় বাধলো। শুধু বললো ঠিক আছে মাসিমা কাল সকালে যাবো, এখন তো রাত হয়েছে, দরোজায় খিল দিতে ভুলবেন না কিন্তু। বলতে বলতেই আলো জ্বললো, ফ্যান চলতে শুরু করলো। শুভর মনে একটা প্রশ্ন কাঁটার মতো বিঁধতে লাগলো, মাসিমা অস্বীকার করলেন কেন ? শুভকে মাসিমা এতো ভালবাসেন, বিশ্বাস করেন তবু লুকিয়ে গেলেন ? আলো এসেছে এই কিছুক্ষণ হলো। শান্তা দত্ত টেবিল থেকে মোবাইলটা সরিয়ে
ভিতরের ঘরে রেখে এলো। তারপর বললো, তোমাকে খাবার দিই ? রাত হয়ে যাচ্ছে, থাকবে তো নাকি ? দু’টো প্লেটে দু’খানি করে রুটি, পাঁচমিশেলি তরকারি, একটা করে মিষ্টি আর জল দু’গ্লাস রাখলেন টেবিলে। তারপর একটা চেয়ার টেনে খেতে বসলো শান্তা। খাবার সময় গল্প করার অভ্যেস শান্তার বহু পুরোনো। সেই সঞ্জু থাকতে ওর বাবা যেমন বকবক করতো তেমনি সঞ্জুও। শান্তা ওদের মধ্যে কম। ওদের খাবার পাতে এটা ওটা তুলে দিতে দিতে সব শুনতো, মন্তব্যও করতো। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার শেষ ধাপে ক্যাম্পাসেই চাকরি পেয়ে যায় সঞ্জু। সেদিন সঞ্জুর বাবার খুশি দেখে কে। শান্তার খুশি একটু চাপা ধরণের। সাফল্য উদযাপন করতে পরদিন সন্ধ্যেয় সঞ্জুর বাবা বাড়িতেই পার্টি দিয়ে বসলেন। পাড়ার লোকজন, বন্ধু, কাছাকাছি থাকা আত্মীয়, সঞ্জুর বন্ধুরা সব মিলে হৈ হৈ ব্যাপার। কাছের হোটেল থেকে খাবার আর সার্ভিসের লোক আনিয়ে ছিলেন। মনে আছে, সেদিন আড়ালে শান্তাকে ডেকে বলেছিলেন, তোমার ছেলে বড় হয়ে গেছে, এখন ও মদ টদ একটু আধটু খাবে, বোকো না যেন। দ্যাখো আমি কি উচ্ছন্নে গেছি ? তোমার ছেলেও ঠিক থাকবে দেখে নিও। তা শান্তা কম কিছু দেখেনি। চাকরি পাওয়ার একবছর পর বিয়ে করে বসলো ওরই কলিগ একটি মেয়েকে। বয়সে ছোট না বড় বলা মুশকিল। দেড় বছরের মাথায় এই চাকরি ছেড়ে পাড়ি দিলো ওদের স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। এখন মাঝে মধ্যে কখনো মনে হলে ফোন করে। ওদের স্বামী-স্ত্রীতে বনিবনা হয়না অনেকদিন। হয়তো আলাদা হবে। কিম্বা হয়ে গেছে, শান্তা জানেনা। তারপর হয়তো আবার কারো সাথে ঘর বাঁধবে, ঋতুর পাখিদের মতো। তাও ভালো ওদের কোন সন্তান নেই। খেতে খেতে শান্তা বললো জানো গত সপ্তাহে সঞ্জু ফোন করেনি, তাও তো টাকা পয়সা কিছুই পাঠাতে হয়না। আসা তো ছেড়েই দাও, আমি মরে গেলে তখন হয়তো আসবে, আর বাড়ি বিক্রি করে টাকাগুলো নিয়ে চলে যাবে। আমি জানোতো কোন ছবি টবি রাখিনা আর। ওতো মা-বাবার ছবিও সঙ্গে নিয়ে যাবেনা। যে মানুষ বাড়ি কিনবে সেতো বুড়োবুড়ির ছবি ফ্রেমসমেত বিক্রি করে দেবে কাবারিওয়ালার কাছে, ফ্রেমটার দাম পাবে, ছবি যাবে আস্তাকুঁড়ে। বলে বিষন্ন হাসলো শান্তা। খাওয়া শেষ হয়েছে। প্লেটগুলো তুলে রান্নাঘরের সিঙ্কে রাখলো। প্লেটে পড়ে থাকা বাড়তি খাবার ফেললো গারবেজ প্যাকেটে। শুধু বললো, তুমি যাও না শুয়ে পড়ো। আমার সময় লাগবে। প্লেট ধুয়ে। রান্নাঘরটা পরিস্কার করে তারপর শোবো। তোমার ঘরে বিছানা তৈরি আছে, বাতি নেভানো। শুধু মশা তাড়ানোর রিপেলেন্টটা বন্ধ করে দিও। এখন খুব একটা মশা নেই। শান্তা দেখলো চেয়ারটা নিজে নিজেই একটু পিছিয়ে গেলো। কেউ চটি পড়ে হেঁটে চলে গেলে যেমন হাল্কা শব্দ হয় তেমনই শব্দ হলো। শান্তা খুশি মুখে রান্নাঘরের দিকে যেতে যাবে ঝপ করে অমনি পাওয়ার চলে গেল। এতক্ষণ আলোয় থাকায় অন্ধকারটা একটু বেশিই গাঢ় লাগলো শান্তার চোখে। কোথায় ইমার্জেন্সি ল্যাম্পটা রেখেছিল মনে করতে করতে দেখলো ইমার্জেন্সি ল্যাম্প জ্বলে উঠলো। পায়ের শব্দটা আবার ফিরে এলো। অন্ধকারে শান্তার লম্বা ছায়া দেয়াল ছাড়িয়ে সিলিংয়ে গিয়ে ঠেকলো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।