দিনান্তের সূর্য পাটে বসেছে নদীর অপর পাড়ে। মেঘনার ফেরীঘাটে দাঁড়িয়েও চারপাশের কোলাহল যেন হিয়াকে ছুঁতে পারছিল না। আলগা চোখে ও তাকিয়েছিল ব্যস্ত হয়ে ছুটে চলা পথচারী মানুষজনের দিকে, আসলে মনে মনে হিয়া হারিয়ে গিয়েছিল অনেক দূরে – সময়ের ঢেউ দুহাতে সরাতে সরাতে।
এই মেঘনার তীরেই ছিল আশুগঞ্জ, আছে এখনও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন ওর শ্বশুরমশাই। দেশভাগ তাদের পরিবারকে উদ্বাস্তু করে বাধ্য করেনি মাতৃভূমির মায়া কাটাতে। প্রতিবেশীরা শক্ত হাতে ঘিরে রেখেছিল সব বিপদ দূরে ঠেকিয়ে। জীবন যখন ডানা মেলেছে তখনই এল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ক্যাম্পাসের মধ্যেই সহকর্মী অধ্যাপককে বাঁচাতে গিয়ে অসময়ে ডেকে আনলেন নির্মম মৃত্যুকে। তরুণী স্ত্রী শিশুপুত্রকে নিয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হলেন। সে দেশের আত্মীয়দের সাহায্যে প্রাথমিক কিছু ব্যবস্থা হয়, তারপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় একা। ডিগ্রী ছিল, তাই স্কুলের চাকরিটা পেয়ে বহু কষ্টে ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছেন। অয়ন অবশ্য বাবা মার মতো শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেয়নি। ছোট থেকেই আঁকার হাত ছিল দুর্দান্ত। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসাবে কদর পেতে বেশী সময় লাগেনি। নামজাদা অ্যাড এজেন্সিতে মোটা মাইনের চাকরি করে সে। কয়েক মাস আগে অয়ন আর হিয়ার বিয়ের আঠেরো বছর পূর্ণ হল। হিয়া বিয়ের পরে নানা প্রসঙ্গে শুনেছে এসব কথা।
অয়ন আর ওর মার মনে এখনো ফেলে আসা জন্মভূমির শিকড় উপড়ে আসার ক্ষত পুরোপুরি শুকোয়নি –বুঝতে পারে হিয়া। অয়ন সাধারণত এসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু হিয়া এত বছরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অনুভব করতে পারে পিছনে ফেলে আসা মাটির টান ছড়িয়ে গেছে অনেক গভীরে।অন্তরে মাতৃভূমির আসনখানি আজও সযত্নে পাতা।
আজন্ম কোলকাতার আদ্যন্ত শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা হিয়া কিন্তু বাংলাদেশের প্রেমে পড়েছিল সাহিত্যকে ভালবেসে। বাংলাদেশ ওর কাছে রবিঠাকুরের শিলাইদহ যেমন, তেমনই আখতারুজ্জামান,হুমায়ুন আহমেদের লেখার ভাটিয়ালী সুর। সেই সুর বুকে নিয়েই বাংলাদেশ সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে আসা হিয়ার। লেখিকা হিসেবে অল্পস্বল্প খ্যাতি আছে হিয়ার, আমন্ত্রণ পেয়েছে সেই সূত্রেই।
তিনদিন হোলো অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিক ব্যবহারে আপ্লুত হয়েছে হিয়া। কতদিনের চেনা মনে হচ্ছে দুদিনের পরিচিত মানুষগুলোকে। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কবীরের সঙ্গে এসেছিল মেঘনা নদী দেখতে। কত কথা বলে যাচ্ছিল সদ্য তরুণ ছেলেটি, সব কানে যাচ্ছিল না হিয়ার। মেঘনার কালো জলে লুকিয়ে আছে কত ইতিহাস, তার ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো কে যেন গুনগুন করে পড়ছিল হিয়ার কানে কানে। নদীর বুক ছুঁয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আদর করে ছুঁয়ে দিল হিয়ার কপাল ,যেন অদেখা শ্বশুরভিটের গুরুজনেরা আশীর্বাদ জানালেন তাকে। মনে মনে সকলকে প্রণাম জানাল হিয়া। মনে পড়ে গেল, স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে অয়নের মার ভিজে আসা চোখের পাতা, নির্বাক অয়নের ঝলমলে দৃষ্টি। কদিনের এই সফরে অনেক কিছু প্রাপ্তি হলো হিয়ার। তাদের ভালোবাসায় মুড়ে বুকে নিয়ে ফিরে যাবে সে রাত পোহালে।
কয়েকটা ধাপ নেমে নদীর জল কয়েক ফোঁটা মাথায় ছোঁয়াল হিয়া, ভিজে জলের ঘ্রাণ নিল বুক ভরে। জলে ভেজা পায়ের ছাপ রেখে যখন সে উঠে আসছিল, গোধূলির রাঙা আলো মেখে তার সিক্ত পদচিহ্নকে মনে হচ্ছিল –কনেবউ প্রথম শ্বশুরঘরে প্রবেশ করছে —পায়ের দুধে আলতার ছাপ ফেলে।