হাতের তালু থেকে খৈনিটা জিভের নিচে চালান করতে করতে গেট খোলার জন্য এগিয়ে গেল কিষণলাল। এই ফ্ল্যাটবাড়িতে এত বড় ফোর্ড গাড়ি একটাই, তাই বোধহয় গাড়ি আর গাড়ির মালিককে একটু বাড়তি খাতির করে দারোয়ান কিষণ। আর খাতির করবে না কেন? কত বড় ডাক্তার সেন সাহেব। মেমসাবও ডাক্তার, তবে আজব ধরনের, তিনি নাকি রোগী দেখে ওষুধ দেন না, শুধু অজ্ঞান করেন। আসলে অ্যানাসথেসিস্ট নামটা চট করে মনে আসে না কিষণের। হবেই না বা কেন? নিজে তো ক- অক্ষর গোমাংস। ছেলেটা তাও ক্লাস এইট অবধি স্কুলে গেছে । বিট্টু ই একদিন বুঝিয়েছে অ্যানাসথেসিস্ট কাকে বলে। গেটটা টেনে বন্ধ করতে করতে কিষণ দেখল ডাক্তারবাবু গাড়ি রেখে আবার ওর দিকে এগিয়ে আসছেন।
” কিষণ, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। ”
”হ্যাঁ সাহেব, বলুন। ”
‘ রবিবার রাতে কিছু গেস্ট আসবেন। তুমি তাদের বলবে বাইরে গাড়ি পার্ক করে ভিতরে আসতে। ”
”ঠিক আছে সাহেব। ”
”আর একটা কথা। সেদিন রাতে তোমার বৌকে রান্না করতে বারণ কোরো। তোমাদের তিনজনের খাবার আমার লোক এসে দিয়ে যাবে তোমার ঘরে। নীলম জয়েন্টে খুব ভালো ব়্যাঙ্ক করেছে। তাই আর কি! ”
”খুব খুশির খবর সাহেব। নীলম বেটি কত বড় হয়ে গেল।এই কদিন আগেও স্কুলবাসে তুলে দিতাম। সবসময় খবর নেয় কেমন আছি। অনেক আশিস রইল সাহেব। ”
তিনপুরুষ কোলকাতায় বাস করা কিষণলাল আজ বারো বছর কাজ করছে এই বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িতে। কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান কিষণ তাই সবার চেনা, হাসিমুখ আর ভালো ব্যবহারের জন্য সবাই পছন্দও করে। বৌ আর ছেলে বিট্টুকে নিয়ে নীচের তলায় সারভেন্টস্ কোয়ার্টারে থাকে।ছোটবেলায় মাঝে মাঝে নীলম বেটি আর ছোটদের দলে খেলা করতে ঢুকেও যেত বিট্টু। বড় মায়ামাখা মুখখানি নীলম বেটির। আগে কত গল্প করত গেটে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে। বলতো বড় হয়ে পরীদের গল্প লিখবে নাকি। তারপর তো বড় হতে থাকল, ব্যস্তও। আজকাল দেখা হলে একটু হেসে চলে যায়, কেমন যেন আনমনা লাগে। দেখো তো! কেমন মস্ত রেজাল্ট করে দেখাল। নিজের এইট পাস ট্যাক্সি ড্রাইভার ছেলে বিট্টুর সঙ্গে তুলনা করে বুকের ভেতর থেকে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ল কিষণ। তখনই দূরে বিট্টুর ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীরটা এগিয়ে আসতে দেখল কিষণ।
”কি হয়েছে বেটা। আজ এত আগে ফিরে এলি। শরীর ঠিক আছে তো? ” – উদ্বেগ মিশে যায় কিষণের স্বরে।
”বাবুজি, আজ জানো কি হয়েছে? ”
”কি রে, অ্যাক্সিডেন্ট করেছিস নাকি? ”
”না না বাবুজি ” , আশ্বস্ত করে বিট্টু। ” স্ট্যান্ডে গাড়ি লাগিয়ে সীটের নীচ থেকে বোতল বের করতে গিয়ে দেখি একটা কালো ব্যাগ পড়ে আছে। যে ট্রিপটা নামিয়ে এলাম সেই লোকটার হাতে দেখেছিলাম ব্যাগটা ।দরকারী হবে ভাবলাম, তাই আবার ফিরে গিয়ে যে বাড়িটার সামনে ড্রপ করেছিলাম সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি ভদ্রলোক এইটুকু সময়ে যেন পাগল হয়ে গেছেন। আমার হাতে ব্যাগটা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেড়ে নিলেন আর চেন খুলে দেখে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। আমি তো হতভম্ব। আসলে ব্যাগে দশ লাখ টাকা ছিল, দেশের জমি বিক্রির। ”
”বেশ করেছিস। ”
” আরে জানো না। স্ট্যান্ডে সবাই আমাকে বোকা বলে কি গালাগালিটাই না করল। আমার নাকি হাবালগ্নে জন্ম। এতগুলো টাকা না দেখেশুনে কেউ ফেরত দেয় নাকি! মাথাটা গরম হয়ে গেছে। ওরা তো জানে না, স্কুল থেকে একবার বন্ধুর পেন্সিল নিয়ে এসেছিলাম বলে তোমার কাছে কি মারটাই না খেয়েছিলাম। ”
হেসে ছেলেকে ঘরে যেতে বলে কিষণলাল।
পরদিন বিট্টু বাড়ি ফিরে জানাল স্ট্যান্ডে খবরের কাগজের অফিস থেকে দুজন লোক এসে ওর ছবি তুলে নিয়ে গেছে, কথা বলেছে।পরের দিনের কাগজে ছাপা হবে ওর সততার কাহিনী। টাকা ফেরত পাওয়া ভদ্রলোকের জামাই খবরের কাগজের অফিসে কাজ করেন, তিনি সঙ্গে এসেছিলেন। খুব খুশি হয় কিষণলাল।
বিকেলে পুলিশের গাড়ি গেটের সামনে দেখে অবাক হয় কিষণলাল। অফিসার গাড়ি থেকে নেমে ডঃ সেনের ফ্ল্যাট কত তলায় জানতে চাওয়ায় যতটা না অবাক হয় তার থেকেও বেশী হাঁ হয়ে যায় আধ ঘন্টা পর সপরিবার সেন সাহেবকে পুলিশের গাড়িতে উঠতে দেখে। মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে না। বড়লোকদের ব্যাপার তার মতো গরীবগুর্বো আদমী কিই বা জানবে।
পরদিন সকালে কিষণলাল যখন খবরের কাগজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল তখন বিট্টুর ছবির পাশেই ডঃ সেনের আর নীলমের মাথা নীচু করা ছবির সঙ্গে যে খবরটা ছাপা হয়েছিল তা দেখে সারা শহর শিউরে উঠল। ডঃ সেন ও তার স্ত্রী নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য টাকা দিয়ে ভুয়ো পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসিয়ে জয়েন্টে ব়্যাঙ্ক হাসিল করেছেন। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও ষড়যন্ত্রে সামিল হতে বাধ্য হয় নীলম। ভুয়ো পরীক্ষার্থীর ব়্যাকেটটি ধরা পড়ায় নীলমদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বিট্টুর হাসিমুখের পাশে মাথা নীচু ডঃ সেনের ছবিটা দেখতে দেখতে জীবনে এই প্রথমবার নিজেকে খুব ধনী মনে হচ্ছিল কিষণলালের।