সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ১১১)

রেকারিং ডেসিমাল

ফিরে আসার আগের দিন সন্ধ্যের মুখে এসে পৌঁছলাম সঙ্কটমোচন মন্দিরে।
রোমাঞ্চিত হয়ে দাঁড়ালাম কতকালের পুরোনো দেউলটির গর্ভগৃহের সামনে।
মাথায় ঘোরে বাবামার মুখে শোনা তুলসীদাসজীর কত গল্প, কত দোঁহা।
এই সেই মন্দির?
এইখানেই পরম ভক্ত মানুষটি থেকেছেন, বসেছেন, গান গেয়ে মাটির পৃথিবীতে টেনে এনেছেন আরাধ্যকে ?
অবাক হয়ে দেখি পুরোনো লোহার জালি কাজ দেওয়া মন্দির। তার প্রতি খাঁজে গুঁজে রাখা আছে শ’য় শ’য় হনুমান চালিশা।
অজস্র মানুষ বসে আছে চাতালে বিগ্রহের সামনে। আরও কত আসছে, আবার উঠে যাচ্ছে, কিন্তু কোন শব্দ নেই।
যে যেমন আসছে একটি চালিশা টেনে নিয়ে বসে যাচ্ছে নিজের মনে পাঠ করতে। মনে মনে।
একটি মৃদু গুঞ্জন যেন ছড়িয়ে থাকছে সারা জায়গাটি জুড়ে, মৌমাছির গুনগুনের মত।
আমি নমো করি ছানাদের সাথে নিয়ে।
প্রাণপণ বলি, সঙ্কটমোচনজী, সবাইকে নিয়ে বাড়িতে ফেরার ব্যবস্থা কোরো।

ঘরে ঢোকার আগে সেদিনের শেষ দ্রষ্টব্য, বি এইচ ইউ, কিনা বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি।
মস্ত ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে গাড়ি।
ভেতরে মাঠের পাশে গাড়ি দাঁড়ায়।
ছেলে আজ ঘুমিয়ে কাদা। তাকে কোলে রেখে বললাম, আমি আর নামবো না।
শ্বাশুড়ি মা, বললেন, আমিও ওদের সঙ্গেই থাকছি।
তাঁর ছেলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে বকা দিল, কুঁড়ে, বেড়াতে এসে বসে থাকা কেন, বলে।
আমার মেয়ে সুড়ুৎ করে নেমে বাবা আর ঠাকুরদার সঙ্গে ইউনিভার্সিটি দেখতে চলল।

আমি বসে রইলাম ছেলেকে কোলে নিয়ে।

খানিকটা সময় পরে, যখন মনে হল এরা তিন জনে নজরের বাইরে চলে গেছে, শ্বাশুড়ি মা, আস্তে আস্তে বললেন, ওরে, আজ আর রাত অবধি অপেক্ষা করতে পারব না। এখুনি ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা করতে পারিস?
এরা জানলে হাউমাউ করবে। সে চলবে না। কাল সারাদিন গঙ্গাপূজা চান শয়ন আরতি দেখা। আমায় আটকালে আমি শুনবো না।

সংকটমোচনকে স্মরণ করে ড্রাইভার দাদাকে ডেকে বললাম, গাড়ি বাহার লেকে চলিয়ে দাওয়াকা দুকান চাহিয়ে। মা জী কো গ্যাস কি দাওয়া খরিদনা হ্যায়।

গেটের বাইরে বেশ খানিক ঘুরে দোকান পাওয়া গেল।
তখন ত আর মোবাইল ফোন ছিলো না।
শ্বাশুড়ি বৌ দুজনেই অস্থির হচ্ছি। পুরুষ মানুষরা এসে গাড়ি না দেখতে পেলে ত হুলস্থুল করবে!

কোন রকমে ভেতরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তারপর ছেলেকে আস্তেধীরে সিটের ওপরে শুইয়ে দিয়ে, শ্বাশুড়ি মায়ের ওপর হাতে ইঞ্জেকশন দিয়ে শান্তি।

কি ভাবে দোকান থেকে চেয়ে আনা স্পিরিট তুলো দিয়ে আধা অন্ধকার মারুতি ভ্যানের সিটে কাঁচের অ্যাম্পুল ভেঙে সেই ইঞ্জেকশন দেয়া হল, সে খালি রোগিণী আর ডাক্তারই জানল।
আর কেউ না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।