সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ১৩)

বেনু মশলাঘর

ইচ্ছে ছিল বাড়ির গেট থেকেই বিদেয় হবে মেহেরবানু, কণার জন্য কেনা বাহারি খোঁপা বাঁধার কাঁটাটা গেটে দাঁড়িয়ে বিউটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়ার মতলব ছিল তার। সেই যে এ বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে সে, এ তল্লাট মাড়ায়নি আর তারপর। কিন্তু কাঁটাটা কেনার পর থেকেই কণাকে সেটা দেয়ার জন‍্য বড্ড আঁকুপাকু করছিল মন। অস্থিরতা ঘিরে ধরছিল আষ্টেপৃষ্টে। ভয়ে এতদিন দাঁত কামড়ে ছিল চুপচাপ।শেষ পযর্ন্ত তবু আসতেই হল। অবাধ‍্য মন বিদ্রোহ করে বসল শেষতক। কণাকে আর তার হাড়-বজ্জাত বাপকে এক নজর না দেখতে পেলে আর চলছিল না তার বেশরম মনটার। তবু ইচ্ছে ছিল বিউটির হাতে কাঁটাটা দিয়ে আড়াল থেকে ছেলে আর নাতনিকে দেখে সরে পড়ার। রায়-বাঘিনী নাতনি কণার সামনে পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না মেহেরবানুর। কিন্তু ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত্রি হয়’ কথাটা সত্যি প্রমাণ করে কণা কোত্থেকে হুট করে রঙ্গমঞ্চে হাজির হল এসে। সবে বিউটির হাতে কাঁটাটা ধরিয়ে দিয়ে নিজে সে গেটের বাইরে মোক্ষম একটা আড়াল খুঁজছে যেখান থেকে বাড়িটার ওপর নজর রাখতে পারবে সে, দেখতে পাবে ছেলে আর নাতনির মুখ, অমনি যমদূতের মতো কণা এসে সামনে দাঁড়াল তার। পাকড়াও করল তাকে বাক্সপেঁটরা সমেত। রায়-বাঘিনীর মতো হুঙ্কার দিয়ে বলল, হারামি বুড়ি! তোমাকে না বলেছিলাম এ বাড়ি থেকে এক পা বাইরে যাবা না! আমি বাড়িতে নেই সেই সুযোগে পালিয়ে গেছ, না? অমনি চম্পট দিছ চুপিচুপি? আজ চলো বাড়িতে। তোমার তেল বের করছি আজ। খুব তেল জমেছে তোমার, না? আজ তোমাকে দেখছি চলো!
মেহেরবানু যত গাঁইগুঁই করে, তত তাকে জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে কণা, যত সে কথার তেলে পিছলে যেতে চায় কণা ততই কথার ছাই ছিটিয়ে ধরাশায়ী করে তাকে। শেষপর্যন্ত কোনো জারিজুরিই ধোপে টিকল না মেহেরবানুর। হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়িতে ঢুকাল কণা। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বলল, হারামি বুড়ি! সুখে থাকতে ভুতে কিলায় তোমার? রাস্তার লোকেদের মুখ না দেখলে ঘুম হয় না রাতে? বজ্জাত বুড়ি কোথাকার! ফের এ বাড়ির বাইরে গেছ তো তোমার একদিন কী আমার একদিন! ঠ‍্যাঙ ভেঙে দেবো একদম, দেখ!
চুপ থাকল মেহেরবানু। বোবার শত্রু নাই, জানে সে। তাছাড়া কণার কথা মিথ্যেও নয়। এ বাড়ির সুখ সত্যিই হজম হয় না তার। বড্ড গা কুটকুট করে। আর স্টেশনের ঐ তেলচিটচিটে বিছানা-বালিশে শুয়ে নানান মানুষের কথার বহুবিচিত্র আওয়াজ ছাড়া, স্টেশনের পরিচিত, অপরিচিত হরেকরকম মুখগুলো ছাড়া বুকের ভেতরটা কেমন হাঁসফাস লাগে তার, শূন্য-শূন‍্য লাগে, ঘুম আসে না মোটে। কিন্তু কণাকে সেসব কথা বলা যায় না। বোঝানোও যায় না। অতঃপর চুপ থাকে মেহেরবানু। বেনু বাড়িতে নেই সম্ভবত। বক্কর আলী কণার তর্জন-গর্জনে একবার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েই আবার গর্তে সেঁধিয়েছে। কণার চিল-চিৎকার বাদ দিলে বাড়িটা অতিরিক্ত নীরব, প্রাণহীন। এত নীরবতা সহ‍্য হয় না মেহেরবানুর। অসহ‍্য ঠেকে। দমবন্ধ লাগে। তার ভুবন বড় বেশি সরব, প্রাণময়। তার ঘুম ভাঙে ট্রেনের কু ঝিকঝিক শব্দের দারুণ ছন্দে, হাজার মানুষের ব‍্যস্ততার গমগমে আওয়াজে। ঘুমায়ও সে সেই একই অভ‍্যস্ততায়। সেখানে বেনু কুটিরের এই নিস্তব্ধতা, এই প্রাণহীনতা বুকের ভেতর কেমন কাঁপন ধরিয়ে দেয় তার, কী এক নাম না জানা অনুভূতি দুলিয়ে দেয় তার বোধের সাঁকো। তার কেবলই মৃত‍্যুকে মনে পড়ে, মনে হয় আযরাঈল বড় কাছে তার, ঘাড়ের কাছে গরম শ্বাস ফেলছে এসে। কিন্তু এসব অনুভূতি বোঝানো সহজ নয় কাউকে। মেহেরবানু তাই সে চেষ্টায় গেল না মিছে। কণার কথা মতো ওপরে উঠল চুপচাপ। কণার নির্দেশ মতো বাথরুমে ঢুকে গোসল করল প্রথমেই। পানি গরম করে এনে বালতিতে ঢেলে পরিমাণমতো ঠান্ডা পানি মিশিয়ে দিল সে-ই। শীতে তবু শরীরে কাঁপন ধরে গেল মেহেরবানুর। আলমারি খুলে কম্বল বের করে দিল কণা। নিজের খাটের বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়ে বলল, নাও, শুয়ে পড়। তোমার খাবার আনছি। ততক্ষণ শুয়ে থাক চুপচাপ। নড়াচড়া করবে না একদম।
চোখ পাকাল কণা। তার আয়ত চোখের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণে হাসল মেহেরবানু। মেহেরবানুর চোখ দুটো অবিকল পেয়েছে কণা। মায়াভরা। সেদিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না সহজে। কণা প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে ফিরল খানিকক্ষণ পরেই। পেছনে জগ, গ্লাশ হাতে বিউটি। মেহেরবানুর হাতে খাবারের প্লেট ধরিয়ে দিয়ে পাশে বসল কণা। কম্বল টেনে নিল বুক পর্যন্ত। বিউটি টেবিলে জগ, গ্লাশ রাখতে রাখতে বলল, তুমি সেদিন না কয়া অম্মা চলে গিচলে ক‍্যা দাদি? চাচি কলাম রাইগে বোম হয়া আচে তুমার উপর। হেনে থাকলি সমস্যা কী হয় তুমার? কোনে কোনে থাইকে বেড়াও, হেনে থাকলি তো আরামে থাকতি পারো। চলে যাও ক‍্যা তুমি?
মেহেরবানু মুখে খাবার নিয়ে একমনে চিবোয়। রা করে না মুখে। খিদে পেয়েছে তার। সেই কোন সকালে কী একটু খেয়েছে, মনেও নেই ভালো। বাজে কথা বলার সময় নেই এখন। মেহেরবানুর মুখের দিকে তাকিয়ে রাগে গা জ্বলে যায় কণার। বুড়ির ভাবগতিক তার ভালো ঠেকে না মোটেই। রাগি গলায় বলে, শয়তান বুড়ি! স্টেশনে নতুন একটা বর জুটাইছে মনে হয়! রাতে সেইব‍্যাটাকে জড়ায়া ঘুমায়, সেইজন‍্য পালায় এইখান থেকে!
মেহেরবানু বিষম খায়, খাবার আটকে যায় গলায়। গ্লাশভর্তি পানি এগিয়ে দেয় বিউটি। খিলখিল হাসে। মেহেরবানুর দশা দেখে হাসি পায় কণারও। কষ্টে হাসি চেপে বিষচোখে মেহেরবানুর দিকে তাকিয়ে থাকে সে। বিউটি তখনও হেসে গড়ায়। হাসতে হাসতে বলে, তাই নাকি, ও দাদি? নতুন বর জুটাইছ? বুড়োটা দেখতে কেমন?
মেহেরবানু ততক্ষণে সামলে উঠেছে। বিউটিকে ধমক দিয়ে বলে, চুপ হর মাগি! বুড়ো বয়াসে বাতার দে হরবো কী লো আমি! তুরা বাতার জুটাগা যা!
ভাতার জুটাও নাই তালি বাড়িত থাহ না ক‍্যা তুমি? পলা চলে যাও ক‍্যা হেনতে? সুখি থাকতি ভুতি কিলেয় তুমার তেয় না? -খেঁকিয়ে ওঠে কণা। মেহেরবানু করুণ চোখে তাকায়। তার ঘোলা চোখে বেনো জল উছলে ওঠে। কান্না আটকে বলে, কেবা থাকপ ও বু? তুমি থাহ না বাড়িত। তুমার মা-বাপ সারাদিন থাহে ফ‍্যাক্টিরিত, বিউটি থাহে কামে। আমি এহ্লা এহ্লা কেবা থাকপ তাই কও! আমার নিঃশ্বেস বন্দ অয়া আসে, মুন কয় কহন যিন দমডা বাড়া যাবিনি।
ও তুমার তালি সঙ্গী লাগবি এহন? খাড়াও, আব্বুক কয়া তুমার সঙ্গীর ব‍্যবস্থা করি। নিকে পড়া দেই আবার! -চোখ পাকিয়ে বলে কণা। বিউটি আবার হাসে খিলখিল। মেহেরবানু ম্লান হাসে। বিড়বিড় করে বলে, মাগিরে খালি বতেলে কতা কয়! আমি মরি আমার জ্বালায়!
কোনো জ্বালা মালা নাই তুমার। এই বাড়িত্তে আর এক পা বাইরে যাবা না তুমি। দরকার হলি ঘরে তালা দিয়ে আটকা থোবো তুমাক। আর শোনো, মা মেলা রাইগে আচে তুমার উপর। মা বাড়িত আইসে চিল্লাচিল্লি করলি কলাম চুপচাপ থাকপা। কোনো কথা কবা না, বোচ্চ? -ধমকায় কণা। ঘাড় নেড়ে সায় দেয় মেহেরবানু। ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে ওঠে ভীষণ। পালা মেহেরবানু! ঝটপট পালা! -ভেতর থেকে তাড়া দেয় কেউ। মেহেরবানু ছটফটিয়ে ওঠে খুব।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।