সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ১৬)

বেনু মশলাঘর

সময়টা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে গ্লোরির। অফিসের ঝামেলা মিটছে না সহজে। টোটনের সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করায় টোটনের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ল শেষে। গ্লোরির মতো শক্ত মেয়ে যখন সমস্যার কথা টোটনকে শেয়ার করে তখন বিষয়টা আর হালকা থাকে না মোটেই। মনোযোগ দিয়ে গ্লোরির সমস্যাটা শুনল টোটন। সেই পুরোনো গীত। একে তো গ্লোরি এখানে আগন্তুক তায় নারী। স্থানীয় নেতা, পাতি নেতারা তাকে ভাঙিয়ে খেতে চায়। দু দিন পরপর তাদের গ্লোরির জন‍্য মন কেঁদে ওঠে, গ্লোরির অফিসে সদলবলে এসে হাজির হয়। তখন তাদের ঘন ঘন চায়ের তেষ্টা পায়। চা পান শেষে ধীরে সুস্থে বিদায়ের এন্তেজাম করে, খানিকটা যাওয়ার পর আবার গ্লোরির প্রেমে গদগদ হয়ে ফিরে, হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে গ্লোরির কাছে আবদার করে মোটা অংকের টাকার। এ নিয়ে অনেকবার মঞ্চস্থ হওয়া নাটকটায় অতিষ্ঠ গ্লোরি। হাঁপিয়ে উঠেছে রীতিমতো। এমন চলতে থাকলে শিগগিরই তল্পিতল্পা গুটাতে হবে তাকে। ব‍্যবসা লাটে উঠতে বেশি দেরি নেই আর। উপায়ন্তর না পেয়ে অগত‍্যা টোটনের সাথে বিষয়টা শেয়ার করল গ্লোরি। সচরাচর নিজের কোনো ব‍্যাপারে টোটনকে জড়ায় না সে, নাক গলায় না টোটনের কোনো ব‍্যাপারেও। কিন্তু এবারের ব‍্যাপারটা ভিন্ন। বিষয়টা সহ‍্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে। চুপচাপ শুনল টোটন। সে নিজে চলে যতটা সম্ভব গা বাঁচিয়ে। বায়ারদের সঙ্গে মালিকপক্ষের যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে নিজের পার্সেন্টেজ ঠিকঠাক পেলেই সে খুশি। নেতা-পাতিনেতা গোণার সময় নেই তার, প্রয়োজনও নেই। কিন্তু এই বিদেশ বিভুঁইয়ে গ্লোরির এমন দুঃসময়ে গা বাঁচিয়ে চলা চলে না, নিতান্তই অমানবিক সেটা। যতই লিভ টুগেদার হোক, যতই থাক দায়হীনতার কথিত সবক, তবু সম্পর্কের একটা দায় থেকেই যায়। গ্লোরির জন্য কিছু একটা করার তাগাদা ভেতর থেকেই পেল টোটন। অনন্তকে একবার বলে দেখলে হয় ‘ কথাটা নিজেই নিজেকে শোনাল টোটন।
ফোনটা হাতে নিয়ে অনন্তর নাম্বারটা বের করল খুঁজে। অনন্ত স্কুল জীবনের বন্ধু, সম্ভবত পুলিশ হেড কোয়ার্টারসে পোস্টিং এখন, জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। যদিও এখনকার নেতা-পাতিনেতারা পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট পকেটে পুরে রাখে, ‘সূর্যের চে বালি গরম’ তরিকায় দেশ চলে আজকাল। অনন্তর মতো জাঁদরেল পুলিশ অফিসারদের ভাত নেই, এদের কাছে তারা নিতান্তই নস‍্যি। তবু ফোন দিল টোটন। বাধ্য হয়েই। রিং হল কয়েকবার। ফোন ধরল না অনন্ত। বিকল্প ভাবতে বসল টোটন। সহসা মাথায় এল না কিছু। তারপর মনে পড়ল। হুট করেই। ডেইজিকে কেন যে মনে পড়েনি এতকাল! অন্তত টোটনের উচিত নয় ডেইজিকে ভুলে যাওয়া। টোটনের রৌদ্রতপ্ত জীবনে ডেইজি ছিল শীতল, ছায়াময় এক টুকরো মেঘ। টোটন না চাইতেই সে ঝরঝর ঝর্ণায় ঝরে পড়ত টোটনের ওপর। ওটাই ভুল ছিল ডেইজির। মানব মন বড় বিচিত্র। সহজলভ‍্যে ভোলে না সে, তার থাকে দুর্লভের তিয়াস, অধরাকে ধরার যাঞ্ছা। টোটন তাই প্রেমে অবনত ডেইজিতে বিতৃষ্ণ ছিল ভীষণ । ডেইজির প্রতি কোনো অনুভূতিই ছিল না তার। তবু ডেইজিকে অন্তত মনে থাকার কথা তার, মনে রাখারও। কিন্তু মন অত সহজ নিয়ম মেনে চলে না কোনোকালে। ডেইজিকে তাই ভুলের মিছিলে ফেলে বেমালুম ভুলে গেছিল সে-ও। ডেইজিও নামি পুলিশ অফিসার এখন। পোস্টিং কোথায় কে জানে! ডেইজিকে মনে পড়তেই ইউনিভার্সিটির দিনগুলো ভেসে উঠল চোখে। থমকাল টোটন। ডেইজিকে ফোন দেয়ার ভাবনাটা মন থেকে সরিয়ে দিল অনায়াসে। ডেইজিকে ফোন দেয়া মানেই হাজার রকম জেরার ছুরিকাঘাতে আহত হওয়া। যেচে ডেইজির মতো রায় বাঘিনী পুলিশ অফিসারের তোপের মুখে পড়ার তার মোটে ইচ্ছে নাই। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর ডেইজি ছুঁলে ছত্রিশ ঘা, তার মানে আঠারো আর ছত্রিশ মিলিয়ে হবে চুয়ান্ন ঘা! থাক বাপু! মাফ চায় টোটন, দোয়াও। ডেইজিকে ফোন করে কাজ নেই আর।
বিফল মনোরথ হয়ে ফোন সরিয়ে রাখল টোটন। গ্লোরির জন্য করা গেল না কিছুই’ -হতোদ‍্যম হয়ে ভাবল। মনটা খারাপ হল খুব। ফোনটা অন্তত ধরতে পারত অনন্ত। টোটনের ভালো বন্ধু ছিল সে। মানুষ যে কত পাল্টায় সময়ের স্রোতে! ভাবনাটা দীর্ঘশ্বাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই টুংটাং বেজে উঠল ফোনটা। ফোনের শব্দ এত মধুর হয়ে কানে বাজে আগে জানা হয়নি টোটনের। তড়িঘড়ি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল টোটন। অনন্ত!
হ‍্যালো! -রিসিভ করল টোটন, ক্ষণমাত্র দেরি না করে।
অনন্তের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল তৎক্ষণাৎ।
হ‍্যালো টোটন!
কুশল বিনিময়ে আর স্বাভাবিক সৌজন্যে চলে গেল অনেকটা সময়। অবশেষে অনন্তকে বিষয়টা বলল টোটন। বলতেই হল। জেরা শুরু করল অনন্তও। শালা! সাধে কি আর বলে, যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ! শেষে কি-না ছেলেবেলার বন্ধুও এমন রাবণ হয়ে উঠল তার!
গ্লোরিকে বিজনেস পার্টনার বলে পরিচয় দিয়ে তবে পার পেল টোটন। পরক্ষণেই মনে হল ভুল করেছে। অনন্ত ছেলেবেলার বন্ধু তার। তার কাছে এত লুকোচুরি না করলেও হতো। সত‍্যিটা বললে এমন বিশেষ কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হতো না তাতে। অনন্ত আধুনিক, উদার। লিভ টুগেদারের মতো নীরিহ একটা ব‍্যাপারে সে অন্তত ডাঙায় তোলা মাছ হয়ে খাবি খেত না অন‍্যদের মতো। আন্তরিকভাবেই কথা বলল অনন্ত। যথাসম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করবে জানাল। সেইসাথে এটাও জানাল যে এসব ব‍্যাপারে পুলিশের ক্ষমতা সামান্যই। এসব পাতিনেতাদের পেছনে এত শক্ত হাত থাকে যে সে হাত ছোঁয়ার সাহসই পুলিশের নেই, ধরা তো বহুদূর!
শুনে থম ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকল টোটন। অনন্ত যেটুকু আশ্বাস দিল তাকে শেষবেলায়, সেটুকুই অন্ধের ষষ্ঠী ভেবে উঠে পড়ল শেষে। সামনের সপ্তায় সাইক্লিং ট‍্যুরে এ বের হবে টোটন। এবারের ট‍‍্যুরে তারা যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে। এখনো অনেক কাজ বাকি। গোছগাছ করতে হবে। কেনাকাটাও করতে হবে ঢের।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।