সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শিল্পী নাজনীন (পর্ব – ৩৩)

বেনু মশলাঘর

বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ আগেই। আকাশের তবু মুখভার। থম ধরে আছে। রাস্তাটা ছায়া ছায়া অন্ধকারে ঢাকা। বৃষ্টিতে ভেজা পথ কাজলকালো। দুপাশের গাছগুলো গাঢ় সবুজ। বৃষ্টির জলে স্নান করে চকচকে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ রেজার অনিত‍্য লাগে সব। বছর দশেক আগের একটা দিন এসে খামচে ধরে স্মৃতির ঝুলি। মনে হয় দশবছর আগের সেই দিনটায় ফিরে গেছে সে মুহূর্তেই। সেদিনও বৃষ্টি ছিল এমন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে এই পথটা ভেজা ছিল সেদিনও। স্বপ্নের মতো রেজার কাছে সবটা ছিল ধোঁয়াশায় ঢাকা। পলির পাশাপাশি হাঁটছিল সে। কেন হাঁটছিল, কতক্ষণ হাঁটছিল সবটাই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল তার। আর যাবেই বা কোথায় তারা? পলিকে কোনো প্রশ্ন করতে একদমই ইচ্ছে করছিল না তার। বরং এই যে পলি হাঁটছিল তার পাশাপাশি, প্রায় গা ঘেঁষে, চোখ বন্ধ করে, নাক টেনে তার শরীরের মিষ্টি গন্ধটুকু নেয়ার চেষ্টা করছিল রেজা। পলিকে পাশে পাওয়ার এই অপার্থির আনন্দটুকু, তাকে অনুভবের এই অসামান্য সুখটুকু সে উপভোগ করতে চাইছিল তাড়িয়ে তাড়িয়ে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির খুব মিহিকণা ছোট অলোকচূর্ণের মতো ঝরে পড়ছিল পলির ময়ূরকণ্ঠী রঙ শাড়ির ভাঁজে, নাকে-মুখে-গলায়-শরীরে। তাকে কোন স্বপ্নলোকের অশরীরী এক নারী করে তুলছিল রেজার চোখে। রেজা মুগ্ধ, মোহগ্রস্থ হয়ে দেখছিল তার সেই অসামান্য মানসকন‍্যাকে। গভীর এক ঘোরে পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে গেছিল সে। বৃষ্টির কণা ঝরে পড়ছিল তারও শরীরে। সেদিকে খেয়ালই ছিল না আর রেজার। সে তখন পাশাপাশি হাঁটতে থাকা পলি নামক অপার্থিব স্বপ্নটুকু কাঙালের মতো শুষে নিতে উদগ্রীব। তবু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। বাস্তবে ছোঁয়া যায় না তাকে। ভেঙে যায়। উবে যায় তার মোহাবেশ। পলিই ভাঙিয়ে দিল স্বপ্নটুকু। রেজাকে চমকে দিয়ে সে নিজের মুঠোয় টেনে নিল রেজার হাত। বুকের কাছে হাতটা রেখে সে বলল, কেন ওভাবে চলে এলি বাড়ি ছেড়ে? অমন বোকামি কেউ করে?
অভিমানে গলার কাছটায় ব‍্যথা জমে উঠল হঠাৎ। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ভীষণ। প্রাণপণে নিজেকে সামলাল রেজা। মনে মনে বলল, ও তুমি বুঝবে না পলি আপা। চোখের সামনে মায়ের তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসারটা যখন অন‍্যের হয়ে যায়, নিজের বাড়িতে নিজেই যখন আশ্রিতের মতো থাকতে হয়, উচ্ছিষ্ট খেতে হয়, নিজের কাছে নিজেকেই যখন মনে হয় জঞ্জাল, তখনকার যন্ত্রণা তোমরা কেউ বুঝবে না। কেউ কখনও বোঝে না।
মুখে কিছুই বলল না রেজা। ম্লান একটু হাসি ফুটিয়ে রাখল শুধু। পলি আবার বলল, কত ভালো ফ‍্যামিলি তোদের, কত নাম-ডাক। সব খুইয়ে ফেললি বোকার মতো। পড়াশোনাটাও করিসনি আর, না রে?
দুদিকে মাথা নাড়ল রেজা। করেনি। হতাশায় মুখে চুকচুক শব্দ করল পলি। রেজার হাতটা শক্ত করে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরল আরো। হাতে নরম স্পর্শ পেল রেজা। ঝিনঝিন করে উঠল শরীর।
আহা। কত ভালো ছাত্র ছিলিস তুই! এভাবে জীবনটা নষ্ট করে দিলি! আমি তোকে কত খুঁজেছি জানিস? কত কেঁদেছি তোর জন্য!
কেঁপে উঠল রেজা। পলি আপা বড় ছিল বয়সে। বছর পাঁচেকের। তবু সেই বয়সেই কী করে রেজার সঙ্গে নিষিদ্ধ গন্দম খাওয়ার আনন্দ এসে জুড়ে বসেছিল তাদের প্রজাপতি মনে ভেবে পেল না সে। মায়ের মৃত্যুর পর সৎ মায়ের অত‍্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ছাড়ার সময় পলির মুখটা যে একবারও মনে পড়েনি তেমন নয়। তবু সেই বয়সে নিজের ভারেই নুয়ে পড়েছিল রেজা। পলিকে কিছু জানানোর কিংবা তার কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর কথা মাথায়ই আসেনি তার। পলি বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছিল বরের সঙ্গে, অনেক পরে শুনেছিল সে। শুনে একটু যে শূন্য লাগেনি বুকের ভেতরটা, একটু যে চুপসে যায়নি মন তেমন নয়। খারাপ লেগেছিল বৈকি। কষ্ট নামক গুবরে পোকায় চষতে চেয়েছিল মনের নরম পলি। সুযোগ দেয়নি রেজা। জীবন সংগ্রামে নেমে তার তখন সর্ষেফুল চোখে। পলি মলিদের নিয়ে হাপিত‍্যেশ করার সময় ছিল না মোটেই। তাই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কষ্টটাকেও উড়িয়ে দিয়েছিল হাওয়ায়। আরো বেশি আঁকড়ে ধরেছিল আলেয়ার উড়ে আসা আঁচল। ভাগ‍্যিস ধরেছিল। নইলে সে কবেই ভেসে যেত মদ আর মেয়ের নেশায়। গাঁজা আর ফেন্সিডিল প্রায় গিলে ফেলেছিল তাকে। আলেয়াই তাকে টেনে তুলেছিল সেই পাঁক থেকে তখন। কিন্তু এতদিন পরে পলি কেন খুঁজে বের করল তাকে? কেনই বা তাকে নিয়ে এত চিন্তা তার! দেশেই বা কবে এল সে? প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর কুটকুট করে কামড়াল রেজার। পাত্তা দিল না তবু। দামি সুগন্ধি মাখা পলির শরীর থেকে উড়ে আসা নেশা ধরানো গন্ধটা নাকে টেনে সে বুঁদ থাকতে চাইল অনন্তকাল। সময়টা যদি কোনোভাবে থামিয়ে দেয়া যেত তবে সে লাগাম টেনে ধরত সময় নামক সেই ক্ষ‍্যাপাটে ঘোড়ার। কিছুতেই তাকে ছুটতে দিত না আর। কিন্তু সময় বয়ে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল সুগন্ধি মাখা পলির নেশা ধরানো শরীর। শরীর? হ‍্যাঁ শরীরই তো। পলি তখন শরীর ছাড়া কিছু নয় আর। কৈশোরের সেই পলি আপা আর নয় সে তখন। সে তখন পরিপূর্ণ এক ক্ষুধার্ত নারী। বরের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় দেশে এসে নিজ গরজে খুঁজে বের করেছিল রেজাকে। তার হাতে ছিল অঢেল টাকা। রেজাকে নিয়ে সে ঘুরল কিছুদিন এ হোটেল সে হোটেল। তারপর বরের সঙ্গে ঝগড়া মিটে গেলে আবার একদিন ফুড়ুত করে উড়াল দিল অস্ট্রেলিয়ার প্লেনে। রেজাকে কিছুই না জানিয়ে। রেজা দুঃখ করেনি মোটেই। জীবনের কাছ থেকে খাওয়া সবগুলো লাথি সে তখন হজম করতে শিখে গেছে হাসিমুখে।
সেদিন এই পথ দিয়ে যেতে যেতে পলি তাকে ভালোবাসার কথা শুনিয়েছিল। পলি আপাকে সেদিন মানবী মনে হয়নি রেজার। অপার্থিব এক নারী যেন সে তখন। রূপকথার রাজ‍্য থেকে এসে যে রেজাকে শুনিয়েছিল অমিয়র গান, ভালোবাসার বাঁশিতে তুলেছিল মোহন সুর। তবু মোহ কাটল। রেজাকে নিয়ে সে এই রাস্তা ধরে হাঁটল অনেকক্ষণ। ঝিরঝিরি বৃষ্টিতে ভিজল দুজন। তারপর রাস্তার লাগোয়া একটা নির্জন বাড়িতে ঢুকে পড়ল হুট করে। বেকুবের মতো পলির দিকে তাকাল রেজা। চোখে প্রশ্ন। পলি মুখে রহস্য টেনে হাসল মৃদু। বলল, এটা বড়কাকার বাড়ি। চিনিস না?
বোকার মতো না বলল রেজা। বৃষ্টিতে ভিজেই গেছে যখন তখন এখানে আর কী কাজ, ভেবে অবাক হলো সে। কাকারা এখানে থাকে না এখন। বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে বহুদিন থেকে। – সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে বলল পলি। কাকারা কোথায় গেছে, কেন গেছে জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করল না রেজার। পলিকে অনুসরণ করে সিঁড়ি টপকাল সে-ও। পলি ততক্ষণে দোতলার বেডরুমের দরজা খুলে ফেলেছে হাট করে। বহুদিন আটকে থাকা ভ‍্যাপসা গন্ধযুক্ত হাওয়া এসে নাকে লাগল তাদের। পলি ডাকল তাকে। এগিয়ে গেল রেজা। অগ্রাহ্য করার কথা মনেই এল না তার। খুব স্বাভাবিক একটা ব‍্যাপারের মতোই উন্মোচিত হলো পলি রেজার কাছে, রেজাও পলির কাছে। ব‍্যাপারটা অমোঘ ছিল বলেই মনে হলো রেজার। মোহ কাটল। কাটল স্বপ্নঘোর।
আজ এতদিন বাদে চেনা এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেদিনটা চোখের সামনে ভেসে উঠল রেজার। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মনে মনে দশ বছর আগে ফিরে গেল সে। মনে হলো পলির শরীরের গন্ধ পাচ্ছে সে নাকে। হাঁটছে গা ঘেঁষে। রাস্তার লাগোয়া সেই বাড়িটা এখনো আছে। আরো নির্জন আর ভুতুড়ে। রেজার ইচ্ছে হলো চুপিচুপি ঢুকে পড়ে বাড়িটাতে। থেমে গেল রেজা। হাঁটার গতি শ্লথ হলো অজান্তেই। হা করে দাঁড়িয়ে থাকল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।