“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় সুবীর মজুমদার

প্রতিশোধ

মহামারির আবহে প্রলয়ঙ্কর ঝড় আসছে। একদিকে ভাইরাসের লকডাউন তার সঙ্গে নতুন যন্ত্রণা। সতর্কতা তুঙ্গে। টিভি কাগজ মোবাইলে মানুষকে জানান হচ্ছে আগাম সতর্কতা। উপকূল অঞ্চলের মানুষদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিক্রম একটা আ্যাপ ডাউনলোড করলো মোবাইলে। প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর ঝড়ের গতি প্রকৃতির আপডেট আসছে। বেলা চারটায় ঝড় হিট করবে। সকালে বিক্রমকে কলকাতায় আসতে হয়েছে। না এলেই নয়। ক্লায়েনটা কিছুতেই অনলাইন পেমেন্ট করবেনা। মানি রিসিভ দিয়ে ক্যাস নিতে তাই ওকে বাধ্য হয়ে যেতে হল। তিনটের মধ্যে বাড়ি ফিরেছে। লকডাউনের মধ্যে ও কিছু শুকনো খাবার কিনে আনল। কারণ রান্নার মাসি হয়ত কাল আসতে পারবেনা। বিক্রমের বাড়ি বেশ বড়। ও একা থাকে। রিনিকার সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে বছর ঘুরতে চলেছে। একা থাকা ওর এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। 
আজ বিক্রম জমিয়ে ড্রিঙ্ক করবে। হানড্রেড পাইপার রাখা আছে। রোস্টেড কাজু আর ফ্রুটস আছে। বেশ চলে যাবে। কয়েকজন বন্ধুকে ও বলেছিল আজ রাতে ওর বাড়িতে থাকার জন্য। সাইক্লোন আর করোনার জন্য কাউকে ওদের বউরা ছাড়েনি। গ্যারেজে গাড়ি ঢোকানো সময়ে ঝড় শুরু হলো। বৃষ্টিটা ঘন্টা দুয়েক আগে থেকে কম বেশি চলছে। বিক্রম জানে ঝড় উঠলে পাওয়ার অফ হয়ে যাবে। যার জন্য দেশলাই মোমবাতী টর্চ সব রেডি রেখেছে। ইনভার্টার কতক্ষণ টানবে তার কোন ঠিক নেই। 
কারেন্ট চলে গেল। দিনের আলো কমে এসেছে। বাইরে প্রলয় শুরু হয়েছে। জানলার কাঁচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রকৃতির দলন। সে নিজেকেই নিজে যেন পিষে দিচ্ছে। একটা টিনের সীট সম্ভবত উড়ে এসে ওর বাড়িতে পড়ল। তবে নিরাপদে থাকার এক অদ্ভূত এক প্রশান্তি আছে। গরম করছে। দক্ষিণ দিকে ছাঁট নেই। জানলার একটা পাল্লা খুলে দেয়। ঘরে হাওয়া ঢুকছে। মোবাইলের নেট ওয়ার্ক চলে গেল। ইনভার্টারে ভোল্তেজ কম। ফ্যান আস্তে ঘুরছে লাইটের উজ্জ্বলতা কম। বারবার মোবইলে হাত চলে যাচ্ছে। ইশাকে ফোন করল। না ফোন যাচ্ছনা। মোবাইলে স্টোর করা কিছু গান চালাল সে। কিন্তু ভাল লাগছেনা। দুই পাত্র নিয়েও ওর মুড আসছেনা। বাইরে প্রবল থেকে প্রবলতর ঝড় এবং বৃষ্টি হচ্ছে।
বিক্রম নিচে নামল। কোথা দিয়ে যে জল ঢুকছে কে জানে। সিঁড়ি মেঝে সব জায়গা ভিজে। রেলিং ধরে নামছে। হাতে টর্চ। বাড়িতে জল ঢুকছে। সিঁড়ির নিচে এক ইঞ্চি জল জমা। আরো বাড়বে। বিক্রমের কপালে চিন্তার ভাঁজ। গ্যারেজে রাখা ইনভার্টার তবে যাবে এবার। ঠিক তাই। আধঘন্টা পরে ইনভার্টার বলে দিল তার কাজ আপাতত শেষ। রাত আটটা নাগাত ঝড়ের প্রকোপ কমে আসল। টর্চটাকে জ্বালিয়ে রাখতে মাঝে মাঝে ঝাঁকাতে হচ্ছে। দেশলাই জ্বলছেনা। কি করে যে ভিজে গেল কেজানে। টর্চ আর মোবাইল শেষ ভরসা। একটু নেশা হয়েছে। বিক্রমের নিরাপদ ভাবটা কেটে যাচ্ছে। ওর গা-টা ভারী ভারী লাগছে। তাই একটা স্ট্রং বানিয়ে খেলো। 
নিকশ অন্ধকারে বিক্রম বসে আছে। টর্চটাও গেছে। ও ভেবে পাচ্ছেনা কোন দিকে তাকাবে। কি চিন্তা করবে সেটার কোন হদিশ নেই। ইশাকে এখন ও বড্ড মিস করছে। বাইরে হালকা হাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই কারণ ওর পাড়াটা এমনিতেই নির্জন। ভাবনার শূন্যতার মধ্যে নির্মলের কথা মনে আসছে বার বার। বিক্রম ওর কথা একদম ভাবেনা। এরকম দূর্বল মিনমিনে মানুযগুলোকে ওর বড্ড অপছন্দ। তবুও মনে আসছে।  
বিক্রম মাথাটা একবার ঝাঁকাল। ভূল শুনছেনাতো? আওয়াজটা আবার হলো। এদিকের জানলা খুললে নীচেটা দেখা যায়। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে ও বুঝলো নেশার একটা মাত্রা সে অতিক্রম করেছে। কিছু দেখা যাচ্ছেনা। শুধু অন্ধকার। কে দরজায় আওয়াজ করল? দুবার বিক্রম বলল, কে? কে? কোন সারা শব্দ নেই। মোবাইলের আলো নীচে পৌঁছলনা। 
এতটা অব্দি ঠিক ছিল। ভাবছিল সিগারেট খেলে লাইটার থাকত। কিন্তু সে সিগারেট খায়না। ওর মনে হচ্ছিল সে প্রস্তর যুগের কোন এক গুহায় রয়েছে। নিরাপদ শব্দটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে ওর থেকে। মোবাইলে আর তিন পারসেন্ট চার্জ আছে। তাই সেটা নিভিয়ে রেখেছে। আবার নীচে থেকে এলো দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ। বিক্রম বিছানায় আধশোয়া। ভাবছে কে ? বিছানা থেকে উঠে সে ব্যালকনিতে গেল। না কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। চারদিক নিস্তব্দ। একটা কুকুরের ডাক পর্যন্ত নেই। শুধু বাতাসে হালকা শোঁ শোঁ  শব্দ। 
নির্মলের কথা এত মনে আসছে কেন? সে মোবাইলের ফোটো এ্যালবাম খুলল। একটা কাগজে লেখা কয়েকটা বাক্য। “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়”। এটা লিখে নির্মল সেটাকে কেটে দিয়েছে। তারপর লিখেছে “বিক্রম বিশ্বাসঘাতক। আমার বাঁচার আর কোন কারণ নেই। রিনিকে ক্ষমা করলাম”। কাগজটা জ্বালিয়ে দেওয়ার আগে রিনিকা এটার ছবি রেখে দিয়েছিল। সেটাকে ও নিজের মোবাইলে রেখে দিয়েছে। মোবাইলে লো ব্যাটারী এলার্ট দিল। আর কয়েক মিনিট, এটাও নিভে যাবে। বিক্রমের মনে হচ্ছে ও আজ খুন হবে। নেশাটা বেশি হয়ে গেছে। গ্লাসটাকে একটু দুরে সরিয়ে দেয়। এবার কিন্তু আর দরজায় শব্দ হলোনা। মনে হচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠে আসছে। জল ভেজা পায়ের শব্দ। বিক্রম আজান্তেই ওর বুকের শব্দ পেলো। ভয় পায়নি তবুও কেন হার্ট বীট বেড়ে গেলো? ল্যান্ডিঙে পায়ের শব্দ থেমেছে। বিক্রম ঘরের দরজা বন্ধ করল। এবার ও বুঝলো ভয় সে পেয়েছে। ঘাম হচ্ছে। আজকাল মানুয বিপদে পড়লে ফোন করে। কাকে সে ফোন করবে? মোবাইলটা একবার জ্বলে উঠে বন্ধ হয়ে গেল। মানে নিভে গেল। জানলার কাঁচ দিয়ে বাইরের আকাশটা কেমন লালচে লাগছে। 
আলমারীটা ঠেলে দরজাটা আটকেছে বিক্রম। প্রচন্ড জোড়ে দরজায় কেউ লাথি মারছে। বিক্রম নিশ্চিত জানে সে নিচের সব দরজ বন্ধ করেছে।  স্পিরিটে ওর বিশ্বাস নেই। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে নির্মল ওকে আজ খুন করবে। ডিফেন্স করার মতো কিছু নেই। মদের বোতলটা হাতে নিয়েছে অস্ত্র হিসাবে। বাতাসে দুর্গন্ধ। মাংস পচা গন্ধ। গা গুলিয়ে বমি আসছে বিক্রমের। মেঝেতে আলমারী ঘষার শব্দ হচ্ছে। একটু একটু করে সরছে আলমারী সমেত দরজা। গন্ধটা আরো প্রকট হল। বিক্রম প্রায় দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে শেষ দরজাটা বাইরে থেকে দেওয়ার চেষ্টা করল। হাত কাঁপছে।  ছিটকিনিটা লাগছেনা। বিক্রম চিৎকার করল। গলা দিয়ে একটুও শব্দ বেড়লনা। এবার ও বলতে চাইল, “হ্যাঁ, আমি বিশ্বাসঘাতক। নির্মল তোর পুরো ব্যাবসা তোর প্রেম সব আমি ছিনিয়ে নিয়েছি”। ঘরের ভেতরে কেউ দাপিয়ে হাঁটছে। বিক্রম নিজের পিঠ দিয়ে চেপে রেখেছে দরজাটাকে। গলায় খুব ব্যাথা করছে। কে যেন চেপে ধরেছে বিক্রমের গলা সাঁড়াসির মতো। জিবে নোনতা তরল। মুখ থেকে রক্ত বেড়োচ্ছে সেটা বিক্রম বুঝতে পারল। 
মারা যাওয়ার আগে বিক্রম চাইছিল একবার নির্মলকে দেখতে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।