সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শ্রীরাজ মিত্র (পর্ব – ১০)

ছায়াপথ, গুঁড়ো ছাই

মনটা ভালো ছিলনা। হঠাৎই ইতিউতি করতে করতে একটা লেখায় চোখ আটকালো।
অর্জুন কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন- “আমি জানতে চাইছি এই মহাযুদ্ধে আমার কি প্রাপ্তি হবে এবং আমি কি হারাচ্ছি?”
কৃষ্ণ প্রত্যুত্তরে বললেন- “এই যুদ্ধে তুমি বলিদান দিতে যাচ্ছো পার্থ । হারানো,প্রাপ্তি এসব কি বৃথা চিন্তা করছো? দান তাকেই বলে যাতে দানী হারায় আর যাচক প্রাপ্তি লাভ করে কিন্তু বলিদান সেটাই হয় যা দানী দেয় আর সমগ্র জগৎ প্রাপ্ত করে। বিনাশ আর নির্মাণের কার্য তো স্বয়ং ঈশ্বর করে থাকেন পার্থ তুমি তো কেবল আজ্ঞাবাহী মাত্র তবে এই সব উত্তর দায়িত্ব কেনো নিজের মস্তকে নিয়ে অহংকার বৃদ্ধি করছো? আমি তোমাকে বলেছিলাম পার্থ -‘যে ব্যক্তি এটা জেনে ফেলে যে স্বয়ং কিছুই করছে না, তারই হস্তে কোনো মহৎ কার্য সাধিত হয়।’ “
কৃষ্ণ চরিত্রটা আমাকে বরাবরই বেশ টানে। একাধারে তিনি যেমন কুরুক্ষেত্রে কূটনীতিজ্ঞ পার্থসখা, সেই তিনিই আবার স্বয়ং প্রেমের দেবতা। মানবতার কল্যানে সত্য প্রতিষ্ঠায় ত্রেতাযুগে এ যুগাবতারের পদার্পন হয় ধরাধামে। কংসের জিঘাংসা থেকে বাঁচতে নিজ পিতা বাসুদেব ও মা দেবকীর আশ্রয় দৈববলে ত্যাগ করে নন্দ যশোদার ঘরে স্হান করে নেন তিনি। গোপ বালকদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলেন কালিয় দমনের মাধ্যমে। গোপ কন্যাদের সাথে প্রেমময় সম্পর্কের কাহিনী ভারতীয় যে কোনো ভাষা সাহিত্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় বিষয়। কৃষ্ণের পূর্বে সাহিত্যে কামের বর্ণনা ছিল, প্রেমের সূচনা তাঁর থেকে।
‘দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন’ করতে গিয়ে দুর্যোধনের আত্মগরিমা আর ছল প্রচেষ্টায় কৌরব আর পান্ডবদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য কৃষ্ণের সৎ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আবশ্যক হয়ে পড়ে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পান্ডব ও কৌরব উভয়েই চেয়েছিল তাঁকে। সে কাহিনীও এক বিনয় আর নম্রতার উদাহরণ। তিনি জানতেন অর্জুন ও দুর্যোধন দুজনেই আসবেন তাঁর কাছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিলেন ঘুম ভেঙে যার মুখ দেখবেন তাঁর দিকে যাবেন সশরীরে। দু’খানা আসন রাখা হয়েছিল, একখানা মাথার কাছে, অন্যটা পায়ের কাছে। দাম্ভিক দুর্যোধন তাঁর শয়নকক্ষে প্রবেশ করে শিয়রের কাছে রাখা আসনে বসে পড়লেন। বিনয়ী অর্জুন বসেছিলেন তাঁর পায়ের কাছে। ঘুম ভেঙে অর্জুনের মুখ দর্শনেই মূলত ঠিক হয়ে গিয়েছিল কুরুক্ষেত্রের জয় পরাজয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আত্মীয়-স্বজন আর গুরুজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারনে অর্জুন অপারগতা প্রকাশ করলে কর্মে প্রবৃত হতে অর্জুনে প্রতি কৃষ্ণের উপদেশই হয়ে উঠল শ্রীমৎভগবতগীতার মূল প্রতিপাদ্য যা আজও মানব কল্যানের অমিয় বানী।
আবার এই কৃষ্ণেরই নাকি আবার ১৬১০৮ জন স্ত্রী! যাদের মধ্যে বৈবাহিকসূত্রে স্ত্রী ছিলেন আটজন এবং বাকি ১৬১০০ জন ছিলেন কংসের কারাগার রক্ষক নরকাসুরের অন্তঃপুর থেকে উদ্ধার হওয়া নারী। তৎকালীন সামাজিক রীতি অনুসারে বন্দী নারীদের সমাজে কোন সম্মান ছিল না এবং নরকাসুরের অধীনে থাকায় তাদের বিবাহের কোন উপায় ছিল না। তাই কৃষ্ণ আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁদের। এদের প্রত্যেককে দেবী লক্ষ্মীর অবতার হিসেবে মনে করা হয়। প্রকৃত পক্ষে সমস্ত নারীকেই লক্ষ্মী দেবীর অংশ হিসেবে কল্পনা করার রেওয়াজ সনাতন ধর্মে।
সনাতন শাস্ত্র অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণ আর বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মীদেবী রাধা নামে মর্ত্যে এসেছিলেন অভিশপ্ত হয়ে।
শ্রীমতী রাধিকার সাথে কৃষ্ণের প্রেম, বিরহ, মিলন বাংলা সাহিত্য বা বাঙালি জীবনেরই শুধু না নানা ভাষা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে প্রতিদিনকার রসঘন জীবনের নৈমিত্তিক কাব্য। কৃষ্ণ-রাধিকার অনুপস্থিতিতে কি আদৌ সৃষ্টি হতো বাংলা সাহিত্য বা পেত এতটা পূর্ণতা ? সে বৈষ্ণব কাব্য থেকে শুরু করে রবীন্দ্র, নজরুল, বাউল বা একবারে আধুনিক সাহিত্যে কোথায় নেই এই কৃষ্ণ-রাধিকা?
আকাশের নীল বর্ণের বিশালতার সাথে মিলিয়ে কৃষ্ণের গাত্রবর্নের শ্যাম রূপ। বিশালতা আর অন্তহীনতার প্রতীক এ নীলাভ বর্ন। আর নীল সে বর্ণের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়েছে মানুষ যুগে যুগে। রবীন্দ্রনাথ যখন “মরন রে তুহু মম শ্যাম সমান” কি কল্পনা করে লিখেছিলেন জানিনা তবে শিহরন টা চিরজাগরুক। কি বিশালতা তাঁর!!
ভাবা যায়, তিনি মানেই কি গভীর পরম বোধ! যুগে যুগে যাঁর সনাতন আশ্রয় মধুবর্ষী, নির্ভর ও নিশ্চিত।
১৫০০ খ্রিস্টাব্দ। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজস্থানের মেরতার কাছাকাছি চকরি গ্রাম। মরুভূমির বিস্তৃত ধু ধু প্রান্তরে চলতে চলতে ক্লান্ত শ্রান্ত এক বৃদ্ধ সাধু হাজির হন চকরি গ্রামে। সারাদিন ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে সাধু আশ্রয় নিলেন যোধপুরের মেরতার শাসক রতন সিং এর বাড়িতে।
রাঠোড় বংশের মেরতা-শাসক রাও দুদার ছোট ছেলে রতন সিং। রাও দুদা আবার রাও যোধার ছেলে – যিনি যোধপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা। বিদায় নেওয়ার কালে সাধুজী তার হাতে তুলে দেন শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি। রতন সিং এর মেয়ে মীরা। সবেমাত্র বয়স তিন হয়েছে তার। পুতুলখেলার এই বয়সে বাবার হাতে কৃষ্ণের মূর্তি দেখে চেয়ে বসে মীরা। রতন সিং জানতেন পুতুলটি এক বিশেষ আশীর্বাদ। তাই ছোট মীরা যথার্থ সম্মান দিতে পারবে কিনা এই ভয়ে মূর্তিটি মীরাকে দিতে নারাজ। এদিকে মূর্তিটি না পাওয়া পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া বন্ধ মীরার। কোনোকিছুতেই মানানো যায় না তাকে। অবশেষে মেয়ের আবদারের কাছে হার মানতেই হল রতন সিংকে।
সারাদিনের খেলার সাথী এই পুতুলটি ছিল মীরার কাছে শ্রীকৃষ্ণের জীবন্ত প্রতিমূর্তি। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে মীরা। একদিন রাজস্থানের পাথুরে রাস্তা দিয়ে বাদ্য বাজিয়ে যাচ্ছিল বিয়ের শোভাযাত্রা। প্রাসাদের জানালা দিয়ে তা দেখে আর চোখের পলক পড়ে না ছোট্ট মীরার। এক দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে আবদার করে বসলো, মা, আমার বর কই? সাত বছরের মেয়ের প্রশ্নের কী জবাব দেবেন ভেবে পেলেন না মা। হাত ধরে নিয়ে গেলেন গিরিধারী কৃষ্ণের বিগ্রহের সামনে। বললেন, এই তো তোমার বর।
তারপর যে কি হল মীরার! কৃষ্ণ প্রেমে এতটাই বুঁদ হলেন যে, কৃষ্ণই হয়ে উঠল তার একমাত্র বন্ধু, প্রেমিক এবং স্বামী। আর এই প্রতিশ্রুতিতে তিনি ছিলেন আমৃত্যু অবিচল।
মীরাবাঈ এর অন্যতম পরিচয় তিনি একজন মরমী বৈষ্ণবী কবি। শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে লিখেছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি ভজন বা ভক্তিগীতি যা আজও ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে কৃষ্ণপ্রেমীদের কণ্ঠে শোনা যায়। যদিও ৫ হাজারের মধ্যে প্রায় ৪০০ গান তার লেখা বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
১৪৯৮ সালে মেরতায় জন্ম নেন মীরাবাঈ। অতি অল্প বয়সেই বাবা মাকে হারান তিনি। বর্ণিত আছে, বাবা রতন সিং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান। অন্যদিকে মাত্র ৭ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে মীরা প্রতিপালিত হন দাদা রাও দুদার আশ্রয়ে। রাও দুদা ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মানুষ। তিনি মীরাকে ধর্ম, রাজনীতির ব্যাপারে পাঠদান করেন। পাশাপাশি গান এবং শিল্পকলায় ও পারদর্শী হয়ে ওঠেন মীরা।
কিশোরী বয়সে পৌঁছানোর আগে ভারতবর্ষের মেয়েরা যেমন মথুরা-বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের উপাখ্যান সম্পর্কে জেনে যায়, মীরাও হয়তো জেনেছিলেন। কিন্তু এত নির্ভর আসক্ত পূর্বরাগের জারণ পরিলক্ষণ কোথায়? কৃষ্ণ প্রেমে পাগল হওয়া মীরার কথা ভেবেই নজরুল হয়তো লিখেছিলেন-
“ওরে নীল যমুনার জল, বলরে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম…”
ভাবা যায়?! এক কিশোরীর কি আত্মসমর্পণ! মীরা যতই বলেন যে, তার স্বামী কৃষ্ণ, তার অভিভাবকেরা এই পাগলামি মেনে নিতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। শুরু হল বিয়ের আয়োজন। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে মেবারের যুবরাজ ভোজরাজের সাথে বিয়ে হয় এবং বিয়ের পর তিনি চিতোর প্রাসাদে তার স্বামী এবং নতুন পরিবারের সাথে বসবাসের জন্য চলে যান। কিন্তু তার মতে, শ্রীকৃষ্ণই তার একমাত্র স্বামী। তাই বিয়ের পরও পার্থিব সকল বিষয় থেকে নিজেকে আলাদা রাখলেন মীরা। চিতোরের যুবরাজের সাথে বিয়ে তার সামাজিক মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দিলেও প্রাসাদের রাজ আভিজাত্য কখনোই আকর্ষণ করেনি তাকে। কৃষ্ণই তাঁর ধ্যান, জ্ঞান। বিভ্রান্ত ভোজরাজ বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। শুরুতে তিনি মীরাকে পার্থিব জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। শীঘ্রই তিনি মীরার এই গভীর প্রণয় বুঝতে পেরেছিলেন। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব এবং পারস্পারিক শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাঁদের সম্পর্ক। পরবর্তীতে তিনিই মীরাকে উৎসাহিত করেন কবিতা লিখতে এবং তার উপাসনার জন্য মন্দিরও বানিয়ে দিয়েছিলেন।
মীরার খ্যাতির পাশাপাশি তার রচনা করা ভজনগীতি সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর প্রতিভা খ্যাতি এবং আধ্যাত্মিকতা লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে মোঘল সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছায়। সম্রাট আকবর যেহেতু বিভিন্ন ধর্মীয় পথ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, তাই তিনি মীরাবাঈ এর সাথে সাক্ষাতের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। কিন্তু সমস্যা হলো আকবর এবং মীরার পরিবার একে অপরের প্রতিপক্ষ এবং দীর্ঘদিনের চলা যুদ্ধে উভয়পক্ষের অনেকেই মারা গেছে। কিন্তু কোনো প্রতিবন্ধকতা সম্রাট আকবরকে তার উদ্দেশ্য থেকে হটাতে পারেনি। ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে তানসেনকে সাথে নিয়ে হাজির হন মীরার কাছে। আকবর তার প্রাণবন্ত সঙ্গীত এবং ভক্তিমূলক গানে এতটাই আসক্ত হয়েছিলেন যে, ফিরে যাওয়ার সময় মীরার চরণে তার পরিহিত মূল্যবান গলার মালা উৎসর্গ করে যান।
যদিও তাঁদের সাক্ষাতের ব্যাপার নিয়ে বিভিন্ন ইতিহাসবিদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ নিয়ে বাংলায় যাত্রালক্ষ্মী বীণা দাশগুপ্তের অভিনয়ে মীরার বঁধুয়া যাত্রাটি বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
একসময় ভোজরাজের কানে আকবর এবং মীরার সাক্ষাতের ঘটনা পৌঁছালে তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যে, মীরাকে জলে ডুবে আত্মাহুতি দেওয়ার নির্দেশ দেন। মীরা স্বামীর আদেশ পালন করতে যখন জলে ঝাঁপ দিতে যাবেন,তখনই কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে এবং তিনি মীরাকে নির্দেশ দেন বৃন্দাবনে চলে যেতে। মীরা তখন তার অনুগামীদের নিয়ে বৃন্দাবনে গিয়ে কৃষ্ণের উপাসনায় মগ্ন হলেন। শীঘ্রই ভোজরাজ ভুল বুঝতে পারেন এবং অনুতপ্ত হয়ে ওঠেন। বুঝতে পারেন, তার স্ত্রী প্রকৃতপক্ষে একজন সাধ্বী এবং তাঁকে ফিরিয়ে আনতে বৃন্দাবন যান এবং মীরাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করেন। মীরাবাই সম্মত হলেও ভোজরাজের পরিবার কিছুতেই তা মেনে নিতে পারে নি।
দুর্ভাগ্যবশত, ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে এক যুদ্ধে মারা যান ভোজরাজ। এই মৃত্যুর প্রভাব মীরার উপর ছিল অত্যন্ত গভীর। তিনি শুধু একজন বন্ধু নয়, হারিয়েছিলেন তার পরামর্শদাতা এবং একজন অভিভাবককে, যিনি সকল সমালোচনা নিন্দা থেকে মীরাকে রক্ষা করেছিলেন। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর মীরা আধ্যাত্মিক চর্চায় আরো বেশি নিজেকে উৎসর্গ করতে শুরু করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্দিরে গান গাইতেন এবং সেই গান শোনার জন্য দূরদূরান্ত থেকে আসতে শুরু করে। রাজবংশের হয়েও মীরার এ ধরনের আচরণ ভোজরাজের পরিবার মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু কোনো কিছুই মীরাকে কৃষ্ণের উপাসনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। কৃষ্ণ প্রেমে পাগল মীরার জন্য পার্থিব জীবন ছিল নেহায়েত মূল্যহীন।
পরিবারের সাথে সম্পর্ক আরো খারাপ হতে থাকে তখন শ্বশুর রানা সংগ্রাম সিং মীরাকে আদেশ দেন স্বামীর পাশাপাশি মীরাকেও যেন সতীদাহ করা হয়। কিন্তু মীরা জবাব দেন তাঁকে কেউ সতীদাহে বাধ্য করতে পারেনা। তিনি গেয়ে যাবেন গিরধর শ্রীকৃষ্ণের গান। তাঁর অন্তর জুড়ে আছে কেবল গিরধর শ্রীকৃষ্ণ। তিনিই তাঁর স্বামী। এর পরিণামে যা হলো মীরার উপর অত্যাচার বহুগুণে বেড়ে যায়। কিন্তু যতই অত্যাচার করা হোক না কেন তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত। কোনো কিছুই শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাঁর যে গভীর সম্পর্ক, প্রেম তা বিনষ্ট করতে পারেনি। সব কিছুতে ব্যর্থ হয়ে ভোজরাজের পরিবার মীরাকে হত্যার জন্য আরও দুবার হত্যার অপচেষ্টা চালায়। একবার ফুলের সাজিতে বিষাক্ত সাপ এবং আরেকবার খাবারে বিষ মিশিয়ে তাকে মারার চেষ্টা করা হলেও মীরার বিশ্বাসে কৃষ্ণের কৃপায় উভয় যাত্রায় তিনি রক্ষা পেয়েছেন।

শাশুড়ি আর দেবরের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মীরা প্রাসাদ ত্যাগ করলেন। ষোড়শ শতকে ভারতবর্ষের পথে ঘাটে দেখা যায় এক পাগলিনী সন্ন্যাসীকে যার কণ্ঠে শুধুই কৃষ্ণের গান। মীরা মথুরা গেলেন, গেলেন বৃন্দাবনে। কৃষ্ণ প্রেমে রচনা করলেন হাজার হাজার গান। কৃষ্ণ প্রেমে নারী পুরুষ সেই গান শুনে হয় মুগ্ধ।

“প্রেমের আগুনে জ্বলে জ্বলে আমি ব্যথা নিয়ে ঘুরে বেড়াই, আমার ব্যথা যে কমে না, আমার শ্যাম যে আসে না।”
রাজকুমারী হয়ে জন্ম নিলেও মীরা আত্মার শান্তি খুঁজে পান বৃন্দাবনের রাস্তায়। সকল যন্ত্রণা সমালোচনার ঊর্ধ্বে মীরা কেবল তাঁর শ্যামকেই ভালোবেসেছেন। তাঁর জীবন ভক্তিরসের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
মীরাবাঈ দেখিয়েছেন যে, কেবলমাত্র প্রেমের মাধ্যমেই একজন সাধক ঈশ্বরের সাথে মিলিত হতে পারেন। রাজপুত এই নারী বরং শিখিয়েছেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। কৃষ্ণপ্রেমে বিলীন হতে প্রাসাদের বিলাসিতা বিনা দ্বিধায় ত্যাগ করেছেন তিনি। যিনি ঘোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের মতো করে কাটিয়েছেন সারা জীবন, আজ থেকে পাঁচশো বছর আগেও।

ক্রমশ

(কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়ের জাত্যাভিমানে আঘাত বা আরোপ- এ লেখনীর বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য নয়। যে কোনো প্রকার সাযুজ্য আকস্মিক কিংবা দৃশ্যপট নির্মাণে সংবন্ধিত।)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।