সাপ্তাহিক উপন্যাসে সপ্তর্ষি মণ্ডল (পর্ব – ১৬)

অজ্ঞাত

৪৬।।
ট্রেন ছুটে চলেছে নিজের গতিতে । সামনে মা বসে আছে তার , তবু সন্দীপনের মন যেন হারিয়ে যাচ্ছে বারবার সেই পুরোনো ফেলে আসা রসালো দিনগুলোতে । মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অপ্রাপ্তি লেগেই আছে তার , কিছুতেই স্থির রাখা যাচ্ছে না । একবার উঠছে , কিছুক্ষন পায়চারি সেরে এসে আবার বসে পড়ছে নিজের আস্তানায় । দেখতে দেখতে রাত নেমে এলে অতৃপ্ত হৃদয় , এক ফোঁটা তৃপ্তির তৃষ্ণায় মোবাইল ঘোরালো চেনা সেই সত্যের ঠিকানায় । একবার , দুবার , তিনবার এভাবেই দশবার কেটে গেলেও ফোনের ওপাশ থেকে কোন শব্দ এলো না ভেসে আর । উদ্বিগ্ন মনে সামনের টেবিলে মোবাইলটা নামিয়ে রাখলো সে ।
মা অনেকক্ষন ধরেই সব দেখে চলেছিল আধ খোলা চোখে । এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ,
—- বাবাই ! কি হয়েছে রে ? বেশ অস্থির মনে হচ্ছে তোকে ।
মায়ের ডাকে ছুটে চলা ট্রেনটির মতোই , তার মন ব্রেক কষলো এবার । কি উত্তর দেবে কিছু স্থির না করতে পেরে সে বলে উঠলো ,
—- কিছু নয় তো ! কি হবে ….
ইতিমধ্যে গতি আবার আগের মাত্রায় ফিরে এলে , ট্রেনটি এগিয়ে চললো ঠিকই , নিজের খেয়ালে আর তার মন , বেসামাল হয়ে ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল আজ । সাধের এপেলটি টেবিল থেকে পড়ে ভেঙে গেল যেমন , তেমনই রাত বারোটা পেরিয়ে গেলেও ভাঙা ফোনটিতে কোন ফোন এলো না আজ ।
—- তাহলে কি সব শেষ ! এই শেষের ছবিই কি ভেসে উঠলো আজ মোবাইলের ভগ্ন চেহারায় !
এমনই ভাবনা চোখে নিয়ে সে রাত কেটে গেল তার । ভোর বেলায় ছোট্ট করে একটি ম্যাসেজ পাঠালেও , উত্তর এলো সেই দুপুরের পর , কারন ছ ঘন্টা এ পথে শুধুই জঙ্গল ; মানুষ , নেটওয়ার্ক , কিছুরই দেখা মেলা ভার আর এ অজ্ঞাতবাস কাটতে হয়ে যায় প্রায় দুপুর এগারোটা । আর কিছুটা গেলেই কাটনি …
দুপুরে নেটওয়ার্ক আসার পর সন্দীপন ম্যাসেজ চেক করলে দেখে উত্তর এসেছে —
ওপরে জ্বলজ্বল করছে তার লেখা ….
“তোমার সাথে হয়তো কোনদিন দেখা হবে না আমার , তুমি হয়তো কোনদিন জানবে না আমার পরিচয়
হয়তো কোনদিন এ ঠোট বলবে না ভালোবাসার তিন অক্ষর তোমায় । উৎসর্গ হয়ে মরে যাবে কবিতা আমার ,
তোমার অপেক্ষায় ।
তুমি অন্যের হাতে তুলে দিয়েছ নিজের হৃদয় —
কোন অধিকারে আর বলা যায়
বিশ্বাস আমার তবু পথ চেয়ে থাকে
যদি কোনদিন তোমায় ফিরিয়ে আনে এপথে সময় ।
তুমি বিজয়ী ; তুমি চেষ্টা ; তুমি নতুন কিশলয়
গোপনে রেখে সখী , ভালোবাসাবাসি ; কথা বলি রাতভোর ।
তুমি বোঝনা কি সব ? হয়তো বুঝেও বলোনা
হয়তো পরীক্ষা নিচ্ছিলে আমার , এ মহা বিশ্ব সভাঘর
হয়তো আমি তোমার যোগ্য নয় ।
ভয় হয় জানো । যদি সব ভেঙে হারিয়ে যাও কোনদিন ।
ব্যাপ্ত নীল আকাশ কবেই দিয়েছি তোমায়
এ কবিতা তোমার জন্য । বন্দি করো তোমার বাহুডোরে আমায় । ভেসে যেতে চাই তোমার এলোকেশে ,
শ্রেষ্ঠ বন্ধু হয়ে জীবনের গতিপথে ….. সুখ যত তোমার হোক , দুঃখগুলো দিও আমায় …..
সখী , একদিন এসো রূপসীর কোলে
মিলন হোক , একবার , ঘন বাঘমুন্ডির জঙ্গলে
চলো উড়ে যায় দুজনে , কাঁসাই এর ওপারে
সিঁদুর ওই মেঘ চলো লেপে দিই কপালে তোমার ।
আর তো ভয় নেই । তোমার রাত জাগবে এখন আমার পাশে আজীবনকাল ।
কাঞ্চি …. ও কাঞ্চি …
ব্যাপ্ত নীল আকাশ কবেই দিয়েছি তোমায়
এ কবিতা তোমার জন্য । বন্দি করো তোমার বাহুডোরে আমায় ” ।
আর নিচে উত্তরে আসা …
” রাধার পালে লেগে যায় হাওয়া
কৃষ্ণ দোলে বাঁশির ডালে
মন কেমনের দিনগুলো তার
কৃষ্ণের কথা বড্ড মনে ধরে ।
নিজের সাথে কাটে না সময়
উত্থলা মন কানহার ছবি আঁকে
রাধা পারে নি , হেরে গেছে
নীল যমুনা আজও আছে
শুধু কৃষ্ণের সুর ওঠে না বাঁশিতে আর ।
দুচোখের জলে এমন কতই হারিয়ে যায়
বালুকাচর ফাঁকা হয়ে এলে মনে হয়
সেদিন কেষ্টর সাথে পারি নি কেন পাড়ি দিতে
খুঁজে নিতে সুখের আশ্রয় , তিন অক্ষরের মায়াখেলায় জড়িয়ে ” ।
এদিকে গতি কমে আসে ধিরে ধিরে । কাটনি স্টেশনে এখন আধা ঘন্টার বিরাম ।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।