ডাক্তার বড় হয় মৃতদেহ ঘাঁটতে ঘাঁটতে। তারপর হাতের ওপর চোখের সামনে মৃত্যু দেখতে দেখতে।
হাসপাতালের মৃত্যু অন্যরকম।
বাড়িতে মৃত্যু ডাক্তার এর আগে দেখেনি।
নাতবউ শ্বাসকষ্টটা দেখে চিনল। এটা তার পুরোনো পড়াশোনার পাতা।
দিদা রওনা হচ্ছেন।
মায়েরা বাড়িতে বলতেন, মহাশ্বাস।
হৃদযন্ত্র আর ফুসফুস দুইই জবাব দেবার চিহ্ন এই টিপিক্যাল শ্বাসের ধরন।
ছোট ডাক্তার অবাক হয়ে দেখে মাতৃশক্তির কি মহিমা।
এত কষ্টের মধ্যেও বুড়ো কর্তাকে আটকাচ্ছেন মা।
দাঁড়াও অখনই ডাইক্যো না। খাইসে কি ছেলেরা? খাওয়া না হইতে ডাক দিও না।
বড় ছেলের ঘরে সবার খাওয়া শেষ। বড় ঘরের মস্ত খাটে মশারি টাঙানো হয়ে গেছে। খাটের বাইরের দিকে বাবার বালিশ। তারপরে মেয়ের খুদে বালিশ কোল বালিশ, ছোট্ট লেপু। তার অন্যপাশে মায়ের জায়গা। রাজকুমারী বাবা মায়ের মাঝখানটিতে আল্লাদে শোন। শোন বটে কিন্তু ঘুমোন না। দুহাজার দুশোটা গান গাইতে গাইতে বাবার মুখে ব্যথা, মা নিজে ঘুমিয়ে পড়েন, কিন্তু রাজকন্যে প্যাট প্যাট করে চেয়ে থাকেন। তাঁর ঘুম অনেক সাধ্যসাধনার বস্তু।
তবে ইদানীং রাজকন্যার প্রোমোশন হয়েছে। তিনি দিদি হয়ে আরও গম্ভীর হবার সুযোগ পেয়েছেন। আর তাতে বাড়ির লোকেরা আরও তটস্থ হয়ে আছেন।
মায়ের কোলের কাছে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে অয়েলক্লথ। খুদে বিছানা। মাংকি টুপি, উলের ছোট ছোট মোজা, ফ্ল্যানেলের জামা পরা দিদির ভাইয়ু শুয়ে আছে।
সে ঘুমোতে ভালো বাসে। মায়ের হাতের ওপরে বালিশ ছাড়াই এক ঘুম সারা হয়ে যায় খেতে খেতে। তার সবে এক মাস চোদ্দ দিন বয়েস।
নতুন মা মশারির মধ্যে থেকে কান খাড়া করে।
কর্তাকে বলে, শুনছ, দিদার কিন্তু শরীর খারাপ।
তাদের পাশের ঘরে সেজকাকুদের ও খাওয়া শেষ। বিছানা করার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
দিদা দাদুকে বলছেন, নীচে ছোট ছেলেদের খাওয়া হলো কি না দেখে তবে ডাক দিতে।
বলছেন, নইলে আর খাওয়া হবে না। দাঁড়াও।
এবার শ্বাশুড়ি এলেন এ ঘরে। বউকে চিন্তিত মুখে বললেন, যা দেখত গিয়ে। ছেলে আমার কোলে দিয়ে যা।
মেয়েকে শুয়ে থাকতে বলে বাবা মা চটপট বেরিয়ে আসে মশারি তুলে।
দাদু দিদার ঘরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেখানে সেজ কাকু, বাড়ির দুই ছোট খুকি, এসে হাজির।
দিদা হাঁফাতে হাঁফাতে বলছেন, অস্থির কইরো না। আর কত? দেয়াল থিকা মা কালির ছবিখান আমারে আইন্যা দাও।
দেয়ালে চুমকি জরি দিয়ে সাজানো কালিঘাটের মা কালির ছবি ছিল একখানা কাঁচ দিয়ে ফ্রেমে বাঁধানো।
কে যেন নামিয়ে এনে দিল দিদার কাছে।
ততক্ষণে ফোনে খবর পেয়ে সামনের বাড়ি থেকে সেজপিসি আর তাঁর ছোট ছেলে এসে উপস্থিত।
সেজ পিসি সরবিট্রেট আর শ্বাসকষ্ট হলে দেবার ট্যাবলেট এক সাথে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন জল দিয়ে। দিদা হাত নেড়ে বললেন, পারছি না।
পিসি ঘরের ছোট হামানদিস্তা দিয়ে ট্যাবলেট গুঁড়ো করে চামচে করে খাওয়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বললেন, অক্সিজেন লাগবে ত।
নাতবউ দিদার নাড়ি ধরে বসে আছে, পাশে রাখা ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র।
তার পারদ নেমে যাচ্ছে চড়চড় করে।
ডাক্তার আঙুলের ডগা টের পাচ্ছে এসে গেছে মৃত্যু। টান দিয়ে দিয়েছে মানুষটির ওপরে। আর ফেরানো যাবে না।
দুই নাতি রাতে খোলা থাকা ওষুধের দোকান হাজরা মোড়ের কাছ থেকে স্কুটারে করে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে চলে এল দৌড়ে।
নাতবউ দ্রুত হাতে অক্সিজেন লাগাতে লাগাতে ভাবে, বিয়ের আগে একবার আই সি সি ইউ থেকে ফেরত ত এসেছিলেন। এবারেও যদি…।
রোগিনী ডাক দেন শ্বাসের ফাঁকে।
কই কোথায় গেলে।
সবাই বোঝে দাদুকে ডাকছেন।
দাদু পাশে এসে দাঁড়ালে, গিন্নী বলেন, প্রণাম করি, এই মেয়ে পায়ের ধুলো একটু মাথায় দে দিকি।
বুঝলে, চললাম।
হাউ মাউ করে ওঠে ঘরভর্তি লোক।
কি সব বলছ!!
ছোটছেলে বউ এসে গেছে একতলা থেকে।
ছেলে মেয়েরা ঠিক করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।
এমবুলান্সের ফোন নাম্বার খোঁজে সবাই।
দাদু বড় নাতি আর নাত বউকে নিয়ে সামনের বসার ঘরের সোফায় বসেন গিয়ে।
নাতবউকে বলেন।
একে আর টানাহ্যাঁচড়া করতে ইচ্ছে নাই। তুমি যে টুকু পারো দ্যাখো। ভাইদের বলো আমি নিয়ে যেতে বারন করছি।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কর্তা ঠেলে নিজেদের শোবার ঘরে ঢোকায় বউকে।
মশারির মধ্যে যাও।
ছেলেকে কোলে দিয়ে শ্বাশুড়ি দৌড়ে যান তাঁর শ্বাশুড়ির কাছে।
বর বলে, খবরদার এ ঘর থেকে আর বেরবে না। তোমাকে দেখলেই দাদু দিদা বলবে, এই ত আর হাসপাতালে নিয়ে লাভ হবে না বলেছে সোনালি, আর টানাটানি করো না। আর তারপর কিছু হলে, সারা জীবন ছেলেমেয়েরা গালি দেবে। বলবে হাসপাতালে নিয়ে গেলে প্রতি বারের মত ঠিক হয়ে যেত, তোমার জন্যে মরে গেল।
নামবে না খাট থেকে।
সকলের গলার আওয়াজ, হইচই, কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে নামানোর তোড়জোড় ছাপিয়ে কানে আসে কোলাপ্সিবল গেটের কাছ থেকে বৃদ্ধ মানুষটির মিষ্টি গলার ডাক, সোনালি কোথায় গেল ? সোনালি? আরে কইতাসি হাসপাতালে দরকার নাই। আমার শেষ সখ নাতির ঘরের পুতি, দেইখ্যা লইসি। সকলে পাশাপাশি দাঁড়াইসো বাপের, এইবার যাইতে দাও। ও সোনালি..
কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসেছিল খবর।
হাসপাতাল অবধি পৌঁছাতে পারেনি গাড়ি।
ফিরিয়ে এনে ঘরের খাটে ফুল দিয়ে সাজিয়েছিল সুন্দর মানুষটিকে।
ফুলের স্তুপ, সিঁদুর আলতার ছড়াছড়ি। আত্মীয় বন্ধু পাড়ার মানুষ ভেঙে পড়ছিল বাড়িতে।
প্রায় একশো ছোঁয়া স্বামীকে রেখে, সব সন্তানদের সুস্থ স্বচ্ছল রেখে চলে যাওয়া গৃহিনীকে হিংসে করছিলেন বয়স্করা।
ডাক্তার বুঝেছিল, এই হল সজ্ঞানে যাওয়া। সত্যিই শেষ মূহুর্ত অবধি পরিস্কার জ্ঞান থেকে ছিল মানুষটির।
অনেক গলার ডাক ভেসে বেড়ায় আজকের বুড়ো ডাক্তারের কানে।
দিদার ডাক। একতলা থেকে ছোট কাকুর দরাজ গলার ডাক্ন,সোনালি মেয়ে কাঁদছে শিগগির দ্যাখো। দাদূর হুংকার। কাকিদের কলকল।
সোনালি বলে ডাক দেয়া গলাদের কত জনই হারিয়ে গেল যে।
মাথার সিন্দুকে আওয়াজেরা ভেসে বেড়ায়। আর সিনেমার মত সরে সরে যায় ছবিরা।
কত মুখ। কত মুহূর্ত। কত রঙ।