ক্যাফে ধারাবাহিকে শিবদেব মিত্র (পর্ব – ১)

রোজ ওঠে রোদ

অর্থাৎ রোজকার গল্প

 

( ১)

লেখাটা শেষ হবেনা জেনেই এই লেখাটা লিখছি! এটা বলার মানে কি? দুর্, এ তো বলার জন্য বলা! কিছু একটা দিয়ে তো শুরু করতে হয় – তাই! পাশ থেকে আমি বলে মানুষটা বলে ওঠে – না হে গুরু, ব্যাপারটাকে এত লঘু করে দেখার কোনো মানেই নেই। এটা তো এমনও হতে পারে, গল্পলেখক লঘু রসিকতার বশে দায়স্বীকার করে নিয়েছেন, পৌঁছতে না পারার! কিংবা হৃদয়ের দোলাচল স্পষ্ট করেছেন প্রথম লাইনেই।

 

আমরা যারা এ লেখাটা গড়ে উঠতে দেখছি – তারা জানি, এসব আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। সবই আলস্য ও তার থেকে পরিত্রানের উপায় বৈ আর কিছুই নয়।

অবশেষে পাঁচটা ঊনষাটে, সম্পাদকের ফোন! ডেড লাইন- শুক্কুরবার, বেলা বারোটা। এখন শনিবার। সন্ধ্যা আগতপ্রায়। সব আসে, তবু লেখা আসেনা। তাই থেমে যেতে হয়। কিন্তু অক্ষরে ফিরে যাওয়ার তীব্র প্রেষণা এখনও আমায় কেমন যেন পিছুডাক দেয়…

অক্ষরের সাথে অক্ষর জুড়ি। এই আমার কাজ। বা বেঁচে থাকা। কিন্তু এ কথা কি সত্য? আমি জিজ্ঞাসা করে। একসময় ভাব ছিল, ভাবনায় কমতি ছিলনা। খুব সহজেই ভাবনাদের ভাষা করে যেত। এটা আমরা জানতাম। তবে কি, এখন গল্প লেখক নির্ভাবনায় দিন কাটান? আমি আবার প্রশ্ন তোলে।

আমরা বুঝতে পারি ভাবনা ভাষা নয়। ভাবনার মধ্যে বেঁচে থাকা ভাবটাই ভাষার জন্ম দেয়। গল্পটা লিখতে লিখতে গল্পলেখকের অনুসিক্তা গোপের কথা মনে পড়ে। না অনুসিক্তা গোপ -গল্প লেখকের প্রেমিকা নয়! তবে অনুপ্রেরণা!

হাতে পয়সা থাকলে এ লেখা লেখার কোনো ইচ্ছা থাকতনা। অনুসিক্তা গোপ বন্ধুত্বের ছলে আমার মানিপার্সটা চুরি করে নিয়েছে। এমন ঘটনা এর আগে কখনও হয়নি। আমাদের কাছে অনেকগুলো প্রমান থাকলেও আমরা তাকে চোর বলতে চাইনি। বরং খোয়াই বন্ধু নাম দিয়েছি তার এবং সঙ্গ করেছি পরিত্যাগ…

এত বাজে লেখা, এর আগে কখনও লিখিনি। না এমন করে লেখা ঠিক নয়। কারণ, আর পাঁচজনের মতো আমিও বিশ্বাস করি, একটা উচ্চ তারে পৌঁছনোর দায় শিল্পের থাকা উচিৎ! আমি বলে মানুষটা আবার প্রশ্ন করে! কিন্তু সে দায়ের জোয়ালই বা শিল্পের কাঁধে কে রেখেছে, গল্পলেখক?

*

এটা গল্প হতে পারে অথবা সত্য – তা সে যাই হোক, তা নির্ঘাৎ এক আত্ম-আলাপনী গোছের! নিজের কাছে নিজের কথা বলা…! বা, নিজের সাথে নিজের কথা বলা!

একটা মানুষ – যে শুধু নিজের মধ্যে ডুবছে বারবার! আবার ডুবছে, আবার উঠছে! আবার, আবার, আবার! পৌনঃপুণিক। যেমন করে রোজ ওঠে রোদ পড়েও যায়! কিংবা একে বলাও যায়… যেমন করে ব্যথার দাগে কালশিটে পড়ে মন-জিনিসে নিত্যনতুন! হয়তো কেন, এটাই আমি! দৃশ্যত।

লাইফ তো না, পুরা জিঙ্গালালা! হোঁচট খেয়ে হাঁটছে যেন সিদ্ধ-স্বামী হাটনগর! বন্ধু্লোকেরা কেউবা মস্করা করে বলে- বলিস তো চাঁদা তুলে একটা কমণ্ডলু কিনে দিই…! যাই বল্ , তাই বল্ – তোর মধ্যে সেই একটা বাবাজী বাবাজী ফিলিংস আছে। পসচার-গেসচার-লুক… অ্যাট এভরি হয়্যার…! হেথায় তোরে মানাইছেনা রে…

কিন্তু কোথায়? ‘হেথা নয় হোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’! যেন এক অসহ্য অভিসার! এক চরম অপকেন্দ্রিক টান…। আবার অপরদিকে বিপ্রতীপে চরম গহণ অভিযাত্রা!

আমি কে? আমি-কে জিজ্ঞাসা করি! আমার থেকে আমি কে বিযুক্ত করে আনতে গিয়ে যখন দেখি কোথাও সে আমি-টা নেই! আমি মানেই বিন্দুবৎ? শুধু একটা চৈতন্যের অস্তিত্ব মাত্র। আর সবই তো আমার-প্রায়। বিন্দু বিন্দু জ্যোতি আর অমোঘ, নিকষ গহণীয়তা! আহা, আঁধারের গায়ে গায়ে যেন পরশ তব…!

চৈতণ্যের বাণী – তাই তো চেতাবনি! যেন আমার বন্ধু আমি। এটাই সত্য, আবার এটাই পাগলামি! গল্পের লেজ ধরে টানা হয়ে আসে গল্প। অল্প অল্প। যেমন করে শাখা বেরিয়ে আসে মূলের!

জীবন ধারা হয়ে চুঁইয়ে পড়ে। কেউ বলে ঝরণা! কেউ বলে- মর্ না! যেন এক ধরণা। চুপ্! গণতন্ত্র চলছে। প্রবাহে যারা দেয় হাতছানি…! আমি জানি। যারা বলে থাক! নিভে যাক সব! চিনি তাদেরও। যদিও তারা চেনেনা আমায়। হয়তো ঠিক তাই নয়। শুধু আমারই যা মনে হয়।

তারপরেও আমি মানি সেও জ্যোতি! নেই লাভ, নেই ক্ষতি। সুতরাং আমি মানে কেউ নয়। শতরূপে অভিনয়। নেই ভয়, নাহি ভয়। হবে জয় – প্রত্যয়!

*

আমি আমাদের একটা লেখা পড়ে শোনায়। লেখার বিষয়- মহাত্মার বইঘর।

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ‘মহাত্মা’ গান্ধি’ হয়ে ওঠেন তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী ও ‘সত্যাগ্ৰহ’-এর রাজনীতির কারণে। কিন্তু তিনি বারংবার আত্মপরীক্ষা ও আত্ম অবলোকনের পথে আত্মোন্নয়নে ব্রতী ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘My Experiments with Truth’ গ্ৰন্থটিতে তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন অবিরাম গ্ৰন্থপাঠ তাঁকে নিজেকে নিয়ে পরীক্ষার পথ বেয়ে সত্যের গন্তব্যে পৌঁছতে সাহায্য করেছে। তাঁর ভাবনা-চিন্তা, তাঁর স্বপ্ন দেখা, তাঁর পথ চলায় অন্ধের যষ্টির মতো সহায় সম্বল জুগিয়েছে তাঁর গ্ৰন্থ-ভুবন। গান্ধির রাজনীতি, তাঁর জীবন ও আদর্শ নিয়ে অনেক লেখা, অনেক আলোচনা হয়েছে, এমনকি তাঁকে নিয়ে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ছবিও তৈরি করেছেন, কিন্তু এই কথাটি কেউ তেমন করে বলেননি যে গান্ধি ছিলেন এক রাক্ষুসে পাঠক, “….not many even know that Gandhi was an avid reader, with a personal library comprising thousands of books.” নিজে হাজার হাজার বই কিনেছেন, সংগ্রহ করেছেন, পড়েছেন,……. এবং তিল তিল করে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। ১৯১৭ সালে গুজরাতে সবরমতী আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর তিনি তাঁর অমূল্য গ্ৰন্থ সংগ্ৰহ আশ্রমে হস্তান্তর করেন এই ভেবে যে আলোর ভাণ্ডার স্বার্থপরের মতো নিজের কাছে সংগোপনে না রেখে সকলের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়াই সঙ্গত। ১৯৩৩ সালে, লবণ সত্যাগ্ৰহকে আইন শৃঙ্খলা সহ দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের চক্রান্ত ঘোষণা করে এবং এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ব্রিটিশ প্রশাসন গান্ধিজিকে অভিযুক্ত করে সবরমতী আশ্রম বন্ধ করে দেয় এবং আশ্রম সম্পত্তির দখল নিয়ে নেয়। তখন গান্ধিজির অনুরোধে সবরমতী আশ্রম থেকে তাঁর নিজস্ব ১১ হাজার বই আহমেদাবাদ পৌর গ্ৰন্থাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর বক্তব্য পাঠকদের জন্যেই তালাবন্ধ আশ্রম থেকে বন্দি বইগুলোর মুক্তি দরকার। ২৭ জুলাই ১৯৩৩, একটি সাক্ষাৎকারে গান্ধিজি নিজেই তাঁর বইয়ের সংখ্যা এবং তাঁর এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন।
কিরীটী ভাবসার, মার্ক লিণ্ডলে এবং পূর্ণিমা উপাধ্যায় নানা নথি ও তথ্য বিশ্লেষণের পর ৪৫০০ বইয়ের একটি তালিকা তৈরি করেছেন ‘The Bibliography of Books Read by Mahatma Gandhi’. তালিকাটিতে চোখ বোলালেই বোঝা যায় কত বিচিত্র বিষয়ে গান্ধিজির কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা ছিল এবং তিনি কী গভীরে গিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের মৌল বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। আরও বোঝা যায় কী অমূল্য গ্ৰন্থরাজি তাঁর সংগ্ৰহে ছিল।
ব্যারিস্টার হিসেবে আইনের দুরুহ ও কঠিন বিষয়ে মনঃসংযোগের পাশাপাশি একই সঙ্গে তিনি রীতিমতো দাগ দিয়ে, মার্জিনে মন্তব্য লিখে পড়ে চলেছেন চার্লস ডারউইনের ‘Descent of Man’, পদার্থ বিজ্ঞান ও গণিত শাস্ত্রের মহামান্য পণ্ডিত জেমস জিনস-এর ‘Mysterious Universe’। এরপরই দ্বিতীয় শতকের লেখক লুসিয়ানের ‘Trips to the Moon’ পড়ে ফেলছেন। শুধু পড়াই নয়, সম্পূর্ণ আত্মস্থ করে Young India পত্রিকার, ১৯২৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বিশদ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহ লিখেছেন “Trips to the Moon (Lucian)… a fine and instructive satire.”
বিজ্ঞানের বই গুটিয়ে রেখে সেক্সপিয়ারের অমর সাহিত্যে, জোনাথন সুইফ্টে অবগাহন সেরে প্রবেশ করছেন রুশ সাহিত্যের গভীরে। আদিগন্ত পড়ে ফেলেছেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সাহিত্যিক টলস্টয় , নিজের মধ্যেই তর্ক আর লড়াই চালিয়েছেন তাঁর ‘What is Art’ নিয়ে। অধ্যয়নেই শেষ নয়, অনবরত লেখালিখিও করে চলেছেন সঙ্গে আইন আদালত তো আছেই। বিস্ময়কর। তাঁর নিজের হাতে তৈরি গ্ৰন্থভুবন নিঃশব্দে নির্মাণ করে চলেছে ভবিষ্যতের এক ‘মহাত্মা’কে।
দক্ষিণ আফ্রিকার দিনগুলোতে সারাদিন আইন আদালত নিয়ে পড়ে থাকার পর নিঃশব্দ রাত্তিরগুলো কাটাতেন বই বন্ধুদের সঙ্গে। তাঁর সে সময়ের ডায়েরিতে যেমন Jonathan Swift এর ‘Gulliver’s Travels’-এর উল্লেখ আছে, তেমনই Goethe-এর Faust এবং Edward Fitzgerald-এর অনুবাদে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতও (‘The Rubaiyat of Omar Khayyam’) ভালোবাসার সঙ্গে মন দিয়ে পড়ার কথা আছে। ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি বাছবিচার করেননি। মোহনদাস বিশ্বাস করতেন বিপুলায়তন বিশ্ব সম্পর্কে সামগ্ৰিক বোধ তৈরিতে পড়াশোনাকে পাঁচিল ঘিরে রাখলে চলে না। তাই গুজরাতি, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষায় যা পেয়েছেন, তাই পড়েছেন। পড়ে ফেলেছেন, Edward Gibbons, Thomas Carlyle থেকে শুরু করে পাতঞ্জলি, ভর্তৃহরি এবং Plato থেকে Bertrand Russell. তবে বলতেই হয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর লড়াই ছিল শুধু ভারতীয়দের ক্ষমতা ও অধিকারটুক রক্ষার তাগিদে, সে দেশের ‘জুলু’দের ন্যায্য দাবির পক্ষে নৈতিকতার সংগ্ৰামে তিনি কিন্তু ছিলেন না।
ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কে গান্ধিজির মতামত বিশ্ববিদিত। একদিনে বা একটি ঘটনায় তাঁর ধর্মীয় বা নৈতিক মতামত গড়ে ওঠেনি। তিনি ধর্মকে উপেক্ষা করেননি, তার বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতাকেও স্বীকার করে নিয়েছেন। পৌত্তলিক কঠোরতা, আচারের দাসত্ব ও কুসংস্কারের হৃদয়হীনতার কাছে আত্মসমর্পণও তিনি করেননি। ফলে হিন্দু বৌদ্ধ ইসলাম বা খ্রিস্টান তাঁর ধর্মীয়তা ও নীতিবোধের বিবেচনায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। তাঁর আত্মজীবনীতে একথা তিনি অকপটে একাধিকবার স্বীকার করেছেন, রাজনীতিতে প্রয়োগ করেছেন এবং এর বিপরীত বিশ্বাসীদের আগ্নেয়াস্ত্রে জীবন দিয়ে তা প্রমাণও করেছেন। অনুবাদে গান্ধিজি বারবার বাইবেল, কোরআন, বেদ উপনিষদ, রামায়ণ মহাভারত পড়েছেন, পড়েছেন এ সব মহাগ্ৰহান্থের টীকাটিপ্পনী, নানা মতের সংঘাত ও সংশ্লেষ থেকে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব নীতিবোধ ও ধর্মভাবনা। তিনি উল্লেখ করেছেন ক্ষুরধার বিচারের পথে বিক্ষত হয়ে আমৃত্যু এক সত্যের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করা ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ। গ্ৰন্থই তাঁকে এই মানবিক বিশ্বাস ও উদার সামগ্ৰিকতায় পৌঁছে দিয়েছে, তাঁর ভাবনার ভুবনকে মেঘমুক্ত করেছে। অবকাশ যাপন বা বিনোদনের বাসনায় বই হাতে নেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। গ্ৰন্থপাঠ ছিল তাঁর কাছে ‘সাধনা’র মতো।
গান্ধিজি যদি ওকালতি না করতেন, রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন, শুধু লেখাপড়ায় মগ্ন হয়ে জীবন কাটাতেন তাহলে তিনি হয়তো বিশ শতকের অন্যতম আধুনিক চিন্তক ও বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত হতেন। নগ্নদেহ, হাঁটুর ওপর কাপড়, হাতে লাঠি, গলায় রামধূন, প্রাচীন ও দরিদ্র ভারতবর্ষের এই নগণ্য ফকির যে কোনও অত্যাধুনিক, উজ্জ্বল ও বর্ণময় বিশ্ব বিদ্যা-ব্যক্তিত্বের সমতুল বলে বিবেচিত হতে পারতেন।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।