সাপ্তাহিক উপন্যাসে সপ্তর্ষি মণ্ডল (পর্ব – ১৫)

অজ্ঞাত

৪৫।।
সেই রাত সন্দীপন আর সত্যবতীকে দিয়েছিল নতুন উত্তাপ । দুধ ফুটে উদলে উঠল এই প্রথম । আলতো করে শুরু হওয়া খুনসুটি আজ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে । পরের দিন শরীর ক্লান্ত , তাই সেভাবে পরিকল্পনা করা হলো না আর , ফোন অবশ্য চালু ছিল দুপক্ষেই । শরীর , মন যখন একবার এক হয়ে যায় , তখন , নতুন করে দেখা করার প্রয়োজন হয় না । ভালোবাসা জেগে ওঠে প্রতিবার গঙ্গার কিনারায় ।
তখন বিকেল ৪টে । মোবাইলটা যখন প্রথমবার বেজে উঠলো তখন দুটো ঢুলু চোখ ঢুলছে । ওপাশ থেকে নরম গলা ভেসে এলো এবার ,
—- আজ দেখা হবে না গো !
সন্দীপন তখনও ঘুমের পৃথিবী লেপ্টে হারিয়ে আছে । সব শুনেও ঘুমের মধ্যে থেকে ভেসে এলো অচেনা স্বর ,
—- হ্যালো । কে ? কোথায় ? কেন ? কি জন্য ?
সত্য অবশ্য বারবার বলে চলেছিল তবু সন্দীপনকে একটুও উঠতে না দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো এবার ,
—– এই শালা উঠলি । চুপচাপ চন্দননগর চলে আয় ।
এমন মেজাজে রীতিমতো থতমত খেয়ে উঠে বসলো সে এবার ।
—- আসছি আসছি ।
নিজের মধ্যেই বলে চললো সন্দীপন ,
—- শান্ত মা , শান্ত হও এবার । আমি আসছি । আসছি । আসছি ।
পরক্ষনেই মা কে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলে উঠলো সে ,
—– মা । আমার ফিরতে দেরি হবে । একদম চিন্তা করবে না । খুব জরুরি কাজ আছে , যেতেই হবে ।
এদিকে এটুকু বলে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সন্দীপন যখন বাইরে বেড়িয়ে এলো , তখন মুঠোফোনের ওপাশ থেকে হেসে ওঠা স্বর , সন্দীপনকে বেশ অস্বস্তিতে ঠেলে দিয়েছে একথা বলা যায় । আজ বিকেলের স্পর্শে আদর ছিল মুঠো মুঠো , স্পর্শ ছিল দুই ঠোঁটে । নীরবে কোনায় বসে ছিল ওই , পড়ন্ত বিকেলের লাল ঠোঁট ছিল লালিমা মাখা অপর জোড়ায় আটকে ; একজোড়া হাত ছিল লোমশ শরীর আঁকড়ে আর এক জোড়া ওপরের নরম পুষ্প বৃন্তে ।
এভাবেই বিকেল কেটে সন্ধ্যা হয় । ফরাসি নগরের গির্জায় বেজে ওঠে ঘন্টা । বিচ্ছেদ নেমে আসে দুই পৃথিবীতে । চতুর্থ দিন এক মিলন মেলায় মেতে উঠে । সত্যবতী স্বপরিবারে উপস্থিত ছিল এদিনের দুপুরে । তারপর ট্রেন এলো । ভরে উঠল প্যাসেঞ্জারে । বড়ই অদ্ভুত এই সময় । সত্যের চোখে জল আর বুকে স্মৃতির অর্ধেক ভাগ । ট্রেন থেকে নেমে দাঁড়ালো ওরা এবার । সত্য করুণ কন্ঠে বলে উঠলো এবার ,
—– আবার কবে আসবে ?
সন্দীপনের মনটাও আজ ভালো নেই । কোনমতে বললো সে ,
—– খুব জলদি ।
—– চলো না , আমরা এখনই বিয়ে করে নিই । তারপর তোমার সাথে থাকবো । কত্ত মজা হবে ।
সন্দীপন মিনিট কয়েক থমকে দাঁড়ালো এবার , তারপর ধীরে উত্তর দিল ,
—- এখন নয় । সময় আসুক । তারপর রানী করে নিয়ে যাবো তোমায় ।
সিগন্যালের রং এখন সবুজ । ট্রেনে চড়ে বসলো সন্দীপন এবার । সত্যের চোখে তখনও জল , যেন শেষ বিদায় তার । এদিকে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে আর ওদিকে সত্যের মনে ভেসে উঠছে সন্দীপনের সেই লাইনগুলো আজ —-
” আকাশ ভর্তি তারা আর দুপাশে লাল গোলাপ ফুল
হালকা হাওয়ায় উড়ে যায় রেশমি চুল ।।
কি সুন্দর না ! কি মনোরম দৃশ্য এখানে
কি অদ্ভুত মিষ্টতা দু চোখ যায় যেখানে ।।
মন ভরে গেল তোমায় দেখে আজ এতদিন পরে
হাসি মুখে মাথা নেড়ে চলে এলাম রেলকামরার ঘরে ।।
তুমি বোধহয় চিনতেই পারনি আমায় ,
আর শত ব্যস্ততায় আজ আমারও একটুও নেই সময় ।।
রাত গভির হল , ঘুম নেমে এল কামরা জুড়ে
আমি কিন্তু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সিগারেট হাতে অনেক দূরে।।
স্টেশন , ব্রিজ , সব নিমেষেই হারিয়ে গেল
কিছু পেরিয়ে গেছে আর কিছু মিনিটখানেক দাঁড়াল ।।
ওপাশের দরজা তখনও খোলা
আলো আঁধারি খেলায় তোমার স্মৃতির মেলা ,
জানি তুমি পর আজ আমার কাছে
তবু কিছু কথা ভাগ করে নিতে কি কোন মানা আছে ?
এই তো সেদিন এমনই একটা রাত
কামরার ভিতরে আমি , নিচে তুমি আর মাঝে দুটো হাত
চেপে ধরে চলেছিল সাথে সাথে বেশ কিছুটা পথ
তারপর উঠে এলে তুমিও ভিতরে , ছেড়ে গেল সাথ ।।
আর এ পথে ঘন্টা চারেক বাকি
সেটুকু কি বোঝ তুমি না কি ,
অনেক কথা তোমায় বলতে বাকি রঞ্জিনি
যেকথা তোমায় আজও বলা হয় নি ।।
অভিমানে চলে গেলে সেদিন অনেক দূরে
আমিও সেদিন ঠিক করেছিলাম দেখব না ফিরে ,
তারপর সংসার বাঁধলাম ; সাথে কলম ও সাদা খাতা
বিয়ে করলাম না বুঝেই , নাম কবিতা ।।
সঙ্গে সঙ্গেই থাকি দুজন মিলে
মন হলেই বেরিয়ে পড়ি – পাহাড় , নদী বা ঝিলে ।।
জানো , খুব অভিমানী , কিছুতেই ধরা দেয় না সহজে
কি জানি কি মনে করে ; নিজেকে নিজে ।।
এই দেখ , সকাল হয়ে এল ,
জনহীন রেল স্টেশনে ; ট্রেন থামল ।।
কবিতার হাতে হাত ধরে নেমে পড়লাম
ভাগ্যে মেলে একটা রাত যখন তোমায় কাছে পেলাম ।।
ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে , চতুর্দিক নীরব
ধীরে ধীরে ধোয়াঁয় মুছে যাবে ফেলে আসা সব ।।
তুমি তো অনেক দূরে যাবে ; তাড়া হুড়ো নেই
হয়ত আবার কোনদিন দেখা হয়ে যাবে এই পথেই ।।
সোহাগ , শাঁখা , সিঁদুর এসব আজ শুধুই তোমার
আর তুমি চিরকালের তার ,
আর আমার জীবন শুধুই তোমার কবিতার
আর কবিতার মধ্য দিয়ে আজও তুমি আমার ।। “
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।