“বিবেকানন্দ এবং হিন্দুধর্ম ” আলোচনায় সন্দীপ মুখোপাধ্যায়

সন্দীপ মুখোপাধ্যায় যুক্ত ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপনার সাথে, বর্তমানে একজন পূজারী, আর তার পাশাপাশি চলছে সুগভীর পড়াশোনা আর লেখালিখি। ওনার স্বপ্ন হলো মহান ভারতীয় রাজরাজরাদের পুনঃমূল্যায়ন এবং প্রভূত কাহিনীর সৃষ্টির।
বিবেকানন্দ ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন।পাশ্চাত্য সভ্যতা ও বস্তুবাদের রঙিন চশমা পরে বিবেকানন্দ ধর্মকে ব্যাখ্যা করেননি।ভারতীয় সভ্যতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রেক্ষিতে তিনি ধর্মকে দেখেছেন।
বিবেকানন্দ মানবমুক্তির অন্যতম উপায় বলতে ধর্মকে বুঝিয়েছেন৷ধর্ম মানুষকে সাধনা করতে, অন্তঃপ্রকৃতি ও বহিঃপ্রকৃতিকে জয় করে মুক্তি এনে দিতে সাহায্য করে। বিবেকানন্দের মতে,’মানব মনকে গতিশীল করিবার জন্য ধর্ম একটি নিয়ামক শক্তি’।এই ধর্ম বলতে তিনি সনাতনধর্মকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন ভারতের সনাতনধর্মই হল জাতীয় জীবনের মূল কেন্দ্র,জাতীয় জীবন সংগীতের প্রধান সুর।
ধর্ম বলতে বিবেকানন্দ কোন সংকীর্ণ মত বা আচার- অনুষ্ঠানকে না বুঝিয়ে হিন্দুধর্মের সারভাগকেই বুঝিয়েছেন।ধর্ম মহাসভায় হিন্দুধর্ম বক্তৃতাটির মধ্য দিয়ে তা সর্বজনগ্রাহ্যভাবে উপস্থিত করিয়েছেন।বিবেকানন্দের মতে,হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে,বেদ হতে তাদের ধর্মের উৎপত্তি। বেদসমূহকে তারা অনাদি ও
অনন্ত বলে বিশ্বাস করে। বিবেকানন্দের মতে,হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি হল বেদান্ত। বেদ সাধারণভাবে হিন্দুধর্মের ভিত্তি বলে অভিহিত হয়ে থাকে। বেদান্তকে স্বামীজি সেই বেদের প্রকৃত নির্যাস স্বরূপ মনে করেছেন।
বিবেকানন্দের কাছে হিন্দুধর্ম উদার।এই ধর্ম অন্তরে ন্যায়, সাংখ্য ও বেদান্তের প্রগাঢ় দার্শনিক মেধাকে আশ্রয় দিতে পেরেছে, রাজযোগের আধ্যাত্মিক বিজ্ঞতার বিশাল ভাণ্ডার মনোবিদদের নিকট অর্পণ করতে পেরেছে, অনুরক্ত ভক্তদের মোহিত স্তবগান এবং তুলসীদাস বা দক্ষিণী সাধুসন্তদের আধ্যাত্মিক সংগীত দ্বারা উৎসাহিত করতে পেরেছে এবং অবশেষে ক্ষমতাশালী ও অস্থির- উত্তেজিত জনগণকে শ্রীকৃষ্ণের দিব্য- সংগীতে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত নিঃস্বার্থ ক্রিয়াকলাপের তত্ত্ব দিতে পেরেছে।
বিবেকানন্দের কাছে হিন্দুধর্ম ছিল সকল ধর্মের মাতৃপ্রতিম।প্রাচীন বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধধর্মকে প্রভাবিত করেছিল এবং পরবর্তীকালে যা খ্রীষ্টান ধর্মের উদ্ভবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল।প্রাচীন বৈদিক ধর্ম পারসিক ধর্মকে যেমন প্রভাবিত করেছিল,তেমনি খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইহুদীয় ধর্মের উদ্ভবেও প্রভাব ফেলেছিল। পশ্চিম- এশিয়ার ঈজিপ্টের প্রাচীন ইতিহাসের গবেষণা হতে জানা যায় যে,বহু দূরবর্তী দেশে প্রাচীন ভারতীয় ধর্মের সাংস্কৃতিক পরিব্যপ্তি ছিল।
ভারতের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন,ভারতে সুলতানগণ কখনোই সুস্থির হয়ে রাজ্যশাসন করতে পারে নি। কারণ তারা ভারতের সনাতনধর্মে ক্রমাগত আঘাত হেনেছিল।অপরদিকে মুঘলশক্তি তুলনামূলক ভালো এবং শক্তিশালী হয়েছিল কারণ হিন্দুরাই তো মোগলের সিংহাসনের ভিত্তি,জাহাঙ্গীর, শাজাহান,দারাসেকো – এদের সকলের মা যে হিন্দু। একই সাথে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হিসাবে আওরংজেবের ধর্মনীতিকেই দায়ী করেছেন। সনাতনী ভারতীয় প্রজাদের উপর আঘাত হানার ফলেই আওরংজেবের শুধু নয় পতন ঘটে মুঘল সাম্রাজ্যের। স্বামীজির মতে,হিন্দুধর্ম খ্রিষ্টান মিশনারীদের হাতে ব্যাপক আকারে ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহের আগুন এইভাবেই জ্বলে উঠেছিল।
হিন্দুদের কাছে ধর্ম বোঝাতে গিয়ে বিবেকানন্দ মূর্তিপূজার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভাবানুষঙ্গ নিয়মানুসারে জড়মূর্তি দেখলে মানসিক ভাববিশেষের উদ্রেক হয়,বিপরীতক্রমে মনে ভাববিশেষের উদ্দীপন হলে তদনুরূপ মূর্তিবিশেষও মনে উদিত হয়। এইজন্য হিন্দু উপাসনার সময়ে বাহ্য প্রতীক ব্যবহার করে হিন্দুধর্মে বিগ্রহ পূজা যে সকলের অবশ্যকর্তব্য, তা নয়। তবে কেউ যদি বিগ্রহ পূজার সাহায্যে সহজে নিজের দিব্যভাব উপলব্ধি করতে পারে,তাতে কোন পাপ নাই বা ক্ষতি নাই।বিবেকানন্দের মতে,হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী বাহ্যপূজা – মূর্তিপূজা প্রথম অবস্থা; কিঞ্চিৎ উন্নত হলে মানসিক প্রার্থনা পরবর্তী স্তর;কিন্তু ঈশ্বর সাক্ষাৎকারই উচ্চতম অবস্থা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।