ক্যাফে গপ্পো -তে সুশোভন কাঞ্জিলাল

ঘেন্না

অফিসের গাড়িটা আজ আবার লেট করছে। অবশ্য ড্রাইভারটা যেন জেমস বন্ডের ভাইপো। যত লেটেই আসুক না কেন অফিসে ঠিক টাইমে ঢুকিয়ে দেয়। চালানোর ধরনটা তখন অবশ্য তার কাকার মতন হয়ে যায়। গাড়িটা আসতে লেট করলে বড় অস্বস্তি হয় রবিনের, অকারণে কিছু অবাঞ্চিত চেনা লোকের সঙ্গে দাঁত বের করে বক বক করতে হয়। যদিও বেশিরভাগ সময় সে শ্রোতার ভূমিকা পালন করে। আরেক বিপত্তি এই দাড়িয়ে থাকার যে বার বার মনে হয় বেগ পাচ্ছে, আরেকবার বাথরুম গেলে ভালো হয়। যাইহোক রবিন কর দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে তার অফিসের গাড়ির। ওই পাগলীটা আবার আসছে। এই বাসস্টপে একটা পাগলী নতুন আস্তানা গেড়েছে। বিশ্রী, নোংরা, একটা পাগলী বুড়ি। দেখেই ঘেন্না লাগে রবিনের। নোংরাতে রবিনের খুব এলার্জি। অপরিচ্ছন্নতা তার একেবারেই সহ্য হয় না। ঘেন্না ভাবটা তার তার খুব প্রবল। তার রাগ বা দুঃখ এমনকি আনন্দ খুব একটা বাড়াবাড়ি মাত্রায় হয় না। কিন্তু ঘেন্না এবং বিরক্তি খুব অল্পতেই মাথা চাড়া দেয়। পাগলীটা রবিনের একেবারে কাছে এসে বলে “একটা আধুলি দিবেন বাবু!” রবিন একবার বুড়িটার দিকে চোখ বুলিয়ে, পলকে সরিয়ে নিল। রুমাল বার করে নাকে দিল। শত ছিদ্র একটা তেল চিটে নোংরা সেমিজ পরে আছে সেই ভিকারীটা। চুলে কি সমস্ত লেগে আছে, জট পরা, মুখে কালি, দাঁতগুলো হলুদ, নাক দিয়ে কি সমস্ত গড়াচ্ছে। কি দুর্গন্ধ ওর গায়ে। ওয়াক! ঘেন্নায় রবিনের মনে হল যেন সদ্য গেলা ব্রেকফাস্ট উঠে আসবে। বিরক্তিতে সে বলল, “চল যা এখান থেকে!” কিন্তু সেই বুড়ি নাছোড়বান্দা। যেন আরো গায়ে উঠে আসতে চায়।বাধ্য হয়ে মানিব্যাগ বার করে একটা দু টাকার কয়েন ছুড়ে দিল সেই ভিখারিটার গায়ে সে ওটা কুড়াতে নীচু হল সহসা রবিনের অফিসের গাড়িটা এল। বাঁচা গেল।
রবিন কর উইংস এডভার্টাইসমেন্ট এজেন্সির ক্রিয়েটিভ রাইটার। বিজ্ঞাপনের কনটেন্ট লেখায় সে খুবই ইনোভেটিভ এবং ট্যালেন্টেড, কিন্তু তার দক্ষতা এখনো সেভাবে প্রচার পায়নি। আসলে তাদের অফিসে অতিমাত্রায় পলিটিক্স হয়। তার বস এবং বসের চামচারা তাকে সাবোটাজ করে। ওর বস যদি এইভাবে এক্সপ্লয়েট না করত তাহলে আজ রবিন কর এই জগতের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি হত।
গাড়িটা এসে আজ আবার দাঁড়ালো কালীঘাট ব্রিজের জ্যামে। মনে হয় এই জায়গাটায় চুম্বক আছে। জ্যামে পরবেই, গাড়ি আটকাবেই, আর ঠিক রবিনের চোখ পড়বে ওই সব মেয়েদের ওপর যারা ব্রিজের ওপর খদ্দের খোঁজে। ঘেন্না লাগে রবিনের ওদের দেখলে। পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসায় লিপ্ত সব দেহ-পসারিনী। সে এখন তার চোখকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গেছে। সকাল সকাল ওই সব মেয়েছেলেদের দিকে তাকায় না। না হলে সকাল থেকেই মনে হয় দিনটা বাজে যাবে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও আজ চোখ শাসন করতে পারলো না। দৃষ্টি গেল অতি রঞ্জিত অতি সজ্জিত একটা মেয়ের ওপর, সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরাতে চাইলো রবিন কিন্তু পারলো না। কেন জানিনা আটকে গেল তার দুটি চোখ, আরো দুটি চোখের ওপর যে দুটি ক্রমাগত অশ্লীলতার ইশারা দেয়। গাড়ির জানলা দিয়ে রবিন দেখে মেয়েটিকে। মেয়েটি অদ্ভুত হেসে তাকিয়ে আছে রবিনের দিকে যেন বলছে “আসো! কাছে আসো! আমি তোমারি!” গাড়ি চলল, রবিন ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখতেই লাগল। মেয়েটিও প্রেম নিবেদনের চাহনিটা কাতরতায় পরিবর্তন করে নিল ধীরে ধীরে, কিছু যেন বলতে চায় আর দেখা যাচ্ছে না মেয়েটিকে। রবিনের চটক ভাঙলো গাড়ির হঠাৎ ঝাকুনিতে। ছিঃ একি অধপতন! পাশে বসে থাকা কুন্ডু বাবু বুঝলো না তো?
রবিন ভেবে ছিল আজকেও রোজকারের মতই দিনটা শুরু হবে অফিসে। বঞ্চনা আর প্রবঞ্চনার রোজনামচা। কিন্তু হয়ত রবিনের জন্য কিছু অন্যরকম ছিল সেই দিনটা। ঢুকেই শুনলো তাকে কোম্পানি থেকে ল্যাপটপ দেওয়া হচ্ছে। গুড নিউজ, সেই দিনটা সব মিলিয়ে সত্যি চমৎকার কাটল।
বেশ কিছুদিনের কাটল, ভিখারীটাকেও দেখলো না আর সেই বাজে মেয়েটাকেও না রবীন হয়ত খেয়াল করেনি। কয়েকদিন পর আবার এল ভিখারিটা। রবীনের করুনা হয় না। কিন্তু পাগলীটা গায়ে উঠে আসে।তাই ঘেন্নার বশে সেদিনও 2 টাকা ছুড়ে দিল সে। মুডটা ভালো নেই তার। তার বস খুব পেছনে লেগেছে তার। ল্যাপটপ দিয়ে মনে হচ্ছে মাথা কিনে নিয়েছে। গাড়ি এসে থামলো আবার সেই কালিঘাটের জ্যামে। হঠাৎই রবীনের চোখ গিয়ে পড়ল সেই মেয়েটির ওপর সেই পরিচিত আস্কারা সূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। রবীন দেখলো মেয়েটি আহ্বান জানাল। গাড়ি এগিয়ে চলল। সেদিনও অবাক কান্ড, রবীনের জীবনটা আনন্দময় হয়ে উঠল। দুপুর নাগাদ সে জানতে পারল তার বস মুম্বাই অফিসে বদলি হয়ে যাবে।’ উফ মুক্তি’ সে যারপরনাই খুশি হল। এবার রবীন কর কে বিজ্ঞাপন জগৎ চিনবে, মানবে। সেই রাতে হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখে রবীনের ঘুমটা ভেঙে গেল। সে দেখল সেই ভিখারী আর বেশ্যাটাকে। মাঝ রাতে বিছানাতে শুয়েই তার একটা কথা মাথায় এলো। সে এই দুই মহিলাকেই ঘেন্না করে। একজনের বেশভুষায় আর অন্যজনকে কর্মের জন্য বিতৃষ্ণা করে। কিন্তু কি অদ্ভুত!দুজনকে একসঙ্গে দেখলেই দেখা যাচ্ছে তার দিন ভালো যাচ্ছে। এটা কি শুধুই কাকতালিও।
পরের কয়েকদিন অবশ্য রবীনের এসব কথা মাথায় ছিল না। ঐ অসস্তিকর মেয়েছেলেগুলোকেও আর সে দেখতে পায়নি। অথবা খেয়াল করেনি।
কয়েকদিন পর সে আবার ঐ দুজনকে দেখল আর অফিসে গিয়ে আবার সুখবর পেল। তার একটি বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট খুবই প্রশংসা পেল। একটি ইংরাজী পত্রিকায় সেটা উল্লেখ করে তার নাম প্রকাশিত হয়েছে। দারুন !থ্রী চিয়ার্স।
এমন করে ধীরে ধীরে রবীনের বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল যে ঐ দুই অপছন্দের মহিলা তার ভাগ্যের সঙ্গে কিছু ভাবে জড়িয়ে আছে। রবীন যতই তাদের ঘেন্না করুক। তারা রবীনের জন্য পজেটিভ ক্যাটালিস্ট। রবীনের অভ্যাস হয়ে গেল রোজ নিয়ম করে ওই দুই ঘৃণ্য মহিলাদের দর্শন দিনের গোড়ায়। রোজ সে ভিখারিটাকে টাকা দিতে লাগল আর ব্রিজের মেয়েটিকে থাঙ্কস গিভিং দৃষ্টি। রবীনের জীবনও ফিরতে লাগল সৌভাগ্য দেবী যেন ওই দুই নোংরা নারী রূপে তাকে জড়িয়ে ধরতে লাগল। এক অবাস্তব কল্পনা বা বিশ্বাস রবীনকে চেপে ধরল। এমনও হল রবীন কোন গুরুত্বপূর্ণ দিনে ইচ্ছে করে ভিখারিটাকে টাকা দিয়ে আর ওই মেয়েটিকে দেখে যেত। দরকার পরলে অফিস গাড়িও মিস করেছে সে। ঠিক যেন ভাগ্যের অন্বেষনে তার ভাগ্য দেবীদের দর্শন বাঞ্চনীয় হয়ে গেছে।
সেদিন এক সাধারণ দিনই ছিল। রবীন বাস স্টপে। তার চোখ ওই ভিখারিটাকে খুজছে। কই দেখা যাচ্ছে নাতো। রাস্তার ওই পারে একটু এগিয়ে একটা জটলা দেখা যাচ্ছে। গাড়ি আসতে বেশ দেরি। আগেই এসেছে সে আজ। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখার ইচ্ছে হল তার সে দেখল জটলাটার কেন্দ্রবিন্দু। ভিড় সরিয়ে সে চমকে উঠল। সেই নোংরা, পাগলী বুড়িটা মরে পরে আছে। তার এক ভাগ্যদেবী আর নেই। অস্বাভাবিক কিছুই না। এক জরাজীর্ন বুড়ি মরতেই পারে। কিন্তু রবীনের মনটা হায়হুতাশ করে উঠল। বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেল। যদি বেঁচে থাকে? তার দিকবিদিক জ্ঞান থাকলো না। মনে হল যেন তার খুব আপনজন হয়ত তার মা পরে আছে রাস্তায়। রবীন বাকি লোকেদের ট্যাক্সি ডাকতে বলল। তারপর নিজের হাতে ওই নোংরা দুর্গন্ধময় দেহটি তুলে ট্যাক্সিতে ঢোকাল। হসপিটালে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে জানা গেল বুড়িটা মৃত। রবীনের আর অফিস যাওয়া হল না। ওই বুড়িটাকেও বাঁচানো গেল না। তার পোস্টমর্টেম করে পোড়াতে নিয়ে যাওয়া হবে। রবীন বেরিয়ে এলো একগাদা অবসাদ নিয়ে। ট্যাক্সিতে উঠল সে। নিজের অজান্তেই বলল, ‘কালীঘাট চল।’
রবীনের ট্যাক্সি এসে থামল ব্রিজের ওপর। কিন্তু সেই মেয়েটি তো নেই। সে নেমে খোজা খুজি করল। ব্রিজ থেকে নেমে গলিতেও ঢুকল। কিন্তু নেই তো। কত সত রকমের বাজে মেয়ে তাকে ডাকলো। ইশারা করল কিন্তু রবীনের চোখ সেই মেয়েটিকে খুঁজে চলেছে। কিন্তু কেন জানিনা ওই বাজারের মেয়ে গুলোর প্রতি আর সেরকম ঘেন্না অনুভব করছে না। সে ব্রিজের ওপর ফেরত এল। ওই মেয়েটা যেখানে দাঁড়ায় সেখানে আজ অন্য একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। রবীন মরিয়া হয়ে তাকেই জিজ্ঞাসা করল ওই মেয়েটির কথা মেয়েটা তো পারলে রবীনকে টেনেই নিয়ে যায়। কিন্তু রবীন একটু কঠোর হয়েই বলল, ” আমার হাত ছাড়!অন্যদিন যেই মেয়েটা দাঁড়ায় সে কোথায়?মেয়েটি বলে, “বাব্বা! কি দেমাগ বাবুর।”রবীন পকেট থেকে ১০০ টাকার নোট বের করে দিতে চায় মেয়েটিকে। মেয়েটি বলে, “লাগবে না মুফতের পয়সা নিনা বাবু, ওই মাগী পালিয়েছে তার সোহাগের এক খদ্দের এর সঙ্গে কালই।”আরও বিস্বাদে ভরে গেল তার মন। কিন্তু এতো ভালো খবর। মেয়েটি সুস্থ জীবন ফিরে পাবে। রবীনের কি স্বার্থ হানী হবে তাতে? হয়তো ভালোই হয়েছে। কি জানি? সে আবার ওই টাকাটা দিতে গেল মেয়েটিকে ওই দুঃসংবাদ বা সুসংবাদটা দেওয়ার জন্য। ওমনি যেন খপাত করে হাতটা ধরে বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে এক অচেনা গুন্ডার মতন দেখতে লোক। মেয়েটি দেখেই পালিয়ে যায়। রবীন বলে “কে আপনি? এটা কি অসভ্যতা? “লোকটি হাত ছেড়ে ঘেটির কলার ধরে বলে, “শালা !বাজারী মেয়েকে পয়সা দিয়ে ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলে, আর সভ্যতা দেখাচ্ছ? ওই তোল মালটাকে ভ্যানে।”
তারপর আর সঠিক ভাবে কিছু জানা যায়নি। লোকমুখে শোনা পুলিশে বাজে পাড়া থেকে রবিন বাবুকে ধরে। তার বাড়ির লোক জেনে ছাড়াতে আসে। অফিসেও জানা জানি হয়। তার কিছুদিন পর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। চাকরি ছেড়ে দেয় না চলে যায় তা সঠিক জানা নেই, সে এখন নিখোঁজ। হয়ত ভাগ্য অন্বেষণে বা তার ভাগ্যদেবীর খোঁজে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।