অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার – ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে)

(চার)

(চার)
অনন্যার একমাত্র সঙ্গী বলতে এখন টিভি। দিনের পর দিন টিভির বিভিন্ন খবর আর প্রোগ্রাম দেখতে শুনতে মাঝে মাঝেই সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আজও কিছুটা ক্লান্ত হয়েই অনন্যা টিভিটা অফ করে দিল। ঘড়িতে এখন কাঁটায় কাঁটায় ঠিক বেলা এগারোটা বাজে। এই সময় সৌমাল্য পাশের ঘরে ওর ল্যাপটপে মন দিয়ে নিজের কাজ করে, ওর সফটওয়্যারের বিজনেস আছে। সেইসব কাজ করে। অনন্যাকে এখানে নিয়ে আসার দশ বারোদিন এই বাড়িতে খবরের কাগজ আসত, সৌমাল্যও প্রতিদিন একটু আধটু বাইরে বেরত। এখন খবরের কাগজ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাইরে বেরোয়ও খুব কম। নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে একটু আধটু বাইরে যাওয়া ছাড়া সৌমাল্য বাড়িতেই থাকে। অথচ সৌমাল্য যখন বাইরে থাকে, সেই সময়টাই অনন্যা এখান থেকে পালানোর একটু আধটু যা চেষ্টা টেষ্টা করতে পারে, না হলে কখনও কখনও গভীর রাতে। কিন্তু এ পর্যন্ত যতবারই সে পালানোর চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবারই সৌমাল্য তাকে ধরে ফেলেছে। অনেক কান্নাকাটি করেও অনন্যা সৌমাল্যের মন টলাতে পারেনি। তাকে বাধ্য হয়েই এই বন্দী অবস্থা মানিয়ে নিতে হচ্ছে। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ আজ বন্দী, অনন্যাও বন্দী। কিন্তু কতটা ফারাক এই দু’য়ের।
গতরাতে অনন্যা পালানোর চেষ্টা করেছিল, সৌমাল্য তখন ঘুমচ্ছিল, কিন্তু একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। বেশ রেগেই অনন্যা সৌমাল্যকে বলেছিল, ‘কী পাগলামি করছ এসব? তুমি জানো, এর জন্য তোমার কী শাস্তি হতে পারে?’
সৌমাল্য বলেছিল, ‘আগে এই করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচব, তারপর ধরা পড়ব, তারপরে তো শাস্তি! সে তখন ভাবব? আপাতত তুমি আমার কথাটা ভাব?’
ঝাঁঝিয়ে উঠে অনন্যা বলেছিল,’তোমার কথা কী ভাবব? এইভাবে আটকে রেখে কোনও মেয়ের ভালোবাসা পাওয়া যায়? তুমি পাগল না শয়তান?’
-‘দুটোই।’ হাসতে হাসতে সৌমাল্য জবার দিয়েছিল।
-‘আমার কাছে তুমি কী চাও?এভাবে কেন আমাকে দিনের পর দিন আটকে রেখেছ?’
-‘তোমার ভালোবাসা চাই। তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’
-‘ কোনওটাই পাবে না তুমি। একজন পরস্ত্রীকে কিডন্যাপ করে জোর করে কাউকে আটকে রেখে কেউ যদি তার ভালোবাসা পাবে ভেবে থাকে, তাহলে সে মুর্খের স্বর্গে বাস করে। বোকামো না করে আমাকে বাড়ি যেতে দাও।’
-‘আচ্ছা। তোমার কথাই মেনে নিলাম। তোমাকে বাড়ি যেতে দেব। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।’
-‘কী শর্ত?’
-‘তুমি যদি সেই শর্ত মানো তবেই তোমাকে ছেড়ে দেব, নচেৎ আমি অপারগ।’
-‘হুম। শর্তটা কী?’
-‘তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না বলছ!’
-‘হ্যাঁ।’
-‘আমাকে বিয়েও করতে পারবে না তুমি; অথচ তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতেও পারব না।’
-‘আমার পক্ষে কোনওভাবেই সংসার ছেড়ে চলে আসা সম্ভব নয়। তাছাড়া তোমার মতো একজন বদ্ধ উন্মাদের সঙ্গে আমার এই সব আবোলতাবোল কথা বলতেও ভালো লাগছে না। এই ক’দিনে আমি মানসিকভাবে ভীষণ শ্রান্ত, কাল সকালেই আমাকে বাড়ি যেতে দাও।’
-‘ বাইরে তো লকডাউন চলছে! যাবে কী করে?’
-‘সেটা আমি বুঝে নেব। তুমি তোমার কাজটা করো, তাহলেই হবে।’
-‘বেশ। তাহলে শর্তটা বলি।’
-‘এর মধ্যে আবার শর্ত কীসের? খুব টেঁটিয়া ছেলে তো তুমি! আমি কোনও শর্তটর্ত মানতে পারব না। রাত পোহালে আমি বাড়ি ফিরব। ব্যাস।’
-‘তাহলে আর কী! তোমাকে আমিও কোনও সাহায্য করতে পারব না। তুমি চেষ্টা করে দেখো, পালাতে পারো কিনা।’ বলে সৌমাল্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিল।
এতদিনে অনন্যা এটা বুঝে গিয়েছে যে, এখান থেকে বেরোতে গেলে সৌমাল্যের চোখে ধুলো দিয়ে যাওয়া যাবে না, তার সাহায্য অবশ্যই দরকার। ফলত উপায়ান্তর না দেখে সে একটু নরম সুরেই বলল, ‘বেশ। বলো তোমার কী শর্ত আছে, শুনি।’
সৌমাল্যও যেন এটার অপেক্ষাতেই ছিল, কোনও ভূমিকা না করে সটান বলল, ‘দ্যাখো আর ঠিক একমাসের মাথায় আমি নিজে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি। কিন্তু এই একমাস প্রতিদিন আমার সঙ্গে তোমাকে ফিজিক্যাল রিলেশন করতে হবে। তারপরেও তুমি যদি আমাকে ভালো না বাসতে পারো, আমার প্রতি তোমার কোনও ফিলিংস চেঞ্জ না হয়, তাহলে আমি মেনে নেব তোমার ভালোবাসা পাবার সত্যিই কোনও যোগ্যতা আমার নেই।’
-‘কী!’ অনন্যার মাথাটা ঝট করে আবার তেতে উঠল। গরম আগেই ছিল এবার যেন তাতে বেশ খানিকটা ঘি পড়ল।
‘তাই তো বলি, চুপচাপ ভালো মানুষের মুখোশ আর পরে থাকা গেল না! তাই না? শরীরের লোভেই আমাকে এখানে টেনে এনে এতদিন ভালো মানুষ সেজে বসে ছিলে। আমাকে বিয়ে করার, ভালোবাসার কথা শোনাচ্ছিলে! ভেবেছিলে এতেই হয়ত তুমি তোমার পরিকল্পনা সার্থক করে ফেলতে পারবে। সেটা হবে না বুঝে আজ নিজের ঘৃণ্য চেহারাটা সামনে আনছ! ছিঃ! এই সন্দেহটা আমার ছিল না তা নয়, কিন্তু দিনের পর দিন তোমার অভিনয় দেখে ভাবতে শুরু করেছিলাম, হয়ত তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো! ছিঃ! এত ইতর তুমি? এত জঘন্য!’
সৌমাল্য নিরুত্তাপ। অনন্যার বলা শেষ হলে অন্তত শান্তভাবে সৌমাল্য বলল, ‘আমাকে তুমি যা ইচ্ছে ভাবতে পারো। কিন্তু এটাই আমার একমাত্র শর্ত। তুমি রাজি থাকলে আমিও কথা রাখব।’ এই কথা বলতে বলতে সৌমাল্য ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঘরের মধ্যে তখন অনন্যা গর্জরাচ্ছে, প্রচণ্ড কাটা কাটা স্বরে একরাশ ঘৃণা উগরে সে সৌমাল্যের উদ্দেশ্যে বলল,”আমিও কথা রাখব!’ তুমি মানুষ! কথা তো মানুষেরা রাখে, জানোয়ারেরা নয়। জানোয়ার একটা! পরের বউকে জোর করে আটকে রেখে কুপ্রস্তাব দেওয়ার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। ভেবো না অনিমিখ চুপ করে বসে আছে। ও ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করবে। তারপর তোমাকেও দেখে নেব। তোমার বাবা মা কী তোমাকে কিছুই শেখাননি? সভ্য জগতে না থেকে বনে গিয়ে থাকোগে… অসভ্য ছেলে।’
আজ সকাল থেকে ওদের কথা বন্ধ। দুজনে পাশাপাশি দুটো ঘরে। কেউ কারোর সামনে এখনও পর্যন্ত আসেনি। অনন্যা গতরাত থেকেই দরজা বন্ধ করে রেখেছে। এখনও খোলেনি, সকালের চা, জলখাবার কিছুই খায়নি, দুপুরেও কিছু খেল না। রহমত চাচা অনেকবার তাকে ডাকতে এলেও সে ফিরিয়ে দিল। সৌমাল্যও ডাকল। অনন্যা রহমত চাচাকে শরীর ভালো নয় বলে ফিরিয়ে দিল, আর সৌমাল্যর ডাকে কোনও সাড়াই দিল না। সারাটা দিন নিজের মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে সন্ধের দিকে দরজা খুলে নিজেই বেরিয়ে এসে, বারান্দা থেকে রহমত চাচাকে ডাকল। সৌমাল্য বেরিয়ে এসে কিছু বলতে চাইল হয়ত, কিন্তু অনন্যা তার মুখের ওপরেই আবার দরজা বন্ধ করে দিল। অগত্যা সৌমাল্য ফিরে যাবার পর রহমত চাচা এলে, অনন্যা ঘরের দরজা বন্ধ রেখে ঘর থেকেই বলল, ‘মাথাটা খুব ধরেছে চাচা, একটু চা খাওয়াতে পারো?’
-‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। কেন পারব না! এখুনি আনছি দিদিমুণি। ‘ রহমত চাচা চা আনতে চলে গেল। অনন্যা ঘরে বসেই সিঁড়ি দিয়ে রহমত চাচার নামার শব্দ পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা-এর সঙ্গে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা গরম গরম লুচি আর বেগুনভাজা হাতে রহমত চাচা অনন্যার দরজায় টোকা দিল। অনন্যা দরজা খুললে রহমত চাচা চা আর খাবার নিয়ে ভেতরে ঢুকল।
-‘এসব আবার কী এনেছ চাচা? লাগবে না আমার, নিয়ে যাও। শুধু চা-টা থাকলেই চলবে।আর কিছু খেতে ইচ্ছা নেই।’ অনন্যা খাবার খেতে অস্বীকার করালেও শেষ পর্যন্ত রহমত চাচার পীড়াপীড়িতে খাবার গুলো নিতে বাধ্য হ’ল। তাকে খাইয়ে তবেই রহমত চাচা চা আর খাবারের পাত্রগুলো নিয়ে বাইরে বেরল। একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও রহমত চাচাকে ফেরাতে পারল না অনন্যা। বয়স্ক মানুষদের অমান্য করাতে তার ভালো লাগে না। মনের পুরানো সংস্কারকে আজকেও দূরে ঠেলে দিতে পারল না। রহমত চাচা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে কিছুক্ষণ সেইদিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে উঠে আস্তে আস্তে আবার দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে খাটে এসে বসল। আজ আর টিভি দেখারও মন নেই। দুপুরের পর থেকে সৌমাল্যও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত দুপুরে সেও খায়নি। রহমত চাচা অনন্যাকে খাওয়ানোর পরে সৌমাল্যর ঘরে ঢুকেছিল। দুজনের মধ্যে কিছু কথোপকথন হচ্ছে এটা অনন্যা পাশের ঘর থেকে টের পাচ্ছে, কিন্তু কী কথা হচ্ছে সেটা শুনতে পেল না। অনুমানে বুঝল রহমত চাচা বোধহয় সৌমাল্যকেও খাবার খাইয়ে এলো।

যে ভরসায় এতদিন নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে সৌমাল্যর ওপর কিছুটা হলেও বিশ্বাস এসেছিল, গতরাতের ঘটনার পরে সেই বিশ্বাস একেবারেই ধূলিসাৎ। তাছাড়া ভালোও লাগছে না কিছু। সুতরাং ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকাটাই এখন শ্রেয় বলে মনে হল অনন্যার। কিন্তু এইসব সময় একটা অবসাদ মনকে গ্রাস করে। অনন্যারও সেটাই হ’ল। কাহাঁতক চুপচাপ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করা যায়! অথচ এটাই করে যেতে হচ্ছে। দিনের পর দিন চলতে থাকছে এই মানসিক উৎপীড়ন। বিক্ষুব্ধ মনে আক্রোশ বাড়তে বাড়তে সীমাহীন অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে। সৌমাল্য তো বটেই, কখনও অনিমিখের ওপর আবার কখনও বা সাতপাঁচে না থাকা রহমত চাচার ওপরেও একটা তীব্র রাগ ধরছে।
নিঝুম ঘরে একা একা অনেক চিন্তাভাবনার পর অনন্যার অবুঝ মন রহমত চাচাকেই তার মুক্তির শেষ উপায় হিসেবে ঠাওরালো। রহমত চাচার সাহায্যে যদি এখান থেকে পালানো যায়। শেষ একটা চেষ্টা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিল অসহায় অনন্যা।
ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *