অথ শ্রী উপন্যাস কথা-তে সুতনু হালদার – ধারাবাহিক (অন্ধকারের উৎস হতে)

দুই

আজও! আজও একইভাবে সৌমাল্য অনন্যাকে প্রোপোজ করল, আর অনন্যাও একইভাবে রিফিউজ করল। এই নিয়ে টানা পাঁচবার। একজন বিবাহিত নারী হিসেবে এটা অন্তত এবার অনন্যার বর অনিমিখের জানা উচিত। কিন্তু অনন্যা ঘটনাটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না অনিমিখকে। অনিমিখ অত্যাধুনিক, এইসব সামান্য ঘটনা পাত্তা দেবে বলে মনে হয় না। সুতরাং এটা বন্ধ করতে যা কিছু করার অনন্যাকেই করতে হবে – এটা সে ভালো ভাবেই বুঝে গেছে। ছ’বছরের বিবাহিত জীবনে অনিমিখকে চিনতে অনন্যার আর কিছু বাকি নেই। নিজের অফিস, পার্টি হৈ-হুল্লোড় এইসব নিয়ে মেতে থাকতেই ভালোবাসে লোকটা। জীবনকে গভীরভাবে দেখতে পছন্দ করে বলে মনে হয় না। দারুণ স্ববিরোধী ব্যক্তিত্ব! কখনও কখনও যেন শিশুর মতো একটা সারল্য অনিমিখের মুখ-চোখ ভরিয়ে তোলে, আবার কখনও কখনও সেই অনিমিখই যেন প্রচন্ড হিংস্র এক কুটিল ব্যক্তি। অনিমিখের এই স্ববিরোধিতা অনিমিখ আর অনন্যার দাম্পত্যে বারবার কালো মেঘ ঘনিয়ে তোলে। আর প্রতিবারই স্রেফ সংসারকে টিকিয়ে রাখার জন্য অনন্যাই উপযাচক হয়ে অনিমিখকে মানিয়ে নিয়েছে। অনন্যার কোনও সমস্যাতে অনিমিখ কখনই তার পাশে তেমন করে দাঁড়ায়নি অথচ নিজের যে কোনও সমস্যাতেই সে অনন্যাকে জড়িয়ে নিয়েছে। তাই, আজকের এই সমস্যার মীমাংসার জন্য অনিমিখের কোনও সাহায্যই যে পাওয়া যাবে না, সেটা অনন্যা ভালো করেই জানে।
সৌমাল্যকে ইতিমধ্যেই সে বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কতই বা বয়স হবে ছেলেটার? অনন্যার থেকে বছর পাঁচেকের ছোটই। কিন্তু একেবারে যেন বদ্ধ উন্মাদ! প্রথম প্রথম অনন্যা কিছু টেরও পাইনি, কয়েকদিনের মাত্র আলাপ। স্কুল যাবার পথে বেশ কিছুটা রাস্তা ওরা একসঙ্গে যাতাযাত করে। সেখান থেকেই আলাপ। আস্তে আস্তে কিছুটা পরিচিতি, এই পর্যন্তই ব্যাস। এর মধ্যেই সৌমাল্য হঠাৎ করে এমন পাগলামি শুরু করতে পারে, সেটা অনন্যার ধারনার বাইরে ছিল। ফলত সৌমাল্যকে বাধ্য হয়েই অনন্যা এড়িয়ে চলতে শুরু করল। ঠিক তার কিছুদিনের মধ্যেই সৌমাল্য অনন্যাকে অপহরণ করল।
কিডন্যাপড হবার পরে অনন্যা প্রথম বুঝতে পারল সৌমাল্যকে সে যতটা সরল ভেবেছিল ততটা সরল ছেলে সৌমাল্য নয়। কিন্তু ততক্ষণে অনন্যা পুরোপুরি সৌমাল্যের আয়েত্তাধীন। আসলে সৌমাল্যের পুনঃপুন প্রেম নিবেদন সে জাস্ট নিতে পারছিল না! তাই বলে ছেলেটা যে এতদূর এগোবে, এটা ছিল অনন্যার চিন্তার অতীত। অথচ অনন্যা চুপচাপ বসে থাকার মেয়ে নয়। সৌমাল্যের এই কাজটা যে চরম অন্যায় সে প্রথমে ভালোভাবে সৌমাল্যকে বোঝানোর চেষ্টা করল। এমন কী সৌমাল্য যদি তাকে ছেড়ে দ্যায়, তাহলে সৌমাল্যের বিরুদ্ধে সে অপহরণ বা অন্য কোনো অ্যালিগেশন আনবে না বলে কথাও দ্যায়। কিন্তু সৌমাল্য সে বান্দা নয়। অনন্যার কথা সে একেবারেই পাত্তা দিল না। নিরুপায় হয়ে অনন্যা নিজেই পালানোর চেষ্টা করল। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও পুরোপুরি ব্যর্থ হ’ল। পুরো বাড়িটাতে সৌমাল্য সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে তার মোবাইল থেকে অপারেট করে, ফলত অনন্যার প্রতিটা পদক্ষেপই সৌমাল্য অতি সহজেই টের পেয়ে যাচ্ছিল, আর অনন্যার সমস্ত পরিকল্পনাও যথারীতি ব্যর্থ হচ্ছিল। যে বাড়িটিতে অনন্যাকে রাখা হয়েছে, সেখানে সে আর সৌমাল্য ছাড়া বাড়িটির কেয়ারটেকার কাম রাঁধুনি রহমত চাচা ব্যতীত অন্য কারোকে অনন্যা একটিবারের জন্যেও দেখতে পায়নি। বাড়ির বাইরে যাওয়া অনন্যার নিষেধ। বাড়িটা যদিও বেশ বড়। সামনে একটা বাগান মতো আছে, সেখানে যাওয়াও অনন্যার বারণ! তার মোবাইল বর্তমানে সৌমাল্যের কব্জায়। অনন্যার সঙ্গে বাইরের জগতের যোগাযোগের জন্য এখন শুধুমাত্র টিভিই একমাত্র ভরসা। এই বাড়ির বাইরের খবরাখবর সে যেটুকু পাচ্ছে সেটা শুধুমাত্র টিভির মারফৎ। টিভির খরবেই সে জানতে পারছে করোনা বিধ্বস্ত পৃথিবীর ভয়াবহতার বিভিন্ন খবর। ভারতেও লকডাউন চলছে। দেশের পরিস্থিতিও যথেষ্ঠ উদ্বেগজনক। কিন্ত এইসবের থেকেও অনন্যার এখন প্রধান চিন্তা এই বাড়ি থেকে বের হয়ে সৌমাল্যের কবল মুক্ত হওয়া। ছেলেটা অত্যন্ত ডেসপারেট বললও কম বলা হয়। যদিও প্রায় একমাস ধরে সৌমাল্য তাকে এই বাড়িতে আটকে রেখেছে। কিন্তু এখনও অবধি একবারের জন্যেও তার প্রতি কোনও অশালীন আচরণ করেনি সে। এটাই যা আশার কথা। না হলে এতদিনে অনন্যার সঙ্গে সে অনেক কিছুই করে ফেলতে পারত।
সম্প্রতি ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয়সরকার উভয়েই লকডাউন কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন। সৌমাল্য যেদিন তাকে রাস্তা থেকে অপহরণ করে সেদিন ১২ই মার্চ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। স্কুলে অনন্যার গার্ড ছিল। সেইদিনই ফেরার পথে রাস্তা থেকে তাকে জোর করে একটা স্করপিওতে টেনে তুলে আনা হয়। একেবারে রাজরাস্তা থেকে! অথচ এই ঘটনাটা তেমনভাবে মিডিয়াতে তুলে ধরা হয়নি, সে অন্তত এখনও দেখেনি, হয়ত অনিমিখ ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে ব্যাপারটাকে চেপে দিয়েছে। কিন্তু তাকে উদ্ধারের ব্যাপারেও তেমন কোনও তৎপরতা এখনও চোখে পড়েনি! না প্রশাসনের তরফে, না অনিমিখের ব্যক্তিগত তরফে। যদি কিছুমাত্র তৎপরতা থাকত তাহলে এতদিনে সে ঠিকই উদ্ধার হত। মনের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ প্রতিদিনই বাড়তে থাকে অনন্যার। বিশেষত অনিমিখের ব্যবহার, তার ভাবনা চিন্তা, দিনদিন যেন অনন্যার কাছে দুর্বোধ্য থেকে দুর্বোধ্যতর হয়ে যাচ্ছিল। তাই এখন অনিমিখ যে ব্যক্তিগত স্তরে খুব একটা চেষ্টা কিছু করবে বলে মনে হয় না। অথচ রাজ্য প্রশাসনে অনিমিখের ব্যক্তিগত যোগাযোগ যথেষ্ঠই ভালো, সেটা অনন্যা খুব ভালো করেই জানে। কখনও কখনও আবার মাথাটা সামান্য ঠান্ডা থাকলে নিজেকে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে তার মনে হয়, কে জানে হয়ত অনিমিখও তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে, এখনকার টালমাটাল পরিস্থিতি, সেই কারণেই হয়ত সমস্তটাই তালগোল পাকিয়ে আছে। করোনার এই ভয়াবহতা কিছুটা না কমলে, উদ্ধারের ব্যাপারে ইতিবাচক তেমন কিছু হবার আশা কম, সেটা অনন্যা হাড়ে হাড়েই বুঝতে পারে।
যে বাড়িটাতে অনন্যারা আছে সেটা একটা মফস্বল শহর। দোতলা বাড়ির নীচের তলাতে রহমত চাচা থাকে আর ওপরের পাশাপাশি দুটো ঘরে অনন্যা আর সৌমাল্য থাকে। এই কয়েকদিনে সৌমাল্য, অনন্যার সঙ্গে কখনও কোনও অশালীন আচরণ করেনি ঠিকই কিন্তু নিজের ঘর থেকে অনন্যার ওপর সর্বদাই সে তীক্ষ্ম নজর রেখেছে, এই কথাও সত্য। রহমত চাচা সারাদিন কী যে করে, অনন্যা তার হদিশ পায় না! দোতলায় সে বড়ো একটা ওঠে না। রান্নাবান্নার কাজ সমেত ঘর গেরস্থালির সমস্ত কাজ এবাড়িতে রহমত চাচা নিপুণ হাতে সামলে দ্যায়। সৌমাল্যের বাড়ির সে বহু পুরাতন ভৃত্য, বলা ভালো সৌমাল্য যতটা তার মা বাবার কাছে থেকেছে, তার থেকে বেশি থেকেছে রহমত চাচার কাছে। সৌমাল্য যখন কম্পিউটার সায়েন্সে বিটেক করতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হ’ল, তখন সে এই বাড়িটার থেকেই যাতাযাত করত। সেই থেকেই রহমত চাচা এই বাড়িতেই রয়ে গেছে। সৌমাল্য এখানেই বেশি থাকে। বাড়িটা বেশ বড়সড়। অনেকটা শান্তিনিকেতনী স্টাইলে তৈরী। কিন্তু আশেপাশে কোনও বাড়িঘর নেই। বেশ কিছু দূরে থাকলেও থাকতে পারে। অনন্যার পক্ষে বাড়ির ভেতর থেকে সেসব দেখা বা জানা সম্ভব না হলেও তার অনুমান করে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু এই ব্যাপারে কোনও কৌতুহলের অবকাশ বা মানসিকতা এই মুহূর্তে তার নেই। বাড়িটির চারদিকে বাউন্ডারি ওয়াল রয়েছে, ঠিক তার মাঝে দোতলা বাড়িটি দেখে মনে হয় বাড়িটার বুকে অনেক কথা লুকিয়ে আছে। দীর্ঘকাল উপযুক্ত শ্রোতার অভাবে সে হয়ত কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছে। লোক বলতে আগে ছিল মাত্র দু’জন- সৌমাল্য আর রহমত চাচা। আর এখন অনন্যাকে নিয়ে তিনজন। বাজার-হাট রহমত চাচাই বেশি করে, কখনও সখনও সৌমাল্যও করে। লকডাউনের জন্য এখন নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী মোটামুটি স্টকে আছে, লকডাউনের শুরুতেই এমন কথা রহমত চাচা যখন সৌমাল্যকে বলেছিল, অনন্যাও সেখানে উপস্থিত ছিল বলে এই সমস্ত বাক্যালাপ সে শুনতে পেয়েছিল। ইদানিং অবশ্য এই ধরনের টুকটাক কিছু কথাবার্তা শোনা ছাড়া এখানে অনন্যার কোনও কাজ নেই। তাকে এখানে আনার কিছুদিন অবধি সৌমাল্য অনন্যার সামনে তেমন একটা আসেনি। অনন্যা যখন প্রচণ্ড চেঁচামিচি করত শুধুমাত্র তখন সে আসত। ধীরে ধীরে আসার ফ্রিকোয়েন্সি বাড়লেও কখনও কোনও অশালীন আবদার বা জোবরদস্তির সম্মুখীন এখনও পর্যন্ত অনন্যাকে হতে হয়নি, অনন্যার কাছে অবশ্য এটাই এখন অনেকটা প্রাপ্তি বলে মনে হয়।
অপহরণ হবার পর থেকে সৌমাল্যের সঙ্গে অনন্যার কথা বলতে একেবারেই ভালো লাগে না, সেটা সৌমাল্য নিজেও বুঝত, তাই হয়ত তাকে তেমন ঘাটাতে সাহস পেত না। কিংবা কখনও কখনও একথা সেকথার মাঝে নিজের জীবনের কিছু কথা বলা শুরু করত। কিছুক্ষণ পরে অনন্যা অধৈর্য হয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলত, ‘তোমার আত্মজীবনী শোনার কোনও ইচ্ছা, আগ্রহ বা বাসনা কোনওটাই আমার নেই। আমাকে এখানে অযথা আটকে রেখেছ কেন? তুমি জানো এর জন্য তোমার কী শাস্তি হতে পারে?’
সৌমাল্য যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ত, তারপর বলে উঠত, ‘আমি শুধু তোমার একটু ভালোবাসা চাই অনন্যা।’
-‘তুমি পাগল না শয়তান বলো তো? যার কাছে ভালোবাসা চাইছ, তাকেই আটকে রেখে কষ্ট দিচ্ছ! আবার গদগদ হয়ে ভালোবাসা জানাচ্ছ! আমি একজন বিবাহিতা নারী, তুমি জানো না? তোমার থেকে আমি পাঁচ-ছয় বছরের বড়, একথা তুমি জানো না? আর আগেও তো তোমায় বহুবার বলেছি, তোমার এই ধরনের পাগলামো আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। শুধু বন্ধুত্বটা থাকতে পারত, কিন্তু তুমি যেটা করেছ, তারপর সেটা থাকাও আর সম্ভব নয়।’
সৌমাল্য বলত, ‘কেন! কেন সম্ভব নয়? কীসের অভাব আছে আমার? আমি নিজে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, সফল ব্যবসায়ী। বাবার একমাত্র সন্তান। তাঁর স্থাবর অস্থাবর সব কিছুই আমার। যদিও আমি সেসবের প্রত্যাশী নই। আমি শুধু তোমার ভালোবাসা চাই। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।’
-‘ওগুলোর কোনওটাই ভালোবাসার জন্য লাগে না। তাছাড়া দেশে কি আর মেয়ে নেই যে, বারবার আপত্তি করার পরেও তুমি আমার পেছনেই পড়ে আছো? ছিঃ!’

অনন্যার আজকাল সৌমাল্যকে দেখলেই ভেতরে ভেতরে একটা প্রচণ্ড রাগ হয়। কিন্তু এখান থেকে মুক্তি পেতে গেলে সব সময় সেই রাগের বর্হিপ্রকাশ যে যুক্তিসংগত নয়, সেটাও সে বোঝে। তবুও বেশিরভাগ সময়েই নিজেকে সামলাতে পারে না। পরে মাথাটা কিছুটা ঠাণ্ডা হলে ভাবে, শুধু রাগ দেখিয়ে পার পাওয়া যাবে না। সৌমাল্য ছোকরাটাও খুব ট্যারা টাইপের। ভেতরে কিছুটা যেন রুক্ষ্মতাও আছে। তাই নরমে গরমে চেষ্টা করার দরকার। কিন্তু সমস্যা হ’ল সৌমাল্যকে দেখা মাত্রই তার মাথা থেকে এই বুদ্ধি একেবারে উদাও হয়ে যায়। পরিবর্তে প্রচণ্ড একটা আক্রোশ তৈরী হয়। বড়লোক বাপের একটা বেপরোয়া, বিপথগামী, বখে যাওয়া ছেলে এইভাবে তার জীবনে সমস্যা আনতে পার, সেটা তার ভাবনারও অতীত ছিল।
এতদিনেও রহমত চাচার সঙ্গে তেমনভাবে কথা হয়নি অনন্যার। আত্মভোলা প্রকৃতির মানুষ। উপরে প্রায় ওঠেই না। আর অনন্যাও নিচে নামে না। টানা একমাস এই বাড়িতে সে বন্দী, মাত্র দু’দিন সে নিচে নেমেছে। বাগানে ঘুরেছে। সঙ্গে সবসময় সৌমাল্য তাকে ঘিরে থেকেছে। বাগান আর ছাদে তার একা একা যাওয়া অলিখিত বারণ। ঘরের ভেতর খুব অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে, যখন তার প্রতিটা কথাবার্তায় সেই ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন সৌমাল্য যেভাবেই হোক আর অমত করতে সাহস পায় না। প্রকৃতির মাঝে অনন্যা কিছুক্ষণের জন্য হলেও একটা শান্তি খুঁজে পায়। কিংবা রাতের আকাশ যখন জানলা বা বারান্দা থেকে তাকে ইশারায় ডাক দ্যায়, তখন সে নিজেই সৌমাল্যকে বলে, ‘ছাদের চাবি দাও, ছাদে যাব। দিনের পর দিন এইভাবে চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে থাকতে আমি পাগল হয়ে যাব। মরে যাব।’
সৌমাল্য আর আপত্তি করার সাহস দেখাত না। কিন্তু তার পিছুও ছাড়ত না। সে নিজেও অনন্যার সঙ্গে ছাদে উঠত। এই বাড়ির আসে পাশে কোনও জন বসতি নেই বলে তাদের কেউ দেখতে পায় না, তারাও কাউকে দেখে না। বেশ কিছুক্ষণ পরে হয়ত কখনও অনন্যার খেয়াল হয় বাড়ির উঠোন থেকে একজোড়া চোখ নীরবে তাদের ওপর লক্ষ্য রাখছে। প্রথম প্রথম সে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারত না। পরে বুঝেছে নিচ থেকে রহমত চাচা তাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখছে। এমনই কোনও কোনও রাতে সৌমাল্যের নিজের আবেগে বলে চলা স্বগতোক্তির কিছু কিছু অনন্যার কানে আসত। তার থেকেই সে বুঝেছিল, সৌমাল্যের ছোটোবেলা থেকেই তার বাবা-মার সম্পর্কটা স্বাভাবিক ছিল না। বাবার অগাধ পয়সা, আর ভোগবিলাসিতার জীবনকে প্রায় টক্কর দিতে তার মা সংসার, সন্তান এইসব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে, নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছিল। ডক্টর সৌমক সেনের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক সেই সময়েই শুরু হয়। ছোট্ট সৌমাল্যের সামনেই বাবা-মার মধ্যে কোনও কোনও রাতে চাপা ঝগড়াঝাঁটির সময় সেইসব কথা উঠে আসত। বাবা সৌমক সেনের কথা তুললেই মা সঙ্গে সঙ্গে বাবার সহকর্মী নারায়ণ চৌধুরীর স্ত্রী দীপা আন্টির কথা তুলে বাবাকে মুখ ঝামটা দিত। চাপা গজরানি ক্রমশ যেন গর্জনে রূপান্তরিত হত। ছোট্ট সৌমাল্য তখন বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকত। এইভাবে বহুদিন কাটার পরে তাকে দেখাশোনার জন্য নিলিমা আন্টিকে রাখা হয়। সারাদিন নিলিমা আন্টির কাছে থেকে রাতে আন্টি চলে গেলে রহমত চাচার ঘরে তার শোবার ব্যবস্থা পাকা করা হ’ল। সেই থেকে রহমত চাচা তার একান্ত আপন হয়ে উঠতে লাগল। আর নিজের বাবা-মা তাদের ভোগবিলাসিতায় আরও বেশি করে মেতে উঠল। বড় হয়ে এই ব্যাপারগুলো যখন সৌমাল্যের বোঝার বুদ্ধি হ’ল, তখনও এই মৃত সম্পর্ককে তার মা বাবা এখনও কেন টেনে নিয়ে কেন যাচ্ছে এটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু নিজে কখনো তার শৈশবের সেই তিক্ত স্মৃতিগুলো মন থেকে মুছে ফেলতে পারল না, ফলত মা-বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কও আর স্বাভাবিক হয়ে উঠল না।
এই সমস্ত কথাবার্তাই সৌমাল্যের স্বগতোক্তির ফসল। অনন্যা কখনও কখনও তাকে আঘাত করার জন্য বলত, ‘এসব কথা শুনিয়ে আমার সহানুভূতি পাবার চেষ্টা করছ? ভালোবাসার চারা রোপণ করা যায় নাকি? নিজের দুঃখের কথা শুনিয়ে তার বীজ বপন করে আস্তে আস্তে তাতে জল ঢালতে ঢালতে সেই সহানুভূতিগুলো আমার ভালোবাসা হয়ে তোমাকে স্বাগত জানাবে ভাবছ?’
সৌমাল্য একটু লজ্জিত হয়ে বিমর্ষ কণ্ঠে বলে উঠত, ‘না ঠিক তা নয়। আসলে এই কথাগুলো কাউকে বলতে পারলে মনটা একটু হালকা লাগে। সেইজন্যেই বলছিলাম।’
-‘তা, সে আমাকে কেন?’
-‘তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলব? কে আছে আমার?’
-‘আমি তোমার বন্ধুও নয়, আত্মীয় পরিজনও নয়। ইনফ্যাক্ট তোমার সঙ্গে আমার কোনও রিলেশনই নেই। তুমি একটা বকে যাওয়া ছেলে। যদি ভেবে থাকো আমি তোমার এইসব আলুভাতে মার্কা কথাবার্তা শুনে গলে যাব, তাহলে বলে রাখি, সে গুড়ে বালি। তুমি নিজের পথ দ্যাখো, আর আমাকে আমার বাড়ি যেতে দাও। না হলে সমূহ বিপদে পড়বে কিন্তু বলে রাখলাম।’
সৌমাল্য আর কথা বাড়াত না। তখনকার মতো চুপ করে যেত। পরে আবার অন্য কোনও দিন নিজের অবচেতনেই আবার অনন্যার কাছে বলে ফেলত। কিছুক্ষণ পরে অনন্যা তাকে বেশ কিছু কটূক্তি নিক্ষেপ করে থামিয়ে দিত। আসলে ইদানিং কারণে অকারণে সৌমাল্যকে আঘাত দিয়ে সে একটা আনন্দ পায়। এর মধ্যেই হয়ত সে নিজের যন্ত্রণা কিছুটা ভুলে থাকতেও পারে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *