সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ৫)

তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন

মনোজ জীবনের কথা ভুলতে পারে না মরে গিয়েও। কত জীবনের কথকথা তার মনে পড়ছে তৃতীয় স্তরের আত্মা হয়ে। হয়ত কোনদিন প্রথম স্তরের আত্মা তাকে টেনে নেবে স্বর্গদ্বারে। তাদের গ্রামে
রাত বাড়লে নাট মন্দির লোকের ভিড়ে ভরে যায়। শুরু হয় নাটক। দেবতার গলায় গাঁদা ফুলের মালা।অভিনয় দেখে সকলেই মোহিত হয়ে যায়। নাটকের শেষে দেবতার গলায় থাকা মালা নিয়ে দরাদরি শুরু হয়। স্মৃতিকন্ঠ হাঁকেন, আমি মালার দাম দশ হাজার দিলাম। শুভবাবু পারিষদদল নিয়ে বসে আছেন। তিনি ভাবলেন,এ মালা আমাকেই নিতে হবে। তা না হলে মান সম্মান থাকবে না। তিনি মালার দর হাঁকলেন কুড়িহাজার টাকা।এইভাবে চলতে থাকল নীলামের খেলা। এদিকে নাটকের দলের মহিলা একজন বলছেন, আপনাদের গ্রামের লোক এত কৃপণ কেন। এই তো পাশের গ্রামে মালার দর পেয়েছি এক লক্ষ টাকা।শুনে মালার দর আরও বেড়ে গেল। এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকায় নীলামে একটা গাঁদার মালা কিনল গাধার দল।মুচকি হাসি আগত অভিনেত্রীর চোখেমুখে। তিনি সফল আপন কারবারে।এইভাবে বেশ কয়েকদিন টাকা কামিয়ে নাটকের দল চলে যেত আরও মুরগির সন্ধানে….
—ওরে যাস না ওদিকে, পুকুর আছে ডুবে যাবি
—– না মা, কিছু হবে না
ছোট থেকে চিনু দুরন্ত, একরোখা ছেলে। ভয় কাকে বলে সে জানে না। এই নিয়ে তার পরিবারের চিন্তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মনোজের বন্ধু চিনু। মনোজ জানে এই চিনুর আত্মা তাকে উদ্ধার করবে মরার পরে।
এইভাবে প্রকৃতির কোলে বড় হয়ে যায় মানুষ । কত কি শেখার আছে প্রকৃতির কাছে। কিন্তু কজনে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কিন্তু চিনু সেই শিক্ষা নিয়েছিল। গ্রামের সকলে তাকে একটা আলাদা চোখে দেখত।বেশ সম্ভ্রমের চোখে। পরিবারের সকলে জানে না, কি করে চিনু শিক্ষা পেল। প্রথাগত শিক্ষা সে পায় নি। তবু বাড়িতে দাদুর কাছে লেখাপড়া শিখেছে। বই পড়া শিখেছে। চিনু বলত, দাদু কি করে তুমি বই পড়। আমি পারি না কেন? দাদু বলতেন, নিশ্চয় পারবি। মনে মনে বানান করে পড়বি। দেখবি খুব তাড়াতাড়ি বইপড়া শিখে যাবি।হয়েছিল তাই। দুমাসের মধ্যে চিনু গড়গড় করে বই পড়ত।কোনো উচ্চারণ ভুল থাকত না।দুপুরবেলা হলেই চিনু বন্ধুদের নিয়ে কদতলা, বেলতলা, আমতলা, জামতলা দৌড়ে বেড়াত। কাঁচা কদ কড়মড় করে চিবিয়ে খেত। লাঠিখেলা,কবাডি সব খেলাতেই তার অদম্য উৎসাহ। গ্রামের লোকের উপকারে তার দল আগে যায়।এই দাপুটে ছেলে চিনু একদিন এক সাধুর সঙ্গে ঘরছাড়া হল। বাড়ির সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। কিন্তু চিনুকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। একদিন গ্রামের একজন গিয়ে দেখল, সাধুর আশ্রমে সবুজ গাছ যত্নের, কাজ করছে চিনু.
ভূত বলে কিছু হয় না জানি। তবু ভূতের প্রতি আমার ছোট থেকেই দূর্বলতা আছে। বিশ্বাস করি। ভগবান আছেন ভূতও আছে। আমার এক বন্ধু মাঠে খেলতে গিয়ে আমাকে বললো, আমার দাদু এসেছিলেন এখনি। হয়ত তিনি মরে গেলেন। দুজনেই বন্ধুর বাড়ি গিয়ে দেখলাম কথাটা একদম সত্যি। দাদু বলেছিলেন মরার পরে তোকে একবার দেখা দেব। এই ঘটনাকে আপনি কি বলবেন বলুন? আর তাছাড়া ভূত সমাজে ভাল, মন্দ সব রকমের ভূত আছে। আমার দাদু বলতেন, একবার চাষের জমিতে জল লাগবে। টাকা পয়সার অভাবে জল দিতে পারি নি। রাতে শুয়ে ভাবছি, আমি রোগী আবার সত্তর বছরের বুড়ো। এ ঘোড়া আর ঘুরে ঘাস খাবে না।চাঁদের আলোয় বসে আছি জেগে। কি সুন্দর পৃথিবীর রঙ। সকলের যদি আহারের ব্যবস্থা থাকত তাহল দুঃখ থাকত না। আর তারজন্য চাষের জমির পরিমাণ বাড়াতে হবে। জলের ব্যবস্থা করতে হবে। এইসব ভাবছি, এমন সময়ে দরজায় টোকা। আমি বললাম, কে?
বাইরে থেকে আওয়াজ এল, চলে আয় বাইরে।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চলে গেলাম বাইরে, তারপর মাঠে। সে আমাকে বলল, তুই বসে থাক। এখানকার সব জমিতে জল দেব। একটু দূরে বড় পুকুর ছিল। ওই পুকুরে ভয়ে আমরা যেতাম না। দিনের বেলায় পর্যন্ত ওখানে হাসির শব্দ পেত সবাই। হি হি হি করে কারা যেন হাসত ব্যঙ্গ করে। শুনলাম ভয়ংকর হাসি। বার বার পাঁচবার। ভয় পেলাম প্রচন্ড।
তারপর আর কিছু মনে নেই।
পরের দিন মাঠে গিয়ে দেখি, ভালোই হয়েছে। জলে জলময় সব মাঠ। এই খরার সময় এত জল দেখে সবাই অবাক। লোকে বলল,এ তো একদম ম্যাজিক। চাষিরা বলল, এই ম্যাজিক যেন বার বার প্রতিবার হয়।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।